যাত্রা শুরু করল ‘মিতালী এক্সপ্রেস’
১ জুন ২০২২ ১১:১৮
ঢাকা: উদ্বোধনের চৌদ্দমাস পর বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী পরিবহন শুরু করল ‘মিতালী এক্সপ্রেস’। বুধবার (১ জুন) ভারতের রেল মন্ত্রণালয়ের সদর দফতর থেকে বাংলাদেশের রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন এবং ভারতের রেলমন্ত্রী অশ্বিনী কুমার বৈষ্ণব ভার্চুয়ালি এই ট্রেন যাত্রার উদ্বোধন করেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নিউজলপাইগুড়ি স্টেশনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এতে ভার্চুয়ালি অংশ নেন। এসময় দুই দেশের রেলমন্ত্রী সবুজ পতাকা উড়িয়ে ট্রেনটির উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশ- ভারতের মধ্যে চলাচল করা তৃতীয় এক্সপ্রেস ট্রেনটির দুই দেশের মানুষের মধ্যে শুধু যাতায়াত সুবিধাই সহজ করবে না, সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে বলে আশা প্রকাশ করে দুই রেলপথ মন্ত্রী।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান উল্লেখ করে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক রক্তের সম্পর্কের চেয়ে কম নয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর সে সম্পর্কে ভাটা পড়ে। মন্ত্রী বলেন, দুই দেশের মধ্যে অবিভক্ত রেল ব্যবস্থা চালু করে গেছে বৃটিশরা। পাকিস্তানের সময় সে রেল ব্যবস্থা সেভাবে গড়ে ওঠেনি।
তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রেলে। রেলের ইঞ্জিন, সেতু কারখানা সব ভেঙে দেওয়া হয়েছে। আমরা যুদ্ধের পর সে রেল ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন শুরু করেছি। কিন্তু ৭৫ এর পর আবার পিছিয়ে যায়। সবকিছু সংকুচিত হয়ে যায়। ধ্বংসপ্রাপ্ত রেল ব্যবস্থাকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আবার গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। আলাদা রেল মন্ত্রণালয় গড়ে তোলা হয়েছে। আমরা অবিভক্ত রেল ব্যবস্থাকে আবার চালু করছি। ‘মিতালী এক্সপ্রেস’র মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে এই পঞ্চম লিংক চালু হলো। বর্তমানে যে দুইদিন চলাচল করবে, সেটা সপ্তাহে পাঁচ দিন যাতে চলাচল করা যায় আমি সে প্রস্তাব করব। পর্যটক ও শিক্ষার্থীদের জন্য এই রুট বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
রেলমন্ত্রী সুজন আরও বলেন, আমাদের রেল ব্যবস্থা মিটারগেজ ও ব্রডগেজ এই দুই ধরনের। ভবিষ্যতে আমরা সিঙ্গেল লাইনগুলো ডাবল লাইন করবো, সব লাইন হবে ব্রডগেজ। সেভাবে আমরা অবকাঠামো তৈরি করবো।
তিনি আরও জানান, পদ্মা ও যমুনা নদীর ওপরে রেল সেতু হচ্ছে। ২০২৪ সালে শেষ হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দ্বিতীয় সেতু। আর জুনে উদ্বোধন হবে পদ্মাসেতু। ২০২৫ সালে পদ্মায় রেল সেতু প্রকল্প শেষ হবে। কিন্তু তার আগেই শেষ করতে পারব বলে আশা। আমরা প্রতিটি জেলার সঙ্গে রেলকে যুক্ত করব।
মন্ত্রী আরও বলেন, ভারতের রেল ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা যদি বাংলাদেশের রেলের ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারি তাহলে দু’দেশই উপকৃত হবে। দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে।
ভারতের রেলপথমন্ত্রী অশ্বিনী কুমার বৈষ্ণবও এই রেল চলাচলের মধ্য দিয়ে দুই দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে বলে উল্লেখ করেন।
ট্রেনের সময় সূচী অনুযায়ী, নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ‘মিতালী এক্সপ্রেস’ ঢাকার উদ্দেশে সকাল ১১টা ৪৫ মিনিটে ছাড়ে। আর ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এসে পৌঁছাবে রাত সাড়ে ১০ টায়। প্রথম যাত্রায় ‘মিতালী এক্সপ্রেস’ নিউজলপাইগুড়ি থেকে ছেড়ে ভারতের হলদিবাড়ি স্টেশনে ১২টা ৫৫ মিনিটে ১০ মিনিটের জন্য থামবে। এরপর রাত ১টা ৫ মিনিটে ছেড়ে বাংলাদেশ সময় ১টা ৫৫ মিনিটে চিলাহাটিতে চালক পরিবর্তনের জন্য থামানো হবে ৩০ মিনিট। এরপর ২টা ২৫ মিনিটে ছেড়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে রাত ১০টায় ৩০ মিনিটে এসে পৌঁছাবে। এর বাইরে কোনো বিরতি নেই।
জানা গেছে, প্রথম যাত্রায় যাত্রী সংখ্যা একেবারেই কম। ভারতের দিক থেকে গত মঙ্গলবার (৩১ মে) পর্যন্ত ৪৫৬ আসনের মিতালী এক্সপ্রেসের মাত্র ১২টি টিকিট বিক্রি হয়েছে। আর বাংলাদেশ থেকে বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫টি টিকিট। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উদ্বোধনের দীর্ঘদিন পরে যাত্রা শুরু করতে যাওয়া মিতালীর অল্প প্রচারণাও যাত্রী সংখ্যা কম হওয়ার একটি কারণ। তবে ধীরে ধীরে এই প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হবে।
মিতালী এক্সপ্রেস সপ্তাহে দুই দিন চলাচল করবে। ভারত থেকে প্রতি রোববার ও বুধবার আর বাংলাদেশ থেকে প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার ছেড়ে যাবে। ঢাকা থেকে রাত ৯টা ৩০ মিনিটে ছেড়ে গিয়ে নিউজলপাইগুড়ি পৌঁছাবে সকাল সোয়া ৭টায়। রেলওয়ে সুত্র অনুযায়ী, ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট থেকে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন পর্যন্ত জনপ্রতি ভাড়া পরবে ৫ হাজার ২৫৫ টাকা। এই ভাড়া এসি বার্থের যাত্রীদের জন্য। এসি সিটের ভাড়া পরবে ৩ হাজার ৪২০ টাকা আর এসি চেয়ারে যারা যাবেন তাদের খরচ হবে ২ হাজার ৭৮০ টাকা। এই ভাড়ার মধ্যে যোগ হবে ভ্রমণ কর, যে কারণে যাত্রীদের নতুন করে খরচ দিতে হবে না। অন্যদিকে পাঁচ বছরের কম বয়সী যাত্রীদের ভাড়া হবে টিকিট মূল্যের অর্ধেক। নিয়ম অনুযায়ী একজন প্রাপ্ত বয়স্ক যাত্রী সর্বোচ্চ ৩৫ কেজি পর্যন্ত ওজনের মালামাল বিনামূল্যে বহন করতে পারবেন।
বাংলাদেশ থেকে ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে টিকিট সংগ্রহ করা যাবে। অন্যদিকে কোলকাতার টার্মিনাল স্টেশন ও ফেয়ারলিপ্লেস রেলওয়ে বিল্ডিং থেকে মিতালী এক্সপ্রেসের টিকিট পাওয়া যাবে। মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেন চালু হলে পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি, নিউজলপাইগুড়ি, সিকিম, দার্জিলিং পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে ভ্রমণ সহজ হবে। আগে বাংলাদেশি পর্যটকদের জন্য এ সকল স্থানে ট্রেনে যেতে হলে প্রথমে কোলকাতা গিয়ে সেখান থেকে শিলিগুড়ির ট্রেন ব্যবহার করতে হতো। বিমানের ক্ষেত্রেও ঢাকা থেকে কোলকাতা, আবার কোলকাতা থেকে শিলিগুড়ির বাগডোগরা এয়ারপোর্টে যেতে হতো। তবে বাসের রুট থাকায় যারা বাসে ভ্রমণ করতে পারেন তাদের জন্য অসুবিধা ছিল না। মিতালী চালু হলে তাদের জন্যও ট্রেন ভ্রমণ স্বাচ্ছন্দের হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে ২০২১ সালের ২৭ মার্চ করোনা মহামারির মধ্যেই ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে উদ্বোধন করা হয় ‘মিতালী এক্সপ্রেস’। ঢাকা-নিউজলপাইগুড়ি পথে চলাচলের জন্য চালু করা এই ট্রেন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চলাচল করা ট্রেনের মধ্যে তৃতীয়। এর আগে ২০০৮ সালে ঢাকা-কোলকাতা পথে ‘মৈত্রী’ আর ২০১৭ সালে খুলনা-কোলকাতা পথে চলাচল শুরু করে ‘বন্ধন এক্সপ্রেস’।
সারাবাংলা/জেআর/এনএস