মিল-গুদামে মজুত, গুজবে অস্থির চালের বাজার
১৯ মে ২০২২ ২২:১৬
চট্টগ্রাম ব্যুরো: হঠাৎ করে অস্থির হয়ে উঠেছে চালের পাইকারি বাজার। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা চালের দাম বেড়েছে কমপক্ষে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। প্রতি কেজি চাল ৪ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। পাইকারি বাজারেই সবচেয়ে সাধারণ মানের সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৬২ টাকা কেজি দরে।
ইরি ও বোরা মৌসুমের ধান ঘরে উঠেছে। ধান-চালের ভরা মৌসুমে কেন বাড়ছে দাম— এমন প্রশ্নে পাইকারি ব্যবসায়ীরা দূষছেন চালের ব্যবসায় যুক্ত দেশের ১৬টি শিল্প গ্রুপ এবং মিল মালিকদের। দেশে শ্রীলংকার মতো খাদ্য ঘাটতি তৈরি হবে— এমন গুজব ছড়িয়ে চালের বাজার অস্থিতিশীল করে তোলা হয়েছে বলে তাদের অভিযোগ।
দেশের উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আসা চাল আড়তে রেখে পাইকারি বিক্রি হয় চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়তলী বাজার ও চাক্তাই চালপট্টিতে। পাহাড়তলী বাজারে গিয়ে আট ধরনের চালের দাম এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহে জিরাশাইল চাল ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি হয়েছে ২৬০০ টাকায়। বৃহস্পতিবার সেই চাল বিক্রি হচ্ছে ৩১০০ টাকায়। প্রতি কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা। মিনিকেট সেদ্ধ ৫০ কেজির বস্তা ২১০০ টাকা থেকে বেড়ে ২৪০০ টাকা হয়েছে। প্রতি কেজিতে বেড়েছে ৬ টাকা। দেশীয় স্বর্ণা সেদ্ধ চালের বস্তা ১৯৫০ টাকা থেকে বেড়ে ২২০০ টাকা হয়েছে। প্রতি কেজিতে বেড়েছে ৫ টাকা। পাইজাম সিদ্ধ ৫০ কেজির প্রতি বস্তা ২০০ টাকা বেড়ে ২৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজিতে ৪ টাকা বেড়েছে দাম।
এছাড়া বেতি আতপ, পাইজাম আতপ, চিনিগুড়া এবং কাটারি আতপও ৫০ কেজির প্রতি বস্তা বেড়েছে ২০০ টাকা করে। গত সপ্তাহে বেতি আতপ ২১০০ টাকায় বিক্রি হলেও এ সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে ২৩০০ টাকায়। পাইজাম আতপ এ সপ্তাহে ২৪০০ টাকা, চিনিগুড়া ৫ হাজার টাকা এবং কাটারি আতপ সাড়ে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এই চার ধরনের চাল প্রতি কেজিতে বেড়েছে ৪ টাকা করে।
ইদুল ফিতরের পর হঠাৎ করে বড় বড় মিলাররা ধান-চাল মজুত শুরু করেছে বলে তথ্য দিয়েছেন পাহাড়তলী বাজারের মেসার্স কুমিল্লা স্টোরের মালিক মো. ফিরোজ শাহ। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘উত্তরবঙ্গের বড় বড় কয়েকটি অটো রাইস মিল মৌ, নবান্ন, রজনীগন্ধা, সান্তাহারের বেলাল ভাই— এরা চাল স্টক (মজুত) করে ফেলেছে। এরপর ১৬টি বড় বড় শিল্প গ্রুপ আছে। তারা চালের ব্যবসায় নেমেছে। দেশে সংগ্রহ করা চাল প্যাকেটজাত করে তারা সরবরাহ করে। তারাও চাল কিনে স্টক করে রেখেছে। এর ফলে সয়াবিন তেলের মতো দিনে দিনে চালের দাম বস্তায় কমপক্ষে ৬০০ টাকা বেড়ে গেছে।’
পাহাড়তলী বণিক সমিতির সহসভাপতি জাফর আলম বলেন, ‘এখন ধান-চালের ভরা মৌসুম। এবার বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষকরা ভালো ধান পেয়েছেন। এখন চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। কারণ শুধু একটাই— গুদামে-গুদামে চাল মজুত হয়ে যাচ্ছে। বাজারে চাল আসছে না। মজুত করার আগে বাজারে গুজব ছড়ানো হয়েছে— শ্রীলঙ্কার মতো খাদ্য ঘাটতি হবে, চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাবে। এটা বলার পর আতঙ্ক ছড়িয়ে গেছে। যেসব শিল্প গ্রুপ বেশি চাল কেনে, তারা কিনে গুদামে মজুত করে রেখেছে। সুযোগ নিয়েছে মিল মালিকরাও। তারাও চাল মজুত করে রেখেছে।’
পাহাড়তলী বাজারের মেসার্স আজমীর স্টোরের মালিক এস এম নিজাম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘কিছু শিল্প গ্রুপ ও মধ্যস্বত্বভোগী মিলে এক বছরের জন্য চাল মজুত করে রেখেছে। এজন্য দাম বাড়ছে। ৫০ কেজির বস্তায় ৩০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে।’
চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে দু’টি প্রস্তাবও দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। গুদামে-গুদামে সরকারিভাবে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার ও প্রয়োজনে অভিযান চালানো এবং ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে সীমিতভাবে চাল আমদানির অনুমতি দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন কয়েকজন ব্যবসায়ী। চাল আমদানির অনুমতি দিলেই মজুতদাররা চাপে পড়ে বাজারে সরবরাহ বাড়িয়ে দেবেন বলে মনে করছেন তারা।
চাল ব্যবসায়ী জাফর আলম বলেন, ‘আমদানি করা চাল সর্বোচ্চ আড়াই হাজার টাকায় ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি করা যাবে। অথচ বাজারে এখন ২৬০০ টাকার নিচে মোটামুটি মানের চালও নেই। আমদানির অনুমতি দিলে প্রতিযোগিতা হবে। সিন্ডিকেট ভেঙে যাবে। গুদাম থেকে চাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে মিল মালিকরা। এছাড়া গুদামে-গুদামে এখনই মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যত অন্ধকার। চালের দাম আরও বাড়বে।’
বাজারে চালের দামের যে ঊর্ধ্বগতি, এর পেছনে দু’টি কারণ দেখছে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন সারাবাংলাকে বলেন, ‘শ্রীলংকার মতো পরিস্থিতি বাংলাদেশে হবে— এরকম বক্তব্যকে অজুহাত বানাচ্ছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। প্রথমে সয়াবিন তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এরপর পেঁয়াজ, রসুন, আটা, ময়দার দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন চালের দাম বাড়ানো হচ্ছে। সব ধরনের পণ্যের দামই বাড়ছে। অথচ দেশে এখন চালের কোনো ঘাটতি নেই। আমদানি পরিস্থিতির ওপর চালের বাজার নির্ভরশীল নয়। এরপর সয়াবিন তেলের দাম সরকারিভাবে বাড়িয়ে ব্যবসায়ীদের জন্য মজুত পরিস্থিতি তৈরি করে এক ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। সেই সুবিধা এখন চাল ব্যবসায়ীরাও নিতে চাচ্ছে।’
‘সমস্যা হচ্ছে, বাজারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ তেমন দৃশ্যমান নয়। বলতে গেলে নিয়ন্ত্রণ নেই। এজন্য যে যেভাবে পারছে, সুবিধা নিতে চাচ্ছে। সরকার যদি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ না করে, মজুতদার সিন্ডিকেটের লাগাম টেনে না ধরে, তাহলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। সবচেয়ে বড় কথা, সাধারণ মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। আমরা বারবার সরকারকে অনুরোধ করছি। কিন্তু সরকার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এটি দুঃখজনক,’— বলেন এস এম নাজের হোসাইন।
সারাবাংলা/আরডি/টিআর