পোশাকের জন্য তরুণীকে হেনস্থা, ‘মূল হোতা’ আরেক নারী
২২ মে ২০২২ ১৫:১৩
ঢাকা: নরসিংদী রেল স্টেশনে স্টেশনে ‘অশ্লীল পোশাক’ পরার অভিযোগ তুলে ভুক্তভোগী তরুণী ও তার পর্যটক সঙ্গীদের ওপর আধা ঘণ্টার তাণ্ডব চালানো হয়। এ ঘটনার মূল হোতা এক নারী বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। তবে ওই নারীর বিস্তারিত পরিচয় এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ওই নারী ঘটনার দিন ভোর সাড়ে ৫টার দিকে নরসিংদী রেল স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম ওই তরুণীকে জেরা করা শুরু করেন এরপর চেঁচামেঁচি করে লোকজন জড়ো করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে তোলেন।
সারাবাংলার অনুসন্ধান বলছে- বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ওই ‘পর্যটক’ তরুণী ঢাকা থেকে আগের দিনে নরসিংদী বেড়াতে যান। ওই তরুণীর সঙ্গে তার এক ফ্যাশন ডিজাইনার পর্যটক বন্ধুও ছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সংক্ষিপ্ত সফরে নরসিংদীর পর্যটন স্থানগুলো ঘুরে দেখা। এ উপলক্ষে তারা নরসিংদীর স্থানীয় এক বন্ধুর সহযোগিতাও নেন। নরসিংদী ভ্রমণ শেষে দিনের দিন তারা ঢাকায় ফিরতে না পারায় পরদিন ভোরের ট্রেনের অপেক্ষায় ছিলেন না। ঢাকায় ফিরতে না পারায় তারা নরসিংদীর স্থানীয় ওই বন্ধুর বাসায় ছিলেন।
পররদিন ভোরের ট্রেনে নরসিংদী থেকে ঢাকায় আসার জন্য তারা রেল স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় তরুণীর ফ্যাশন ডিজাইনার বন্ধু তাকে স্টেশনে রেখে ওয়াশরুমে যান। ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসে তিনি দেখেন, ছবির এই নারী তার বন্ধুকে ‘অশ্লীল পোশাকের’ প্রসঙ্গ তুলে গালিগালাজ করছেন। এ সময় তাকেও গালমন্দ করা হয়।
ওই সময়ের ঘটনা বর্ণনা করে ভুক্তভোগীদের একজন নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘ওই নারীও আগে থেকেই স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন। তিনি সম্ভবত এলাকার প্রভাবশালীদের কেউ হবেন। ওই নারী এসেই আমার বন্ধুকে বলেন, ‘তুই এই পোশাক পরেছিস কেন? তোর বাবা-মা কোনো শিক্ষা দেয়নি? তোর চরিত্র খারাপ, তুই জাহান্নামে যাবি, তুই জাহান্নামি।’
এ সময় হাত বাড়িয়ে ভুক্তভোগী তরুণীর পোশাক খুলে নেওয়ার চেষ্টা করেন ওই নারী। এর কিছুক্ষণ পরই সেখানে আরেক নারী আসেন। ওই নারীও তেড়ে যান ওই তরুণীর দিকে।
ওই ভিকটিম সারাবাংলাকে জানান, ঘটনার সময় দুই নারী ছিল। এর কিছুক্ষণ পর যোগ দেয় আরও দুইজন পুরুষ। তারাও গালিগালাজ শুরু করে, পাশাপাশি আমাদের গায়েও হাত দেয়। এ সময় চিমটি-খামচি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম করা হয়।’
ঘটনার পরপরই নরসিংদীর স্থানীয় বন্ধুটিকে ভুক্তভোগীরা বিষয়টি জানান। খবর পেয়ে ওই বন্ধু ঘটনাস্থলে এলে তিনিও তোপের মুখে পড়েন। পরে ভুক্তভোগীরা সাহায্যের জন্য ৯৯৯ এ কল দেন।
ওই ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমাদের ওপর আধাঘণ্টার তাণ্ডব চালানো হয়। কেউ এসে গালিগালাজ করা শুরু করে, কেউ এসে আমাদের পোশাক খুলে নিতে চায়। কেউ কিল-ঘুষিও মারে। বেশি লোকজন জড়ো হওয়ার পর প্রথম ওই নারী ঘটনাস্থল থেকে সটকে পড়েন।’
তবে পরে আসা অপর নারী তখনও ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। তিনি স্টেশন মাস্টারের রুম পর্যন্ত ওই তরুণীর দিকে তেড়ে যান। এমনকি স্টেশন মাস্টারের রুমে যাওয়ার সময়ও ওই তরুণীর পোশাক খুলে নিতে চান অপর নারী। ওই সময় বলা হয়- ‘ওদের কাপড় খুলে রেখে দিন। যেন এইরকম কাপড় কোনোদিন না পরে। ওদের লজ্জা দিয়ে দাও।’
এমনকি স্টেশন মাস্টারের রুমের কলাপসিবল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ওই নারী গালিগালাজ করে যাচ্ছিলেন।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে অপর ভুক্তভোগী বলেন, ‘স্টেশনে আমাদের সঙ্গে তর্কে জড়ানো ওই নারী খুব আক্রমণাত্মক ছিলেন। তিনি আমাদের কোনো কথাই শুনছিলেন না। একপর্যায়ে আমাদের মারার জন্য স্টেশন থেকে লোহার পাইপ নিয়ে তেড়ে আসেন।’
ভুক্তভোগীদের একজন আরও বলেন, ‘আমরা কোনো অশ্লীল পোশাক পরিনি। আমার বন্ধু জিন্স ও টপস পরেছিল। এই সময় তার গলায় ওড়নাও পেঁচানো ছিল। এরপরও ওই নারী ঝগড়া বাঁধান। এমনকি আমরা ওখান থেকে বের হতে চাইলেও ওই নারী ও জড়ো হওয়া লোকজনরা আমাদের বের হতে দিচ্ছিল না।’
এদিকে ওই ঘটনার পরপরই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। তিনি ট্রমায় আক্রান্ত। তার পরিবারও সামাজিকভাবে চাপের মধ্যে রয়েছেন। তাই আইনি বাড়তি ঝামেলা এড়াতে ঘটনার বিষয়ে কোনো মামলা করতে চাননি। তবে ভুক্তভোগীরা চান এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক সাজা হোক। ওই ঘটনায় রেলওয়ে পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছে। মামলায় এরইমধ্যে একজনকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
তরুণীকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় হেনন্তাকারী ইসমাইল হোসেন আটক করেছে পুলিশ।
ভৈরব রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফেরদৌস আহমেদ বিশ্বাস জানান, শুক্রবার রাতে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশন এলাকা থেকে ইসমাইলকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। পরে তাকে ভৈরব থানায় হস্তান্তর করা হয়।
ওসি বলেন, ‘আমরা আরও কয়েকজনকে শনাক্ত করতে পেরেছি। তাদের ধরতে পুলিশ কাজ করছে। আশা করছি সবাইকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।’
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে স্টেশন মাস্টার এ টি এম মুছা জানান, রেলস্টেশনে তারা অপেক্ষা করছিলেন। তাদের পরনে ছিল আধুনিক পোশাক। তা দেখে এক নারী বাজে ও নোংরা মন্তব্য করেন। একপর্যায়ে ওই নারী ইচ্ছা করেই তাদের সঙ্গে ঝগড়ায় জড়ান। এ সময় রেলস্টেশনের কিছু বখাটে লোক ছুটে এসে তরুণ-তরুণীদের এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করেন এবং তরুণীকে হেনস্থা করে।
নরাসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাহেব আলী পাঠান বলেন, ‘পুলিশ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। রেলওয়ে পুলিশ পুরো ঘটনার তদন্ত করছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজনকে এরইমধ্যে শনাক্ত করা হয়েছে। আশা করি ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবাইকে গ্রেফতার করা হবে।’
সারাবাংলা/একে