ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে আতঙ্কের নাম সেলফি পরিবহন
২৬ মে ২০২২ ১০:৩৮
মানিকগঞ্জ: সম্প্রতি ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বেড়েছে দুর্ঘটনা। এতে করে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ, নিঃস্ব হচ্ছে অনেক পরিবার। আর এসব দুর্ঘটনা মধ্যে বেশিরভাগই সেলফি পরিবহনের সঙ্গে ঘটছে। শুধুমাত্র চলতি মাসের এখন পর্যন্ত বেপরোয়া গতির কারণে অন্তত ৫টি দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে এ পরিবহনটি। এসব ঘটনায় চালকসহ নিহত হয়েছেন দু’জন এবং অন্তত ৭০ জনের অধিক যাত্রী আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। ফলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ মহাসড়কে সেলফি পরিবহন এখন আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে সেলফি পরিবহন যেন সড়কের রাজা হয়ে উঠেছে। সড়কে অন্য পরিবহন ও পথচারীকে তোয়াক্কা না করে বেপরোয়া গতিতে বাস চালান সেলফি পরিবহনের চালকরা। এ কারণে রাস্তায় গাড়ি চালাতে ভয় পান মোটরসাইলকেল আরোহীরাও। সম্প্রতি ফেলফির বেপরোয়া গতিতে একটি সুখী পরিবার তছনছ হয়ে গেছে। ওই পরিবারের একমাত্র উপার্জন সক্ষম ব্যক্তি ছিলেন গনেশ চন্দ্র শীল। ঘটনার দিন মোটরসাইকেল নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে মানিকগঞ্জের মুলজান এলাকায় বেপরোয়া গতির সেলফি বাসের আঘাতে নিহত হন তিনি। তার একমাত্র ছেলে বিশাল শীল পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী এবং মেয়ে পুর্ণী শীল এইচএসসির পরীক্ষার্থী। বাবাকে হারিয়ে এখন লেখাপড়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে তাদের।
নিহত গরেশ শীলের ছোট ভাই কার্তিক শীল বলেন, ‘আমারা দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন বড়। ছোট একটা ব্যবসা করতেন ভাই। মোটামুটি ভালই চলছি সংসার। কিন্ত ফেলফি বাসটি আমার ভাইয়ের জীবন কেড়ে নেওয়ায় তার ছোট ছোট দুই ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এখন তাদের লেখা পড়ার খরচ এবং সংসার কিভাবে চলবে তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছি আমরা। ফেলফি বাস আমার ভাইয়ের পরিবারকে তছনছ করে দিল। কিন্ত কোনো আর্থিক সহযোগিতা বা ক্ষতিপূরণ পেলাম না।’
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, শুধু চলতি মাসেই অনেকগুলো দুর্ঘটনা ঘটনা ঘটিয়েছে সেলফি পরিবহন। গত ৪ মে ঢাকার ধামরাইয়ের বাথুলী কেবিসি কারখানার পশ্চিম পাশে পাল্লা দিয়ে পাস চালাতে গিয়ে সেলফি পরিবহনের সঙ্গে তরমুজ রোঝাই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে বাস চালাক মিজান নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় কমপক্ষে ২০ জন যাত্রী আহত হয়েছেন। গত ৮ মে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জের ভাটবাউর এলাকায় সেলফি পরিবহনের সঙ্গে অন্য একটি দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন। এতে আহত হয়েছেন অন্তত ২০ জন যাত্রী। গত ১১ মে মহাসড়কে ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় ঢাকামুখী সেলফি পরিবহন ও সেবা গ্রিন লাইন পরিবহনের বাসের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় ৩০ যাত্রী মারাত্মক আহত হন। সম্প্রতি মুন্নু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গেইটের সামনে ক্রসব্রিজ এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে যায় সেলফি পরিবহনের বাস। এতে বেশ কয়েকজন যাত্রী আহত হন। গত রোববার বিকালে মহাসড়কের বারবাড়িয়া এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে সেলফি পরিবহনের একটি বাস। এ ঘটনায় বেশ কয়েকজন যাত্রী আহত হন। এছাড়া এর আগে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যতগুলো দুর্ঘটনা ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে সেলফি পরিবহনের বাসই বেশি।
এদিকে সেলফি পরিবহনের বাস নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে গত কয়েক দিন ধরে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সমালোচনাকারীরা বেশিরভাগই সেলফি পরিবহন বন্ধের পক্ষে তাদের মতামত দিয়েছেন।
কলেজ শিক্ষক সাইফুদ্দিন আহম্মেদ তার এক পোস্টে বলেছেন, ‘ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে চলাচলকারী সেলফি পরিবহনকে ঘাতক পরিবহন বললেও অত্যুক্তি হবে না। এই পরিবহনের রুটপারমিট স্থগিত করে সবগুলো গাড়ির ফিটনেস, চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করা জরুরি। জরুরিভিত্তিতে তদন্ত করা দরকার কারা চালায় এ গাড়ি। যতদিন এসব না করা হবে ততদিন যাত্রীদের উচিত এই পরিবহন বয়কট করা।’ এই পরিবহনকে নিয়ে ফেসবুকে অনেক মানুষ এমন সমালোচনা করছেন।
জেলার সামাজিক আন্দোলনের নেতা বিমল রায় বলেন, ‘এ রুটে তো আরও অনেক পরিবহরের বাস নিয়মিত চলাচল করছে। তবে প্রতিনিয়ত কেন সেলফি পরিবহানের বাস দুর্ঘটনা ঘটায়? তাদের চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কি না, তাদের সঠিক ট্রেনিং আছে কি না, তারা রোডে আইন মানে কি না?— এগুলো নিয়মিত মনিটরিং করলে এতো দুর্ঘটনা ঘটতো না।’
এই অভিযোগের বিষয়ে ফেলফি পরিবহনের পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স রয়েছে। আর নিয়ন্ত্রিত গতির মধ্যে চালকদের গাড়ি চালাতে বলা হয়েছে।’
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক (ডিসি) মুহাম্মদ আবদুল লতিফ বলেন, সম্প্রতি সেলফি পরিবহনের বাসের কারণে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। ইতোমধ্যে এই পরিবহনের কর্তৃপক্ষ এবং পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সভা করা হয়েছে। বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালালে এ পরিবহনের রুট পরমিট বাতিল করা হবে।’
একইসঙ্গে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটি) মাধ্যমে এ পরিবহানের চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হবে বলেও জানিয়েছেন ডিসি মুহাম্মদ আবদুল লতিফ।
সারাবাংলা/এনএস