Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ক্ষতিপূরণে অনিয়ম, পুনর্বাসন না করেই জমি অধিগ্রহণের অভিযোগ

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২৭ মে ২০২২ ১৪:৫৮

ঢাকা: পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের উদ্দেশ্যে ভূমি অধিগ্রহণ প্রায় শেষের পথে। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ না দিয়ে এবং পুনর্বাসন নিশ্চিত না করেই তাদের বেশিরভাগের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ফলে তারা এখন পেশা ও আবাসন সংকটের মুখোমুখি।

এদিকে, পরিবেশ অধিকারকর্মীরা বলছেন, তিন ফসলি এই জমিতে বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হলে সেটি স্থানীয় প্রকৃতি ও প্রতিবেশের জন্য হুমকি ডেকে আনবে। তাই সরকারের কাছে বিকল্প এক ফসলি জায়গায় অথবা পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির দাবি জানিয়েছে পরিবেশবাদীরা।

বিজ্ঞাপন

বৃহস্পতিবার (২৬ মে) জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে ‘নির্মাণাধীন আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ প্রকল্প: একটি আর্থসামাজিক সমীক্ষা’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত স্থানীয় বাসিন্দা ফরিদ তালুকদার জানান, বাবা ও চাচার পরিবার মিলিয়ে তারা ৪০ একর জমির মালিক ছিলেন। পুরোটাই তিন ফসলি জমি। ফরিদ উদ্দীনের অভিযোগ, সরকারের তরফ থেকে জমির দাম বাবদ দেড় গুণ টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও নানা জটিলতায় সেটি পাচ্ছেন না। দালালদের তৎপরতা ও মামলার কারণে সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্য টাকা যেমন পাচ্ছেন না, তেমনি তাদেরকে বিকল্প আবাসস্থলের ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা থাকলেও মিলছে না সেই আবাসনও। কৃষি একমাত্র জীবিকা হওয়ায় এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তাদের জীবন।

এদিকে, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে গিয়ে চম্পাপুর ইউনিয়নের জেলে সম্প্রদায়কে নদীর তীর থেকে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। জেলে সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা বলছেন, নদীর পাশে না থাকলে তাদের পক্ষে পেশাই টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। তাই তিন ফসলি জমি রক্ষার পাশাপাশি ও স্থানীয় জেলে সম্প্রদায়ের পেশা রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানান স্থানীয়রা।

বিজ্ঞাপন

সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওমেটিক্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আশিকুর রহমান। প্রকল্প এলাকার ১০০ জন বাসিন্দার সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা এই সংক্ষিপ্ত সমীক্ষায় স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন ও জীবিকার স্থানীয় পরিবেশের ওপর প্রভাবও খুঁজে দেখা হয়েছে।

সমীক্ষা প্রতিবেদন বলছেন, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত প্রকল্প এলাকায় কোনো উল্লেখযোগ্য স্থাপনা গড়ে ওঠেনি। এপ্রিল থেকে বালু ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে। ক্ষতিরপূরণ হিসেবে সর্বনিম্ন ৬০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৩৭ লাখ টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু জরিপে অংশ নেওয়া ৮৪ শতাংশ বাসিন্দাই জানিয়েছেন, এটি পর্যাপ্ত নয়। শুধু তাই নয়, অধিকাংশের দাবি— স্থানীয় দালালচক্র টাকার বিনিমিয়ে অবৈধ উপায়ে ক্ষতিপূরণের টাকা বাড়ানোর প্রলোভন দেখাচ্ছে। দালালদের এখন পর্যন্ত সর্বনিম্ন ৪৪ হাজার ৮০০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয়দের দাবি, আশপাশের জলাশয় অধিগ্রহণের ফলে এখানকার জলজীবনেও ব্যপক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা আরও পরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে। পানি গতিপথ ও জলজ উপাদানে পরিবর্তন হলে আন্ধারমানিকের ইলিশ প্রজননকেন্দ্রও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে মনে করছেন তারা।

সমীক্ষায় যাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়ছে, তারা প্রত্যেকেই বলছেন, প্রকল্পের ক্ষতিকর প্রভাবে মাটির গুণাগুন কমে যাচ্ছে। ফসল উৎপাদনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এখানকার উৎপাদিত তরমুজ, পালং শাকসহ অনেক সবজিতেই পচন ধরা ও কালো হয়ে যাওয়ার সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

অন্যদিকে, স্থাপনা নির্মাণের কারণে মাটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা জানিয়েছেন সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৮২ শতাংশ মানুষ। ৭৯ শতাংশ মানুষ বায়ু দূষণের আশঙ্কা জানিয়েছেন। জরিপে অংশ নেওয়া সবাই বাতাসে ধোঁয়া ও কার্বন গ্যাস বাড়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন। ৭৮ শতাংশ জানিয়েছেন তাপমাত্রা বৃদ্ধির আশঙ্কার কথা। এছাড়া ৯৩ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বলেছেন উপকূলীয় অঞ্চলের আবহাওয়া ও জলবায়ু সম্পর্কে উদ্বেগের কথা। ১০০ শতাংশ মানুষই ইলিশের উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন। ৭০ শতাংশ মানুষ জীবিকা হারানোর ফলে জীবনমান কমে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এছাড়াও ৬০ শতাংশ মানুষ সামাজিক নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন, ৭৯ শতাংশ স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের আশঙ্কা জানিয়েছেন এবং ৬৯ শতাংশ শব্দ দূষণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

সমীক্ষা উপস্থাপনের সময় আশিকুর রহমান বলেন, পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ প্রকল্প প্রথমে ১৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা নিলেও সরকার গত বছর তা বাতিল করে এলএনজি অথবা নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেয়। সম্প্রতি সিদ্ধান্ত হয়, ২৪০০ মেগাওয়াটের এলএনজিভিত্তিক প্ল্যান্ট নির্মাণ করা হবে। প্রকল্প নির্মাণের সময় ৩ ফসলি কৃষিজমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণে ব্যাপক অনিয়মের পাশাপাশি ২৯ কিলোমিটার পানিপথ ভরাট করা হবে।

এই প্রকল্পসহ আশপাশের শিল্পায়ন কলাপাড়া এলাকার নদী, পানি ও মৎস্য সম্পদসহ সাধারণ মানুষের জন্য যেসব নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তা স্থানীয় জনসাধারণের মতামতের ভিত্তিতে আরও অনুসন্ধান ও পর্যালোচনার জন্য এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জানান আশিকুর রহমান।

বাপা’র নির্বাহী সদস্য এবং অর্থ, বাণিজ্য ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক কমিটির সদস্য সচিব এম এস সিদ্দিকী’র সভাপতিত্বে এবং বাপা‘র সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বক্তব্য রাখেন বাপা’র যুগ্ম সম্পাদক ও বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনের সমন্বয়ক মিহির বিশ্বাস, বাপা’র যুগ্ম সম্পাদক ও স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জমান মজুমদার এবং আশুগঞ্জ নির্মাণাধীন প্রকল্প এলাকার বাসিন্দা ফরিদুল ইসলাম ফরিদ। এছাড়াও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাপা’র যুগ্ম সম্পাদক হুমায়ন কবির সুমন, বাপা’র নির্বাহী সদস্য ও নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইবনুল সাঈদ রানা এবং ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের গবেষণা ব্যবস্থাপক রিয়াসাত নূর।

সভাপতির বক্তব্যে এম এস সিদ্দিকী বলেন, বাপা কখনই উন্নয়নের বিপক্ষে নয়। কিন্তু যে উন্নয়ন দেশের কৃষি, পরিবেশ, নদী, জীববৈচিত্র্য ও প্রাণিসম্পদ ধ্বংস করে, সে উন্নয়ন আমরা চাই না। তিনি সম্ভাব্য অভিঘাতগুলো সঠিকভাবে পর্যালোচনা করে দেশের সব কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক বিদুৎ প্রকল্পগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

দেশের বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর কারণে যেন দেশের সামগ্রিক পরিবেশ ও অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব না পড়ে, সেদিকে সরকারের সতর্ক দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানান বাপা’র সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল। তিনি বলেন, কয়লা ও জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো যেন এসডিজি বাস্তবায়নে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সেদিকেও সরকারের সজাগ দৃষ্টি থাকতে হবে। কলাপাড়ায় চলমান শিল্পায়ন দেশের মৎস্য সম্পদ, বিশেষভাবে ইলিশ এবং তরমুজ উৎপাদনের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে উল্লেখ করে তিনি ওই অঞ্চলে টেকসই উন্নয়নকল্পে যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের আহ্বান জানান।

সংবাদ সম্মেলনে আশপাশের মানুষের জীবিকা, বাস্তুসংস্থান এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের প্রাক্কালে যথাযথ ও স্বচ্ছ প্রভাব নিরূপণের দাবি জানানো হয় সংবাদ সম্মেলন থেকে।

সারাবাংলা/আরএফ/টিআর

আশুগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প ক্ষতিপূরণে অনিয়ম জমি অধিগ্রহণ পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা পুনর্বাসন না করার অভিযোগ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর