ছাড় নয়, প্রতিরোধ কর্মসূচিতে বিএনপিকে পাল্টা জবাবের নির্দেশ
৩১ মে ২০২২ ২২:৫১
ঢাকা: টানা মেয়াদে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপিকে রাজনীতির মাঠে কোনো ধরনের ছাড় না দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপিকে কোণঠাসা অবস্থা থেকে মাঠের রাজনীতিতে ছাড় দেওয়ার ইঙ্গিত দিলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতির কৌশলগত কারণে রাজপথের আন্দোলনে পাল্টা প্রতিরোধ কর্মসূচিতে প্রতিরোধে করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে দলের পক্ষ থেকে।
মঙ্গলবার (৩১ মে) বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগসহ সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে যৌথ সভার বৈঠকে এমন আলোচনা হয়েছে বলে বৈঠক সূত্র জানিয়েছে। সূত্র আরও বলছে, একইসঙ্গে বিভাগীয় সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সারাদেশে সংশ্লিষ্ট নেতাদেরও এ বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করছেন, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি ফের নেপথ্যের শক্তির ইশারায় মাঠে অরাজকতা করার ‘ষড়যন্ত্র’ করছে। তাদের রাজপথে ছাড় দিলে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের মনোবল দুর্বল হতে থাকবে। কারণ বিএনপি আবারও ঘরের ভেতর থেকে রাজপথে বেরিয়ে বেরিয়ে আতঙ্ক ছড়াতে চায়। তারা পদ্মা বহুমুখী সেতুর উদ্বোধনের আগে দেশের মানুষের মনোভাব অন্যদিকে ঘুরাতে চায়। তারা আওয়ামী লীগের ‘সরলতা’কে দুর্বলতা ভাবতে শুরু করে দিয়েছে। তারা বঙ্গবন্ধুকন্যা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে পরোক্ষভাবে হত্যা করার হুমকি-ধমকি দিচ্ছে, যা আওয়ামী লীগ নেতাদের পক্ষে কোনোভাবেই বরদাশত করা সম্ভব নয়।
বৈঠকে উপস্থিত আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, বিএনপি নেতারা ছাত্রদলকে দিয়ে ক্যাম্পাসগুলোতে মাঠে অরাজকতা তৈরির পাঁয়তারা চালাচ্ছে। এ কারণেই উসকানিমূলক স্লোগান দেওয়া হচ্ছে। তা না হলে ‘পঁচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’ স্লোগান দেওয়ার ধৃষ্ঠতা তারা পেত না।
এদিকে, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকির প্রতিবাদে আগামী ৪ জুন শনিবার সারাদেশে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। একই ধারাবাহিকতায় ৭ বা ৮ জুন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ কর্মসূচি পালন করবে। তেজগাঁও সাতরাস্তা মোড় হয়ে কাওরান বাজারের সোনারগাঁও হোটেল হয়ে পান্থপথ ধরে ধানমন্ডি-৩২ নম্বরে গিয়ে কর্মসূচি শেষ হবে। এ কর্মসূচি সামনে রেখে মঙ্গলবার (৩১ মে) বিকেলে ধানমন্ডির প্রিয়াংকা কমিউনিটি সেন্টারে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। বর্ধিত সভায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়ে কর্মসূচি সফল করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। একইভাবে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করবে ১০ জুন। এসব কর্মসূচির মাধ্যমে রাজধানীতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রাজপথে শক্তির মহড়া দেখাতে চায় বলে জানান দলের নেতারা।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এখন থেকে ঢাকাসহ সারাদেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের আন্দোলনে নজরদারি রাখা হবে। সেই প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় বিএনপিকে সভা-সমাবেশ করতে দেওয়ার তথা মাঠের রাজনীতি করার ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হলেও এখন সেই অবস্থান থেকে সরে এসে কৌশল পাল্টাচ্ছে আওয়ামী লীগ। নেতারা মনে করছেন, বিএনপিকে ‘বসার সুযোগ দিলে শুইতে চায়’। বিএনপির গত কয়েক দিনের দলীয় কর্মসূচিতে ‘পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া’র বিষয়টি প্রকাশ পেতে শুরু করেছে বলেও মনে করছে আওয়ামী লীগ।
মঙ্গলবারের যৌথ সভায় উপস্থিত নেতারা বলেন, বিএনপি একটি অসুস্থ রাজনৈতিক দল। বিএনপিকে মাঠে ছাড় দিলে দেশের বিদ্যমান শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে উঠবে। গত কয়েক দিনের কর্মসূচিতে তারই প্রমাণ পাওয়া যায়। কারণ বিএনপি সুস্থ রাজনীতির চর্চা করে না। ফলে তাদের বিশ্বাস করা যায় না। তারা সন্ত্রাসের রাজনীতি বোঝে, কিন্তু দেশে সন্ত্রাসের রাজনীতি পরিত্যক্ত হয়েছে— এটা তারা এখনো বোঝে না।
দলীয় সূত্রে আরও জানা গেছে, এরই মধ্যে জেলা-উপজেলায় বিএনপিকে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। কারণ চলতি বছরটি সরকারের অর্জনের বছর। বেশকিছু উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন হবে। আগামী ২৫ জুন পদ্মা বহুমুখী সেতুর উদ্বোধন করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিএনপি সেই দিনটিকে সামনে রেখে নানা ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের ছক কষছে বলেও মনে করছে আওয়ামী লীগ।
বিএনপির বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলটির মনোভাব নেতাকর্মীদের কাছে স্পষ্ট করেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান। মঙ্গলবার বিকেলে প্রিয়াঙ্কা কমিউনিটি সেন্টারে মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তরের বর্ধিত সভায় তিনি বলেন, করোনার কিছু ভ্যারিয়েন্ট এখনো রয়ে গেছে। সেই ভ্যারিয়েন্টের মধ্যে একটি ভ্যারিয়েন্ট হলো বিএনপি। কারণ ২৩ জুন ও ২৫ জুন আমাদের জন্য স্বপ্নের দিন। ২৩ জুন আমাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। আর ২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন, যে পদ্মা সেতু অনেক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে, অনেক নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে বঙ্গবন্ধুকন্যার সাহসী পদক্ষেপের এক অনন্য অর্জন। এই দিনটিকে সামনে রেখে বিএনপি নামক করোনা ষড়যন্ত্রের জাল তৈরি করতে চায়।
বিএনপির উদ্দেশে শেখ বজলুর রহমান বলেন, বিএনপি গণতান্ত্রিক দল না। কিন্তু এই রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক। আমাদের সরকার গণতান্ত্রিক। এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আপনারা কথা বলতেই পারেন, সমালোচনা করতেই পারেন। কিন্তু আপনাদের গণতন্ত্রের সুযোগ দিলে সুযোগ নিতে জানেন না। আপনাদের কথা বলতে দিলে ‘পঁচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’ বলেন। এর মানে কী? জননেত্রী শেখ হাসিনাকে আপনারা হত্যা করতে চান? আপনারা প্রস্তুত হন, রাজপথেই আপনাদেরকে প্রতিহত করা হবে।
ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি বলেন, বিএনপি আবার ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। তারা স্লোগান দিচ্ছে— পঁচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার। তাই অবশ্যই ওদের রাজপথে প্রতিরোধ করতে হবে। আজ ওবায়দুল কাদের ভাই (আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী) আমাদের সেই নির্দেশ দিয়েছেন। কোনো রকম ছাড় দেওয়া যাবে না। ওদের ছাড় দিলে ওরা হাঁটি হাঁটি পা পা করে রাস্তায় আসতে শুরু করবে। রাস্তায় এলে আবার আগুন সন্ত্রাসে মানুষ মারবে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা থাকবে না। তাই ওদের মাঠে নামতে দেওয়া হবে না।
অন্যদিকে, মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দলের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যদের সঙ্গে সহযোগী সংগঠনের এক যৌথ সভাতেও বিএনপির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন ওবায়দুল কাদের। তার সভাপতিত্বে বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রাজ্জাক, কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান ও জাহাঙ্গীর কবির নানক, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মাহবুবউল আলম হানিফ, ড. হাছান মাহমুদ ও আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, মির্জা আজম ও আফজাল হোসেন, দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়াসহ সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যরা। এছাড়া ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতারাও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
যৌথ এই সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, বিএনপি শান্তিপূর্ণ কোনো কর্মসূচি দিলে আপত্তি নেই। কিন্তু ওরা শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে। আমরা কি বসে বসে তামাক খাব? আওয়ামী লীগ কি মরে গেছে? আমরা কি রাজপথ কাউকে ইজারা দিয়েছি? আওয়ামী লীগ রাজপথ থেকে এসেছে, রাজপথেই আছে। আন্দোলনের নামে আগুন সন্ত্রাস করলে জবাব রাজপথেই দেওয়া হবে বলে। সেজন্য আপনাদের প্রস্তুত হতে নেত্রীর নির্দেশ এই সভা ডেকেছি।
সরকার বিএনপির কর্মসূচিতে বাধা দিচ্ছে— দলটির এমন অভিযোগের জবাবে কাদের আরও বলেন, বাধার কোনো বিষয় নয়, আমার সামনে নেত্রীকে (শেখ হাসিনা) বলছেন— পঁচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার। এই কথা শুনলে তরুণদের কি মাথা ঠিক থাকে? সন্ত্রাসীকে কি বাধা দেবো না? ফখরুল সাহেবারা এসব স্লোগান শিখিয়ে দিয়েছেন। শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দিলে ছাত্রলীগ কি চুপ করে বসে থাকবে?
ছাত্রদল দিয়ে বিএনপি আন্দোলন শুরু করবে— এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন, আমরাও দেখব— কত ধানে কত চাল। সবকিছুর শেষ আছে। বাড়াবাড়ি ভালো নয়। মির্জা ফখরুল, আপনাকে বলে দিচ্ছি— আগুন নিয়ে খেলবেন না। আগুন নিয়ে খেললে পরিণতি হবে ভয়াবহ।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধন তারিখ ঘোষণায় বিএনপির বিষ জ্বালা উপচে পড়ছে বলেও মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, বিএনপি ছাত্রদলকে ব্যবহার করে ক্যাম্পাসকে অশান্ত করার ষড়যন্ত্র করেছে। কিন্তু সব ষড়যন্ত্রের জবাব রাজপথে দেওয়া হবে।
সারাবাংলা/এনআর/টিআর
আওয়ামী লীগ বিএনপি বিএনপিকে প্রতিরোধ বিএনপির আন্দোলন রাজপথের আন্দোলন