এপ্রিলে কমেছে জনশক্তি রফতানি, নতুন খবর নেই মালয়েশিয়া শ্রমবাজারে
১৫ মে ২০২২ ১২:২০
ঢাকা: প্রবাসী আয় সুবাতাস নিয়ে এলেও কমেছে জনশক্তি রফতানি। গত মার্চ মাসের তুলনায় এপ্রিলে অন্তত ২০ হাজার জন কম কর্মী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে গেছেন। এ মাসে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোতেও উল্লেখযোগ্য হারে কর্মী যাওয়ার সংখ্যা কমেছে। তবে কুয়েত, কাতারের মতো যে সব দেশে গত কয়েক মাস ধরে কর্মী পাঠানোর হার বেশ কম ছিল সেগুলোতে বেড়েছে।
এদিকে মালয়েশিয়া শ্রমবাজার খোলার বিষয়েও নতুন কোনো খবর নেই। সুখবর নেই নতুন শ্রমবাজার খোঁজার বিষয়েও। তবে সৌদি আরবের শ্রমবাজার আরও সম্প্রসারণ করতে দেশটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাশিয়া- ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে সারাবিশ্বের বাজারেই একটা টালমাটাল অবস্থা চলছে। যার কম বেশি প্রভাব সব ক্ষেত্রেই পড়েছে।
বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী— এপ্রিল মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে গেছেন ১ লাখ ৩ হাজার ৯৭৫ জন কর্মী। যা গত মার্চে গেছে ১ লাখ ২০ হাজার ৩১৬ জন। এপ্রিল মাসে সৌদি আরবে ৬২ হাজার ৫২৭ জন, যা মার্চে ছিলো ৭৮ হাজার ৮৭০ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১১ হাজার ৭০৪ জন যা মার্চে ছিলো ১২ হাজার ৩৫৭ জন, কুয়েতে ১ হাজার ২০১ জন যা মার্চে ছিল ৭২৭ জন, ওমানে ১৫ হাজার ২১৩ জন যা মার্চে গেছে ১৪ হাজার ৩৮৯ জন, কাতারে ১ হাজার ৭৪৫ জন যা মার্চে ছিল ১৬৩১ জন, লেবাননে গেছে ৭৫ জন গত মার্চে গেল ৪৬ জন, জর্ডানে ১৬৩৭ জন যা মার্চে ছিল ১৯৯০ জন, লিবিয়াতে গেছে ৭ জন, সুদানে ১৬ জন মার্চে গেছে ২৩ জন, মালয়েশিয়ায় গেছে ৩৯ জন এর আগের মাসে গেছে ১২ জন, সিঙ্গাপুরে গেছে ৫ হাজার ২৪২ জন আর মার্চে গেছে ৬ হাজার ৬৯৭ জন, সাউথ কোরিয়ায় ৬৭১ জন মার্চে গেছে ৩৫২ জন, লন্ডনে গেছেন ৩৫ জন আর মার্চে গেছেন ২৬ জন, ইতালিতে ১১৮ জন মার্চে গেছে ১১০ জন, জাপানে ৮৪ জন মার্চে গেছেন ৯ জন, ব্রুনাইয়ে জন আগের মাসেও ৫ জন, মরিশাসে ৩৬৪ জন আগের মাসে ২১১ জন, ইরাকে ১ জন আগের মাসে গেলো ১১ জন। আর অন্যান্য দেশে এপ্রিলে গেছেন ১৫৬১ জন যদিও গত মার্চে গেছে ১০৮৩ জন কর্মী।
আর গত চার মাসে মোট জনশক্তি রফতানি হয়েছে ৪ লাখ ২৬ হাজার ৫৫৮ জন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে গেল ১ লাখ ৯ হাজার ৬৮৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে গেছে ৯২ হাজার ৫৬৯ জন আর মার্চে গেল ১ লাখ ২০ হাজার ৩১৬ জন, আর এপ্রিলে গেল ১ লাখ ৩ হাজার ৯৭৫ জন। চলতি বছরের গত তিন মাসে সবচেয়ে কম গেছে বাহারাইনে। চার মাসে মাত্র ১ জন কর্মী যেতে পেরেছে, লিবিয়ায় গেছে ৯ জন, জাপানে ৯৩ জন, ব্রুনাইয়ে ১৬ জন, সুদানে ৩৮ জন, ইরাকে গেছেন ৪ জন। আর গত চার মাসে মিশরে একজন কর্মীও পাঠানো যায়নি।
এদিকে গত চার মাসে সবচেয়ে বেশি কর্মী গেছেন সৌদি আরবে। গত চার মাসে গেছে ২ লাখ ৬৮ হাজার ২৮৪ জন। যা মোট জনশক্তি রফতানির ৬২. ৯৪%। ওমানে গেছে ৫৬ হাজার ৮৩০ জন। যা মোট জনশক্তি রফতানির ১৩.৩২%। সংযুক্ত আরব আমিরাতে গেছেন ৫১ হাজার ৫৩১ জন। যা মোট জনশক্তি রফতানির ১২.০৮ %। সিঙ্গাপুরে গেছে ১৮ হাজার ৬০৬ জন। যা শতকরা হিসাবে ৪.৩৬%।
গত চার মাসে সৌদে আরবে কর্মী পাঠানোর সংখ্যা বেশি দেখা গেলেও গত তিন মাসের চেয়ে এপ্রিল মাসে সবচেয়ে কম কর্মী গেছে দেশটিতে। জানুয়ারিতে সৌদি আরবে কাজ নিয়ে গেছেন ৭১ হাজার ১৭২ জন। ফেব্রুয়ারিতে গেছে ৫৬ হাজার ৯৩ জন, মার্চে ৭৮ হাজার ৮১০ জন এবং এপ্রিলে গেছে ৬২ হাজার ৫২৭ জন। এদিকে গত মাসে কমেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ক্ষেত্রেও। সেখানে গেছে ১১ হাজার ৭০৪ জন। যা মার্চের চেয়ে ১ হাজার ৪৩৫ জন কম, জর্ডানেও প্রায় ১ হাজার কর্মী কম গেছে। তবে কুয়েত, কাতার, ওমান, জাপানে কর্মী যাওয়ার সংখ্যা বেড়েছে। কুয়েতে মার্চে ৭২৭ জন গেলেও এপ্রিলে গেছে ১ হাজার ২০১ জন, কাতারে ১ হাজার ৬৩১ জন মার্চে গেছেন আর এপ্রিলে গেল ১ হাজার ৭৪৫ জন কর্মী। ওমানে মার্চে গেছেন ১৪ হাজার ৩৮৯ জন আর এপ্রিলে গেছেন ১৫ হাজার ২১৩ জন কর্মী। এ ছাড়া জাপানে মার্চে যেখানে ৯ জন কর্মী গেছে সেখানে এপ্রিলে ৮৪ জন যেতে পেরেছে।
এদিকে চালু হবে হবে বলেও হচ্ছে না মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারের মধ্যে কর্মী পাঠানো বা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মতানৈক্যের কারণে চুক্তি করেও পাঁচ মাসে এই গুরুত্বপূর্ণ বাজারটি পুনরায় শুরু করা যায়নি। মালয়েশিয়া সরকার চায় শুধু মাত্র গুটিকয়েক বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিই কেবল দেশটিতে কর্মী পাঠাতে পারবে। আর বাংলাদেশ চায় নিবন্ধিত সব এজেন্সি কর্মী পাঠানোর সুযোগ পাবে। এ দাবি বেসরকারি জনশক্তি রফতানিকারকদেরও।
এ প্রসঙ্গে জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রার সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘সিন্ডিকেটের অনিয়ম দুর্নীতির কারনেই তিন বছর আগে গুরুত্বপূর্ণ মালয়েশিয়া শ্রমবাজারটি বন্ধ হয়ে যায়। এবারও এই সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে মালয়েশিয়ার একটি চক্রের সঙ্গে মিশে আবার সিন্ডিকেট তৈরির শর্ত দিয়েছে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কর্মী পাঠালে আবারও বিশৃঙ্খলা হবে এবং শ্রমবাজারটি চালু হবে কীনা এ নিয়েও সংশয় রয়েছে।’
নতুন শ্রমবাজার খোঁজার পাশাপাশি পুরনো শ্রমবাজার ধরে রাখা এবং সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। বৃহস্পতিবার (১২ মে) প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত এসা ইউসুফ এসা আলদুহাইলান এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ এর মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে সৌদি আরবে বাংলাদেশের শ্রমবাজার সম্প্রসারণ, স্বল্পতম সময়ে ন্যুনতম অভিবাসন ব্যয়ে আরও বেশি সংখ্যক কর্মী পাঠানো, কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য প্রতিরোধে কাজ করার বিষয়ে একসঙ্গে কাজ করার তাগিদ দেন প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী। পাশাপাশি সৌদি আরবে অবস্থানরত বাংলাদেশি কর্মীদের সুরক্ষার বিষয়ে কথা বলেন তিনি।
এদিকে গত ফেব্রুয়ারি মাসে রেমিটেন্স আসায় ধ্বস নেমেছিল তাতে যে গতি মার্চ মাসে এসেছিল তা এপ্রিলেও অব্যাহত রয়েছে। এপ্রিলে প্রবাসীরা ২ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছে। যা টাকার অংকে ১৭ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ১১ মাসে এপ্রিল মাসেই সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। বাংলাদেশ ব্যংকের সবশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী মার্চ মাসে ১৮৬ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে প্রবাসীরা। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। যা ফেব্রুয়ারি মাসের চেয়ে ৩৭ কোটি ডলার বা ৩ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা বেশি। ফেব্রুয়ারি মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৪৯ কোটি ডলার বা ১২ হাজার ৮৮২কোটি টাকা। আর জানুয়ারি এসেছিল ১৭০ কোটি ডলার বা ১৪ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। আর মার্চ মাসে এসেছিল ১৮৫ কোটি ৯৭ লাখ ডলার।
সবশেষ সরকার প্রবাসীদের জন্য নগদ প্রণোদনা দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করেছে। করোনার সংক্রমণ কমে আসায় বিশ্বে ব্যবসা বাণিজ্য, ভ্রমণ, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ নানা কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। রেমিট্যান্স বৃদ্ধিতে এ সব ভূমিকা রাখছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ কাজী খলিকুজ্জামান আহমদ বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলো মহামারির সংকট কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে। যে কারণে বিভিন্ন দেশে কাজের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। কর্মীরা যেতে পারছেন আবার রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়তে শুরু করেছে। বাংলাদেশের উচিত হবে এই মার্কেট ধরে রাখা।’
উল্লেখ্য, বিশ্বের ১৬৮ টি দেশে জনশক্তি রফতানি করে বাংলাদেশ। ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এসব দেশে ১৩ লাখ ৯৫৬ হাজার ৭৪৪ জন কর্মী পাঠিয়েছে বাংলাদেশ।
সারাবাংলা/জেআর/একে