সড়কদ্বীপে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা কাটেনি
২০ মে ২০২২ ২২:২৩
ঢাকা: টানা দেড় বছর বন্ধ থাকার পর রাজধানীর ধোলাইর পাড় সড়কদ্বীপে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপনের বেদিতে কাজ শুরু হয়েছে। তবে সেখানে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন হবে কি না তা নিয়ে ধোঁয়াশা এখনও কাটেনি। স্থানীয়রা বলছেন, মুজিব ভাস্কর্য নয়, এখানে হবে অন্যকিছু। আর দায়িত্বে থাকা সড়ক বিভাগ বলছে, তত্ত্বাবধায়নে থাকা সেনাবাহিনী বিষয়টি জানে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, ওই স্থানে ভাস্কর্যটি স্থাপনের বিষয় নিয়ে যেমন দীর্ঘসূত্রিতার সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি রয়েছে গোপনীয়তা।
সড়ক বিভাগের পরিকল্পনা ছিল, স্বপ্নের পদ্মাসেতুর ওপর দিয়ে রাজধানীতে ঢোকার পথেই চোখে পড়বে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল বা ভাস্কর্য। সেই পরিক্ল্পনার অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য স্থান নির্বাচন করা হয় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের মুখে, অর্থাৎ ঢাকার প্রবেশপথ ধোলাইখাল পাড় সড়কদ্বীপে। নয় কোটি টাকা ব্যয়ে ভাস্কর্যটি নির্মাণে কাজ শুরু করে সড়ক বিভাগ। ভাস্কর্য বসানোর বেদির কাজও প্রায় শেষ করে এনেছিল। বাকি ছিল শুধু ভাস্কর্য স্থাপনের কাজ। টার্গেট ছিল কাজ শেষ করে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরেই ভাস্কর্যটি স্থাপন করার। কেননা ওই সময়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের একটি ভিন্ন তাৎপর্য ছিল। কিন্তু ধর্মভিত্তিক দলগুলোর বাধার কারণে ওই সময় সেই পরিক্ল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়নি। কাজ শেষ না করেই বন্ধ করে দিতে হয়।
জানা যায়, ঢাকা- মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের সময় অনেক অবকাঠামো ভাঙার সঙ্গে ধোলাইখাল পাড় এলাকায় বায়তুশ শারফ জামে মসজিদের বেশ কিছু অংশ ভেঙে ফেলতে হয়। আর তা নিয়েই শুরু হয় আন্দোলন। ওই সময় মসজিদ পুনর্নির্মাণের দাবির সঙ্গে যুক্ত হয় জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য সেখানে স্থাপন না করার। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা মুজিব ভাস্কর্যকে ‘মুর্তি’ এবং তা ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে ওই স্থানে ভাস্কর্য স্থাপন না করার দাবি জানায়।
২০২০ সালের নভেম্বরে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন এবং পরে হেফাজতে ইসলামের ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করেত থাকে। এক পর্যায়ে ইসলামী এই দলগুলোর নেতারা হুমকি দেয়, ভাস্কর্যটি নির্মাণ হলে আরেকটি শাপলা চত্বর দেখবে ঢাকাবাসী। এর সঙ্গে আরও কিছু দল যুক্ত হয়। হুমকি-ধামকি আসে এসব সংগঠনের নেতাদের মুখ থেকেও। এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে ভাস্কর্য নির্মাণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই থেকে টানা দেড় বছর কাজ বন্ধ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বায়তুশ শারাফ মসজিদটি বেশ আগেই সংস্কার করে দিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। পাশাপাশি ওই মসজিদটি থেকে সামান্য দূরত্বে সারা বাংলাদেশে সরকার যে মডেল মজসিদ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে, ঠিক তেমন একটি মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেটা হবে বর্তমান বায়তুশ শারাফ জামে মসজিদের চেয়ে অনেক বড় এবং সেখানে একসঙ্গে অনেক মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। সেইসঙ্গে আধুনিক সব ব্যবস্থাও থাকবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে কথা হয় বায়তুশ শারাফ মসজিদ কমিটির নেতাদের সঙ্গে। মসজিদ কমিটির কোষাধ্যক্ষ এম শাখাওয়াত হোসেন সুজাত সারাবাংলাকে জানান, সড়ক নির্মার্ণের সময় এই মসজিদটি ভাঙা পড়েছিল। এটি পুনর্নিমার্ণের জন্য হেফাজতের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছিল। যদিও সেনাবাহিনী ভাঙা অংশ সংস্কার করে দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘অন্য জায়গায় আরেকটি বড় মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে শুনেছিন। তবে অন্যত্র মসজিদ নির্মাণ হলেও বায়তুশ শারাফ জামে মসজিদ এখানেই থাকবে।’ এ সময় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন সম্পর্কে বলেন, ‘এখানে তো কোনো মুর্তি বসানো হবে না। এখানে অন্য কিছু বসানো হবে শুনেছি।’
ভাস্কর্য নির্মাণ প্রসঙ্গে সড়ক বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘ওই মসজিদটি কারও জমিতে বা জায়গা কিনে নির্মাণ করা হয়নি। এটি সরকারি রাস্তার ওপরে নির্মাণ করা হয়েছে। তাই এটির বৈধতা ছিল না। এখন মসজিদটি স্থানান্তর করা হচ্ছে।’ তবে ভার্স্কয বসানো হবে কি না সে প্রশ্নের জবাব দেননি।
এ বিষয়ে কথা হয় ঢাকা -৪ আসনের সংসদ সদস্য আবু হোসেন বাবলার সঙ্গে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে অসংখ্যবার মসজিদ কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেছি। জানানো হয়েছে, তাদের জন্য অত্যাধুনিক এবং বড় পরিসরে মসজিদ নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে।’
এদিকে যেখানে ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হবে সেখানে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ভাস্কর্য রাখার বেদিটি আগের মতোই টিনের বেরিকেড দিয়ে ঘেরা। বৃত্তাকার জায়গাটির কেন্দ্রে মূল ভাস্কর্য বসানোর জন্য বেদি নির্মাণ কাজ আগেই শেষ হয়েছে। দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ থাকায় ময়লা আবর্জনায় একাকার বেদির চারপাশ। বেরিকেড দেওয়া টিনের ফাঁকা অংশ দিয়ে দেখা গেল ছোট খাটো কাজ শুরু হয়েছে।
আর ভেতরে গিয়ে দেখা গেল, বেদির এক পাশে পাথর খচিত নেমপ্লেট বসানোর কাজ করছেন কিছু শ্রমিক। কিন্তু তারা জানেন না বেদিতে কী বসবে। তাদের নেমপ্লেট বসানোর নকশা দেওয়া হয়েছে- সেটাই তারা করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চীন থেকে তৈরি হয়ে ঢাকায় এসে পৌঁছেছে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাস্কর্য। কিন্তু সেটি পূর্ব নির্ধারিত স্থানেই স্থাপন করা হবে, না কি অন্য কোথাও— সেসবের কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।
বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট অনেক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে সারাবাংলা। কেউ-ই পরিষ্কার করে বলেননি ওই স্থানে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন হবে কি না। এমনকি সেখানে অন্য কোনো ভাস্কর্য বসানো হবে কি না সে বিষয়েও কোনো ঘোষণা নেই। ভাস্কর্যটি নির্মাণের দায়িত্ব ছিলো সড়ক ও জনপথ বিভাগের ওপর। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিষয়টিকে ‘স্পর্শকাতর’ উল্লেখ করে এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালে ধোলাইখাল পাড়ের সড়কদ্বীপে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দিয়ে মাঠে নামে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো। এমনকি ওই সময় কুষ্টিয়া শহরে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধুর একটি ভাস্কর্য ভাঙচুরও করা হয়। ওই ঘটনায় স্থানীয় একটি মাদরাসার কয়েকজন ছাত্র-শিক্ষককে গ্রেফতারও করা হয়েছিল।
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম