Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঢাকেশ্বরী মন্দিরের অধিকার পেতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১৬ মে ২০২২ ১৩:৩৫

ঢাকা: মাত্র ৬ মাসের জন্য পুনর্বাসনের কথা বলে ১৮ বছর আগে উচ্ছেদ করা হয় ঢাকেশ্বরী মন্দিরের সেবায়েতের দাবিদার পল্টন দাস ও তার পরিবারকে। এরপর তারা আজও ফিরে পাননি বসতভিটা, এমনকি সেবায়েতের সম্মানটুকু। নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার আকুতি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী পরিবারটি। তবে তাদের দাবির পুরো বিষয়টি অস্বীকার করছে মন্দির কর্তৃপক্ষ।

ঢাকেশ্বরী মন্দিরের সৃষ্টিলগ্ন থেকেই এই মন্দিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল পল্টন দাসের পূর্বপুরুষরা। আঠার শতকের দিকে ভাওয়াল রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় বাহাদুর এই মন্দিরের জমি সংক্রান্ত সীমানা নির্ধারণ করে ২০ বিঘা জমি মন্দিরকে, ১ বিঘা যৌথভাবে মন্দিরের সেবায়েত, তিওয়ারী ও পূজারী, গোস্বামী ও চক্রবর্তী পরিবারকে এবং মন্দির অভ্যন্তরে ৫ শতাংশ পরিচালনা ও মায়ের সেবার কাজের জন্যে দাস পরিবারকে যথাযথ বিধিমতে বন্ধবস্থ দেন।

বিজ্ঞাপন

সেই অনুসারে উনিশ শতকে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক জমির মালিকানা সংক্রান্ত প্রথম রেকর্ড সিএস জরিপ হয় এবং তাতে ১৬৮০১ খতিয়ানের ৩৬ নং দাগে, দাস পরিবারের পূর্বপুরুষ আনন্দ দাস গং নামে ৫ শতাংশ জমি রেকর্ডভূক্ত করা হয়।

পরবর্তী সময়ে শুরু হয় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। মন্দিরে হতে থাকে একের পর এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। প্রাণভয়ে অনেকে দেশত্যাগ করে চলে গেলেও একমাত্র দাস পরিবারের সদস্যরা জীবনবাজি রেখে মন্দিরটি রক্ষা করেন। ১৯৪৫ সালের দিকে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে প্রজারা জমির মালিকানাসত্ত্ব লাভ করেন এবং পাকিস্তান সরকার কর্তৃক এসএ রেকর্ড জরিপ সম্পন্ন হলে সেখানে খতিয়ান নং-৪০, দাগ নং-১০৮ দাস পরিবারের নামে রেকর্ডভূক্ত হয়।

বিজ্ঞাপন

দেশভাগের পর পাকিস্তান শাসন আমল থেকে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আদি ঢাকেশ্বরী প্রতিমা ও স্বার্ণালঙ্করসহ মূল্যবান সম্পদ নিয়ে ভারতে পালিয়ে যান তৎকালীন সেবায়েত, তেওয়ারী, গোস্বামী ও চক্রবর্তীরা। তারা ভারতে চলে যাওয়ার সময় মন্দিরের অধিকাংশ ভূমি হস্থান্তর করে যান বলেও জানা যায়। তবে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ওপর বয়ে যাওয়া বহু হামলা লুটপাট; বিশেষ করে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চালাকালে জীবনবাজী রেখে স্থানীয় মুসলিমদের সহযোগিতায় মন্দির রক্ষা করেন সুধীর দাস ও উনার ছেলে রঞ্জিত দাস অর্থাৎ পল্টন দাসের পূর্বপুরুষরা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মন্দিরে ফেরত আসেন চক্রবর্ত্তী পরিবারের দুয়েকজন সদস্য, বাকিরা থেকে যান কলকাতার শোভাবাজারের কুমারটুলি ও ভারতের অন্যান্য স্থানে।

স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অধীনে হওয়া জরিপ আরএস রেকর্ডে ৪৪৮০ খতিয়ানের ৪৯১ দাগে সুধীর দাস গং নামে জমি রেকর্ডভূক্ত হয়। অনেকে তখন তাদের জমির অংশ রেজিস্ট্রি দলিলের মাধ্যমে সুধীর দাসের নিকট বিক্রি করে চিরতরে মালিকানাও অধিকার ত্যাগ করেন।

মন্দিরের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় আনন্দ চন্দ্র দাসের ছেলে সুধীর চন্দ্র দাসের প্রচেষ্টায় মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার সি আর দত্ত (বীর উত্তর), বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্য্য, কে বি রায় চৌধুরী, শুধাংশু শেখর হাওলাদার সহ অন্যান্যদের উৎসাহ ও সার্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে গঠিত হয় মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি। মন্দির সংক্রান্ত এক মামলায় উচ্চ আদালতে বেতনভুক্ত পূজারি প্রদীপ কুমার চক্রবর্তী কৌশলে বেতনভুক্ত পূজারি হতে নিজেকে নেক্সট ফ্রেন্ড বানিয়ে নেন। প্রদীপ কুমার চক্রবর্তী এবং তার সহযোগীরা বাহিরাগত কোনো কমিটিকে মন্দিরে সাহযোগিতা না করায় দাস পরিবারের ওয়ারিশ পল্টন দাসের বাবা মা নিজের বসতঘরের একটি বড় অংশ ছেড়ে দেন বর্তমান মহানগর পূজা কমিটি ও উদযাপন পরিষদকে তাদের অফিস করার জন্য। পল্টন দাসের বসতঘরেই ছিল মহানগর পূজা কমিটি ও পূজা উদযাপন পরিষদের প্রথম সাংগঠনিক কার্যালয়।

সুধীর দাস আশির দশকে তার নিজের উত্তরাধিকারদের সেবায়েত হিসেবে ঘোষণার মাধ্যমে প্রয়াত সেক্টর কামান্ডার সি আর দত্তের মধ্যস্ততায় নিজের সমস্ত সম্পত্তি দান করে দেন ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রয়োজনে। এরই মাঝে শুরু হয় ভারতের রামমন্দির সংক্রান্ত গণ্ডগোল। ১৯৯০ সালে সাম্প্রদায়িক হামলায় লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয় পুরো মন্দির ও সুধীর দাসের বসতবাড়িতে। তিনদিন ধরে জ্বলতে থাকে সুধীর দাসের সাত পুরুষের বসতবাড়ি। এক এক করে দেখতে আসেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদ, বিরোধী দলীয় নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে সুধীর দাসের পুত্রবধূ মমতা রানী দাসকে জড়িয়ে ধরে নিরাপত্তা ও পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

পরবর্তীতে শ্রী শ্রী ঢাকেশ্বরি মন্দিরে প্রধানমন্ত্রীর অনেক উন্নয়নমূলক সহযোগিতা দিলেও মমতা রানী দাস ও তার পরিবার পায়নি কোনো সহযোগিতা।

পরে বাংলাদেশ সরকারে উদ্যোগে শুরু হয় বিএস/সিটি জরিপের কার্যক্রম। দানের তথ্য দৃশ্যমান না থাকায় সুধীর দাসের নামেই ডিপি খতিয়ান ও মাঠ পর্চা রেকর্ডভুক্ত হয়। পরে মালিকানা সংশোধন করে সুধীর দাসের বসবাসের তথ্য ঢাকেশ্বরী মন্দিরের খতিয়ানে নং ৪৬১৬ তে মন্তব্যের কলামে রেকর্ডভুক্ত করা হয়।

১৯৯৯ সনে সুধীর দাস বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গেলে শুরু হয় ছেলে রঞ্জিত দাসের পরিবারের সঙ্গে বিভিন্ন বিরোধ। প্রদীপ চক্রবর্তীর কুপরামর্শ মতে মহানগর পূজা কমিটি এবং পূজা উদযাপন পরিষদের কতিপয় সুবিধাবাদী নেতারা বিভিন্ন মিথ্যে মামলা নানারকম ষড়যন্ত্র করতে থাকেন। দ্রুতবিচার আইনে গ্রেফতার করে দুই মাস আটক রাখা হয় রঞ্জিত দাসের তিন ছেলেকে। একাধিক মামলায় জড়িয়ে রেখে ভাঙচুর ও দখল করা হয় রঞ্জিত দাসের চৌদ্দপুরুষের পৈতৃক বাড়ি। ভিটে থেকে উচ্ছেদ হয়ে পরিবার নিয়ে অসহায় অবস্থায় মন্দির হতে সপরিবারে রাস্তায় পড়েন রঞ্জিত দাস অর্থাৎ পল্টন দাসের বাবা। অসহায় রঞ্জিত দাস তার পরিবারিক অধিকার হারানোর তিন মাসের মধ্যে মানসিক কষ্ট সইতে না পেরে ২০০৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

অত্যাচারের শিকার রঞ্জিত দাসের ছেলে পল্টন দাস ২০১৮ সালে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে নানার দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধে করতে সরকারের বিভিন্ন মহলের নিকট সহযোগিতা প্রার্থনা করেন। আইনি ব্যবস্থায় হতাশ হয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্থক্ষেপ কামনা করছেন। ঢাকেশ্বরী মন্দির একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং রাষ্ট্রের জাতীয় সম্পদ।

পল্টন দাসের পরিবারের অভিযোগ, যারা সেবায়েতের কাছে ১৯৮৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর অনুমতি চেয়ে পূজা করতে প্রবেশ করে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে, এখন তারাই ঢাকেশ্বরী মন্দিরের দায়িত্বে। আর যিনি অনুমতি দিলেন, সেই পরিবারই এখন ঢাকেশ্বরী মন্দিরে প্রবেশ করতে পারেন না। তাদেরই এখন কর্তৃত্ব নেই।

পল্টন দাস বলেন, পূজা উদযাপন কমিটি ক্ষমতা বলে আমাদের অধিকার খর্ব করে রেখেছে। আমাদের জমিতে পূজা হয়, অথচ আমরা সেখানে থাকতে পারি না। একসময় আমাদের কাছে অনুমতি নিয়ে পূজা করত। অথচ আজ তারাই মন্দিরের হর্তাকর্তা। আমরা আমাদের অধিকার ফিরে পেতে চাই। আমরা উচ্চ আদালতে রিট করলে চার সপ্তাহের রুল জারি করে। রুলে ধর্ম মন্ত্রণালয়, ঢাকা জেলা প্রশাসক ও হিন্দু ট্রাস্টের সভাপতিকে জবাব দিতে বলা হয়। এরপর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। প্রয়োজনে আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি কামনা করছি।

এ বিষয়ে জানতে চেয়ে মহানগর পূজা কমিটির সভাপতি মনিন্দ্র দেবনাথকে রোববার (১৫ মে) দুপুরে ফোন করা হলে তিনি বলেন, আমি এখন মিটিংয়ে আছি। মিটিং শেষে আপনাকে কল করা হবে। তিনি রাত ৮টা পর্যন্ত আর ফোন করেননি। এরপর তাকে বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

সারাবাংলা/ইউজে/এএম

ঢাকেশ্বরী মন্দির

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর