প্রকল্পে নিয়োগপ্রাপ্তদের চাকরি রাজস্বখাতে স্থানান্তর নয়
২১ মে ২০২২ ১০:৩৬
ঢাকা: কোন সংবিধিবদ্ধ বিধান না থাকলে প্রকল্পের অধীনে চুক্তিভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারী/কর্মকর্তাদের চাকরি রাজস্বখাতে স্থানান্তর (আত্মীকরণ) না করতে বলেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এক রায়ের পর্যবেক্ষণে এমন মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
‘কামাল হোসেন এবং অন্যান্য বনাম স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়’ মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আপিল বিভাগ বলেছেন, এটি এখন মীমাংসিত বিষয় যে, কোন সংবিধিবদ্ধ বিধান না থাকলে আদালত কোনো প্রকল্পে চুক্তিভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারী/কর্মকর্তাদের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের (আত্মীকরণ) আদেশ দিতে পারে না।
ওই রায়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের (সিএইচসিপি) আবেদন ‘কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট আইন, ২০১৮’ এর বিধানের আলোকে বিবেচনা করতে সরকারের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের সমন্বয়ে গঠিত আপিল বেঞ্চের দেওয়া রায়ে এই পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়। ১৮ পৃষ্ঠার ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।
এর আগে চলতি বছরের ৬ মার্চ রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন নিষ্পত্তি করে হাইকোর্টের রায় ও আদেশ সংশোধন করে এ রায় দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে রাষ্ট্রপক্ষের দায়ের করা ৬২টি লিভ টু আপিলের শুনানি শেষে আদালত এ রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে উল্লেখ করা হয়, রিটকারীদের আইনজীবীরা আদালতে বলেন, মো. কামাল হোসেন এবং অন্যান্যরা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে নিয়মিত বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়ার পর কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) হিসেবে ‘রিভাইটালাইজেশন অব কমিউনিটি হেলথ কেয়ার ইনিশিয়েটিভস ইন বাংলাদেশ (আরসিএইচসিআইবি)’ নামের একটি উন্নয়ন প্রকল্পে যোগদান করেছিলেন। এরপর আরসিএইচসিআইবি প্রকল্পের পরিচালক ২০১২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি প্রকল্পের কর্মচারীদের রাজস্ব বাজেটের আওতায় নেওয়ার প্রস্তাবসহ একটি চিঠি পাঠান, কিন্তু পরে সে বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
পরবর্তীতে হাইকোর্টে অর্ধ শতাধিক রিট দায়ের করা হয়। এসব রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের বিভিন্ন বেঞ্চ কর্তৃপক্ষকে (সরকার) রিটকারীদের চাকরি রাজস্ব বাজেটের অধীনে নিয়মিতকরণ বা আত্মীকরণ করতে নির্দেশ দেন। রিটকারীদের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকা শর্তে আইন অনুযায়ী স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সেবা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ধারাবাহিকতা দিয়ে তাদের চাকরি রাজস্বখাতে স্থানান্তর করতে বলেন হাইকোর্ট।
২০১৭ সাল এবং এর পরবর্তীতে সময়ে এসব রায় প্রদান করে হাইকোর্ট। এসব রায়ে আদালত, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের অধীনে সেবার মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চুক্তিভিত্তিতে নিয়োগকৃত রিটকারীদের (কর্মচারীদের) চাকরি রাজস্বখাতে স্থানান্তরের (নিয়মিতকরণ) নির্দেশ দেন।
এরপর হাইকোর্ট বিভাগের রায় এবং আদেশে সংক্ষুব্ধ হয়ে রাষ্ট্রপক্ষ (সরকার) আপিল বিভাগে আবেদন করে। আপিল বিভাগে মামলাগুলোর শুনানির সময় অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতকে জানান, সরকার ইতোমধ্যে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট আইন, ২০১৮’ প্রণয়ন করেছে। এবং উক্ত আইনের মাধ্যমে আরসিএইচসিআইবি প্রকল্পের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সেবা ইতোমধ্যে ট্রাস্টের অধীনে রাখা হয়েছে এবং সেই হিসাবে রিট আবেদনকারীরা এখন উক্ত ট্রাস্টের কর্মকর্তা ও কর্মচারী।
আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে ‘বাংলাদেশে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার ইনিশিয়েটিভস রিভাইটালাইজেশন অফ কমিউনিটি হেলথ কেয়ার ইনিশিয়েটিভস’ এবং ‘কমিউনিটি বেসড হেলথ কেয়ার’ প্রকল্পের কর্মকর্তা ও কর্মচারী হিসেবে যোগদানের পর যারা ২০১৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কাজ করেছেন, তারা এখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রাস্টের কর্মকর্তা ও কর্মচারী।
চাকরির শর্তাবলীর ক্ষেত্রে রায়ে বলা হয়েছে, নিয়োগকৃতদের (সিএইচসিপি) বেতন, পদোন্নতি এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা (সার্ভিস বেনিফিট) ট্রাস্ট আইন, ২০১৮ এর অধীনে প্রণীত প্রবিধানমালা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে।
এর আগে গত ৬ মার্চ সিএইচসিপিদের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরে হাইকোর্টের রায় সংশোধন করে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল নিষ্পত্তি করে দেন আপিল বিভাগ।
রায়ে সিএইচসিপিদের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরে হাইকোর্টের রায় সংশোধন করে তাদের চাকরি `কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট আইন, ২০১৮` এর আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এ সংক্রান্ত রাষ্ট্রপক্ষের ৬২টি আপিলের ওপর রায়ের জন্য নির্ধারিত দিনে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ এই রায় দেন।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেলে এ এম আমিন উদ্দিন, তার সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সমরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস ও বিশ্বজিৎ দেবনাথ। রিটকারীদের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মইনুল হোসেন, রোকন উদ্দিন মাহমুদ, প্রবীর নিয়োগী ও মো. খুরশীদ আলম খান।
জানা যায়, ২০১৭ সালে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তর চেয়ে সহিদুল ইসলাম, কামাল সরকার, জাহিদুল ইসলামসহ ১০ জন সিএইচসিপি হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। শুনানি শেষে একই বছরের ২২ মার্চ বিচারপতি আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাসের হাইকোর্ট বেঞ্চ আবেদনকারী ১০ জন সিএইচসিপির চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের নির্দেশ দিয়ে রায় ঘোষণা করেন। পরে একই বছরের সেপ্টেম্বরে ১০ পৃষ্ঠার ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়।
এরপর একইভাবে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে হাইকোর্টে ৭৬টি রিট দায়ের করেন দেশের বিভিন্ন জেলার কয়েক হাজার সিএইচসিপি। এর মধ্যে ৭৪টি রিটে সিএইচসিপিদের পক্ষে রায় হয় বলে জানা যায়। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপক্ষ এসব রায়ের মধ্যে থেকে ৬২টির বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করে। পরে মামলাগুলো চেম্বার আদালত হয়ে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে আসে।
এরপরে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের ১ নম্বর বেঞ্চে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের ওপর চূড়ান্ত শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ৬ মার্চ রায় প্রদানের নির্ধারিত দিনে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন নিষ্পত্তি করে হাইকোর্টের রায় সংশোধন করে দেন আপিল বিভাগ।
সারাবাংলা/কেআইএফ/একে
আপিল বিভাগ প্রকল্পের অধীনে নিয়োগপ্রাপ্ত রাজস্বখাত সুপ্রিম কোর্ট