গাফফার চৌধুরীর না থাকার কোনো বিকল্প হয় না
১৯ মে ২০২২ ১৮:৫৮
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মুক্তি ও আওয়ামী লীগের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া এক জন কিংবদন্তি। বলা চলে বাঙালি সংস্কৃতির অর্জুন। সেই অর্জুন পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন একটু আগে। ৮৭ বছর বয়সে আজ সকালে উত্তর লন্ডনের বার্নেট হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাহিত্যিক গাফফার চৌধুরী। সেই ১৯৫০ সালে বরিশাল থেকে ঢাকায় আসা, বাঙালি জাতীয়বাদী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া, বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে কর্মমুখর সময়, ৭৪-এ স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য লন্ডনে এসে থেকে যাওয়া, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর আগে-পরে লন্ডনের রাস্তায় মুটে-মজুরের কাজ করে সংসার চালানো, ৮০-র দশকে আওয়ামী লীগের চরম দুঃসময়ে লেখালেখি এবং সাংগাঠনিকভাবে দলটিকে আলগে রাখা মানুষটি আর নেই। বাঙালি আজ তার একজন গুরুত্বপূর্ণ অভিভাবককে হারাল, গাফ্ফার ভাইকে হারাল।
৫০/৬০ এর দশকে বাংলা সাহিত্যের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ গান, কবিতা, উপন্যাস লিখেছেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। ১৯৭৪ সালে পরিবারসহ বিলেতে এলেও চিন্তায় তিনি কখনও বাংলাদেশ ত্যাগ করেননি। ৭০/৮০ এর দশকে বাঙালির দুঃসময়ে তিনি সাহিত্যচর্চা কমিয়ে দিয়ে গণমাধ্যমের দিকে মনযোগ দেন। মূলত গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে বাংলাদেশর মানুষকে সবসময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত রাখতে চেষ্টা করেছেন। আওয়ামী লীগের দুঃসময়েই শুধু নয়, দলটির সুসময়েও নানান দিক নির্দেশনামূলক কাজে নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন তিনি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের অধিকাংশ নেতৃবৃন্দ গাফ্ফার ভাইয়ের সাথে দলটির গতিমুখ নিয়ে আলোচনা করতেন, পরামর্শ নিতেন। এমনকি ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ঢাকার শাহবাগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের তরুণ এবং জ্যেষ্ঠ সংগঠকদের নিবিড় পরামর্শ দিয়ে, লেখালেখি করে, সাক্ষাৎকার দিয়ে আন্দোলনকে নানান দিক থেকে শক্তিশালী করেছেন। ২০১৬ সালে শেখ হাসিনার জীবন ও রাজনীতি নিয়ে নির্মিত প্রথম প্রামাণ্যচিত্র ‘শেখ হাসিনা: দুর্গম পথযাত্রী’ তিনিই প্রযোজনা করেছেন।
আরও পড়ুন:
- না ফেরার দেশে গাফফার চৌধুরী
- আব্দুল গাফফার চৌধুরীর মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর শোক
- আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মৃত্যুতে প্রধান বিচারপতির শোক
- আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মৃত্যুতে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীর গভীর শোক
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে কোনোদিন বিশ্বাঘাতকতা করেননি। মুক্তিযোদ্ধাদের অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা গড়ার যে স্বপ্ন, তিনি সেই স্বপ্নের বাতি বুকে আগলে রেখেছেন তার নানান কর্মের ভেতর দিয়ে। যে ভাষা আমাদের বাঙালি হিসেবে পৃথিবীর কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়, আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে- সেই ভাষা শহিদদের নিয়ে তার লেখা গান যুগ-যুগান্তরে বাঙালির স্মারক হয়ে থাকবে। বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রসঙ্গ এলেই গাফ্ফার চৌধুরীকে সশ্রদ্ধায় স্মরণ করতেই হবে।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সাথে আমার পরিচয় ২০১১ সালে। তার ইংরেজি লেখা কম্পোজ করে দেওয়া, বাংলা লেখা স্ক্যান করে দেশের পত্রিকাগুলোকে পাঠানো এবং বিভিন্ন বিষয়ে কথোপকথন ও আড্ডার ভেতর দিয়েই মূলত তার সঙ্গে পরিচয় ও সখ্যতা গড়ে ওঠে। তার অগাধ স্নেহ, বন্ধুত্ব আমাদের বয়স ও জীবন অভিজ্ঞতার পার্থক্যকে ছাপিয়ে যেত সবসময়।
আমার দেখা গাফ্ফার ভাইয়ের পারিবারিক জীবন কখনই খুব একটা আনন্দময় ছিল না। ভাবী সেই ৭৪ সাল থেকেই পঙ্গু ছিলেন। ছোট ছোট চার মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে লন্ডনে তার জীবন টানাপোড়েনেই কেটেছে। বাংলাদেশে লেখালেখি করে লন্ডনে সংসার চালিয়েছেন। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যে যার মতো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। লন্ডনে বাঙালিদের যেকোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ডাকলেই তিনি যেতেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যেকোনো রাজনৈতিক দল ডাকলেও তিনি যেতেন, নানান পরামর্শ দিতেন, চিন্তা শেয়ার করতেন। যদিও গত বছর তিনেক তিনি আর হাঁটতে পারতেন না। তাই সশরীরে উপস্থিত হতে পারতেন না। কিন্তু অনলাইনে যুক্ত হতে কখনও অপারগতা প্রকাশ করতেন না।
আমি লন্ডন ছেড়েছি, তবুও গাফ্ফার ভাই নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন। এমনকি গত মাসে ফোন করে নিজের মেয়ের মৃত্যুর খবর দিয়েছেন। আমরা রবীন্দ্রনাথের সন্তান হারানোর পরবর্তী দিনগুলোকে স্মরণ করেছি। আমার পিএইচডির কনভোকেশনে তার যোগ দেওয়ার কথা ছিল। আমার অনাগত সন্তানকে কোলে নিয়ে গোঁফসহ তিন জন একসঙ্গে ছবি তোলার কথা ছিল। শেষ আত্মজীবনী নির্ভর উপন্যাসটার পাণ্ডুলিপি আমাকে পড়তে দেওয়ার কথা। কিন্তু তার আগেই চলে গেলেন গাফফার ভাই। জীবনের নানা প্রসঙ্গের মতো মৃত্যু নিয়েও আমাদের অনেক কথা হতো। শান্তিপূর্ণ মৃত্যুকে রবীন্দ্রনাথও ভয় করতেন না। গাফ্ফার ভাইও একটি হাসির রেখা ঠোঁটে চেপে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চাইতেন। মৃত্যুর সময় হয়তো সেরকম হাসিটা নিশ্চয়ই হাসতে পেরেছেন তিনি।
গাফ্ফার ভাই, আপনার বাংলাদেশ এখন কেবল দরিদ্রতা থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করেছে। আমাদের এখন দক্ষ জনশক্তি তৈরি করার সময়। এখন আমাদের শিক্ষা, অর্থনীতি, সমাজ বদলে ফেলার সময়। এই মুহূর্তে আমাদের কাজ করতে পারা মানুষের পাশাপাশি নিখুঁত চিন্তা করতে পারা মানুষেরও খুব দরকার। বাঙলির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্য চিন্তাশীল মানুষদের নেতৃত্ব দিয়েছেন আপনি। আপনাকে এই সময়ে খুব বেশি প্রয়োজন ছিল।
কোনো কোনো মানুষের না থাকার কোনো বিকল্প হয় না। আপনি তাদের একজন। আপনি বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে আজ সকাল পর্যন্ত নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। বাঙালি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ, মানব জাতি কৃতজ্ঞ। রবীন্দ্রনাথের মতো আপনিও বলতেন, পরম বিশ্বসত্ত্বার সাথে মিশে যাওয়ার ভেতরে কোনো ভয় নেই। তাই আপনাকে হারানোয় আজ আমার কোনো শোক নেই। আমরা কেউ মৃত্যুকে ভয় পাই না। আমরাও আসছি গাফ্ফার ভাই। আপনাকে ভালোবাসি।
লেখক: গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব ইয়র্ক, যুক্তরাজ্য
ইমেইল: [email protected]
সারাবাংলা/পিটিএম