ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে সঙ্গে গতি বাড়িয়েছে নৌকা, ছুটছে ঘোড়াও
১ জুন ২০২২ ২০:৫৭
কুমিল্লা থেকে: আসছে ১৫ জুন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচন। এই নির্বাচনকে সামনে রেখে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের মধ্য দিয়ে চলছে মেয়রপ্রার্থীদের প্রচারণা। ২৭ মে প্রতীক বরাদ্দের দিন থেকেই ঘোড়া মার্কায় ভোট চেয়ে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ছুটে বেড়াচ্ছেন দল থেকে পদত্যাগ করা বিএনপি নেতা নিজাম উদ্দিন কায়সার। এদিকে, প্রথম দিন মাঠে না থাকলেও দ্বিতীয় দিন থেকে নিজের প্রতীক ‘টেবিল ঘড়ি’র কাঁটা মেনে বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচনি প্রচারণা চালাচ্ছেন বিএনপি থেকে পদত্যাগী সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু। আর আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত প্রচারণার প্রথম দু’দিন মাঠে না থাকলেও তৃতীয় দিন থেকে নৌকার গতি বাড়িয়ে ছুটে চলেছেন জয়ের লক্ষ্যে।
অন্যদিকে, সীমিত আকারে চলছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী রাশেদুল ইসলামের হাতপাখার প্রচারণা। একইরকমভাবে সিটি করপোরেশনের কিছু এলাকায় সীমিত আকারে দেখা গেছে হরিণ প্রতীক বরাদ্দ পাওয়া স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী কামরুল আহসান বাবুলের প্রচারণাও। তবে প্রচারণার পঞ্চম দিনে পুরো সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও নারী কাউন্সিলরদের নির্বাচনি প্রচারণা জমে উঠেছে। এদিন ভোটারদের ঘরে ঘরে গিয়ে বিভিন্ন রকমের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট চাইতে দেখা প্রার্থীদের।
বুধবার (১ জুন) সকাল ১১টা থেকে নগরীর রেসকোর্স ও স্টেশন রোডের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পথ সভা করে ভোট চেয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত। এ সময় উন্নয়নের স্বার্থে তাকে নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে নগরবাসীর কাছে তার প্রতিশ্রুত ১১ দফা তুলে ধরেন। এ সময় তিনি সিটি করপোরেশনকে দুর্নীতিমুক্ত করে ব্যবসায়ীদের কল্যাণে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেন।
আরফানুল হক রিফাত সারাবাংলাকে বলেন, ‘মনিরুল হক সাক্কুর ১৬ বছরে কুমিল্লার নাগরিকরা কিছুই পায়নি। ৫০০ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ হলেও কোনো উন্নয়ন হয়নি কুমিল্লা নগরীর। অল্প বৃষ্টি হলেই এখন পানি জমে যায়। উন্নয়নের টাকা দিয়ে দুর্নীতি করা হয়েছে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনকে দলীয় কার্যালয় বানিয়ে অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছে। নগরবাসীর কোনো সেবাই নির্বিঘ্নে পাওয়া নিশ্চিত করতে পারেননি সাবেক মেয়র। আমি সেই অচলাবস্থা কাটাতে চাই।’
তিনি বলেন, ‘নৌকা হলো উন্নয়নের প্রতীক। এই প্রতীকে ভোট দিলে মানুষ উন্নয়ন দেখতে পায়। আশা করছি আগামী ১৫ জুন সবাই নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা মনোনীত প্রার্থী হিসেবে আমাকে বিজয়ী করবেন। কথা দিচ্ছি, জয়ী হলে দুর্নীতিমুক্ত পরিচ্ছন্ন সিটি করপোরেশন উপহার দেব।’ এ সময় নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই বলে জানান নৌকা মার্কার এই প্রার্থী।
তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনে নৌকা মার্কার আলাদা একটা গুরুত্ব আছে। যে যেভাবেই ছুটুক না কেন ভোটাররা জানে নৌকা মার্কায় ভোট দিলেই উন্নয়ন হয়। এজন্য আসলে কে কী অভিযোগ করছে তা নিয়ে না ভেবে, সবার ঘরে ঘরে গিয়ে নৌকায় ভোট চেয়ে দুর্নীতিমুক্ত সিটি করপোরেশন গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। জনগণও উন্নয়নের জন্য নৌকায় ভোট দেবে বলে জানাচ্ছেন।’
প্রচারণার পঞ্চম দিনে টেবিল ঘড়ির কাঁটায় যখন সময় ১০টা তখন সিটি করপোরেশনের ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের কোটবাড়ি বিশ্বরোড এলাকায় গণসংযোগ শুরু করেন আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সদ্য সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু। পরবর্তী সময়ে ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের জয়পুর সমিতি প্রাঙ্গণ ও বিকেলে ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের গন্ধমতি কবরস্থানের পাশের মাঠে উঠান বৈঠক করেন তিনি। এছাড়া ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে গণসংযোগ করে সালমানপুর বড় বাড়ির সামনে উঠান বৈঠকে যোগ দেন তিনি।
এদিন তিনি পোস্টার ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগ আনলেও গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘এখনো নির্বাচনের লেভেলপ্লেয়িং ফিল্ড কুমিল্লায় আছে।’ সাংবাদিকদের কাছে পোস্টার ব্যানার ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগ জানালেও নির্দিষ্ট কারও নাম তিনি বলেননি।
মনিরুল হক সাক্কু বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের দুই বারের মেয়র হিসেবে আমি নগরীর প্রতিটা পাড়া-মহল্লা চিনি। কুমিল্লা নগরীরর প্রত্যেক মানুষকেও আমি চিনি। তারাও আমাকে চিনে ও জানে। এই নগরীর জন্য আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে কাজ করি। নির্বাচনের প্রচারণা ও ভোটের দিন যদি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকে তবে ভোটারদের ভোটে আমি হ্যাটট্রিক জয় পাব।’
তিনি বলেন, ‘সরকার নগরীকে আধুনিকায়নের জন্য বিপুল পরিমাণ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। আশা করি আমার অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করার জন্য এ নির্বাচনেও নগরবাসী আমাকেই বেছে নেবে। আমি নির্বাচিত হলে অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করাসহ এই সিটিকে উন্নত সিটিতে রূপান্তর করব।’
মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে বয়স বিবেচনায় সবচেয়ে কনিষ্ঠ হলেও প্রচারণায় বেশ এগিয়ে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার। প্রচারণার পঞ্চম দিন সকালে নিজাম উদ্দিন কায়সার কুমিল্লা মহানগরীর ৯ নম্বর ওয়ার্ডের স্টেশন রোড থেকে গণসংযোগ শুরু করেন। বিকেলে তিনি সিটি করপোরেশনের ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে গণসংযোগে যান।
এ সময় তিনি ইভিএম কাস্টামাইজেশন দেখে কিছুটা সন্তুষ্ট বলে জানান। তবে ইভিএম মেশিনের ব্যালট বাটনের নিরাপত্তা দাবি করেন নিজাম উদ্দিন কায়সার। গণমাধ্যমকর্মীদের তিনি বলেন, ‘বারবার বলা হলেও আমাদের যে হুমকি ধমকি দেওয়া হচ্ছে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছে না নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন। এটা আসলে ভোটারদের মাঝে আশঙ্কা তৈরি করছে।’
সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন কুমিল্লা নগরীতে কোনো উন্নয়ন হয়নি। নগরবাসী চায় উন্নয়ন। আর তাই তাদের অনুরোধে আমি তরুণ প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছি। কারণ শহরের উন্নয়নের জন্য কাজ করার যে গতি প্রয়োজন তা অন্য কারও মাঝেই নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রচারণা দিয়েই আমি ভোট চেয়ে রাত দিন ভোটারদের কাছে ছুটে বেড়াচ্ছি। কারণ, যারা নগরের উন্নয়ন না করে দুর্নীতি করে তারা গতিহীন হয়ে যায় ভোটারদের কাছে। আর বয়সের কারণে ও অসুস্থতা বিবাচনাও অনেকে গতি হারিয়ে ফেলে। তাই সবার অনুরোধে আমি তরুণ প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছি। আমি যেখানেই ভোট চাচ্ছি, সেখানেই সাড়া পাচ্ছি।’ সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জয়ের বিষয়ে শতভাগ আশাবাদী বলেও জানান মেয়র পদে নির্বাচনের জন্য সদ্য পদত্যাগ করা জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি।
প্রচারণার পঞ্চম দিন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র প্রার্থী রাশেদুল ইসলাম ও স্বতন্ত্র কামরুল আহসান বাবুলও বিভিন্ন এলাকায় ভোটারদের কাছে ভোট চাইছেন। এ দিন পথসভা, উঠান বৈঠক, পাড়া-মহল্লায় গণসংযোগ, খণ্ড খণ্ড মিছিল আর মাইকিংয়ে প্রচারণায় ব্যস্ত ছিল বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও মহিলা কাউন্সিলর প্রার্থীরা। নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রার্থীদের কাছে বেড়েছে ভোটারদের কদর। প্রতিটি ওয়ার্ডের ছিল প্রার্থীদের সরব পদচারণা। নিজ নিজ প্রার্থীর প্রচারণা আর স্লোগানে মাইকিং চলছে নগরীতে।
উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ১০ জুলাই কুমিল্লা পৌরসভা ও সদর দক্ষিণ পৌরসভার ২৭টি ওয়ার্ড নিয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন গঠিত হয়। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আফজল খানকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপি নেতা মনিরুল হক সাক্কু। এরপর ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতা আফজাল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন মনিরুল হক সাক্কু।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বে প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল ২০১৭ সালের ৩০ মার্চের এই নির্বাচন। বিএনপিসহ সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের কঠোর সমালোচনার মুখে অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে কুসিক নির্বাচন করে ব্যাপক সফলতা অর্জন করার দাবি ছিল নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্টদের। বিশ্লেষকরা বলছেন, আগের নির্বাচন কমিশনের মতো বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সামনেও কুসিক নির্বাচনই প্রথম চ্যালেঞ্জ।
এবার কুমিল্লা সিটির ২৭টি ওয়ার্ডের ১০৫টি কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট নেওয়া হবে। সিটিতে মোট ভোটার দুই লাখ ২৯ হাজার ৯২০। এর মধ্যে নারী ভোটার এক লাখ ১৭ হাজার ৯২, পুরুষ ভোটার এক লাখ ১২ হাজার ৮২৬।
সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম
আওয়ামী লীগ প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত কুসিক নির্বাচন ঘড়ি ঘোড়া নৌকা পাতপাখা মনিরুল হক সাক্কু হরিণ