Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ধানের দামে উল্লম্ফন, বাজারে কার হাত?

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
৩ জুন ২০২২ ১১:০৪

ফাইল ছবি

ঢাকা: কয়েক দিন আগেও ধানের বাজার নিয়ে হতাশ ছিল প্রান্তিক কৃষকরা। শোনা যাচ্ছিল, মাত্র ৭০০ টাকায় বিকোচ্ছে প্রতিমণ ধান। কিন্তু হঠাৎ করেই সেই বাজার চাঙ্গা। বর্তমানে দেশের বাজারে সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে ধান। প্রকারভেদে কোনো কোনো ধানের দাম উঠেছে ১ হাজার ৫৫০ টাকা মণ। কিছুটা মোটা (আটাশ, উনত্রিশ) ধানের প্রতিমণ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ টাকায়। সাধারণত এই সময়ে ধানের দাম হাজার টাকার বেশি ওঠার কথা নয়। কিন্তু হঠাৎ করেই এমন উল্লম্ফনে প্রশ্ন উঠেছে, ধানের বাজার এতটা চড়া করল কারা?

বিজ্ঞাপন

এই প্রশ্নের উত্তরে নেই কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছেও। তবে ছোট চাল ব্যবসায়ীদের অভিযোগ- বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান (স্কয়ার, সিটি, বসুন্ধরা, এসিআই, প্রাণ, রশিদ) চাল ব্যবসায় প্রবেশ করায় ধানের দাম বেড়েছে। এছাড়া বড় বড় মিলারাও এবার খুব বেশি পরিমাণে ধান কিনছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বাড়তি ক্রয়ের কারণে বাজার চড়া। পাশাপাশি আর বেশি দাম পেতে বড় বড় কৃষকরাও এখন ধান বিক্রি করছেন না। সংশ্লিষ্টরা ধারণা, বাড়তি ক্রয়ের মাধ্যমে বাজার ঊর্ধ্বমুখী করে ধানের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছে। ঊর্ধ্বমুখী চালের বাজারের বৈধতা পেতেও ধানের দাম বাড়ানো হয়ে থাকতে পারে বলেও ধারণা অনেকের। এদিকে, চালকল মালিকদের সিন্ডিকেটকেও দুষছেন কৃষি অর্থনীতিবদরা।

বিজ্ঞাপন

ধানের বাজার এতটা চড়া কেন? জানতে চাইলে কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ধানের উৎপাদন একেবারে কম হয়েছে তা নয়। আমাদের যতটুকু প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি ধান আছে। এখন ধানের দাম বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই। কী কারণে দাম বেড়েছে তা আমরা বলতে পারছি না। তবে ধানের দাম বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।’

ধানের দাম বাড়ার বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. আসাদুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে সব পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে ধানের দাম বেড়ে থাকতে পারে। ধান-চালের বাজার পুরোটাই নির্ভর করে চালকল মালিকদের উপর। তারা কতটুকু ধান কিনেছে, বর্তমানে কতটা কিনছে, তা আমরা জানি না। আবার এবার ধানের উৎপাদন কেমন হয়েছে সেই তথ্যও সরকার ঠিকভাবে প্রকাশ করছে না। ধানের দাম বাড়ার পেছনে উৎপাদন কম হওয়া কিংবা চালকল মালিকদের হাত থাকতে পারে।’

বাংলাদেশ কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শরিফুজ্জামান শরিফ এ প্রসঙ্গে সারাবাংলাকে বলেন, ‘কৃষকরা ইতোমধ্যে কম দামে ধান বিক্রি করেছে। চাতাল মালিকরা ধান কিনে ফেলেছে। কৃষকরা কিন্তু ধানের দাম পাচ্ছে না। ধান-চালের বাজার অস্থিরতার একমাত্র কারণ সরকারের অব্যবস্থাপনা। সরকারের ধান-চাল কেনার মধ্যে মধ্যস্বত্তভোগীরা ঢুকে পড়ে। হাওর অঞ্চেলে ধান এখনও ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা মণে বিক্রি হচ্ছে। চালের দাম বাড়তে পারে এমন আশায় অনেক কৃষকও তাদের ধান বিক্রি করছে না। এছাড়া সব পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকায় বাজারে ধানের দামও বেড়েছে।’

ময়মসিংহের গফরগাঁও উপজেলার ধানের বেপারী রাব্বানী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এখন আটাশ ধান ১ হাজার ১০০ টাকা ও উনত্রিশ ধান ১ হাজার ৫০ টাকা মণে কিনছি। ধানের দাম হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। প্রথম দিকে ধানের দাম একটু কম ছিল। তখন ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় প্রতিমণ ধান বিক্রি হতো। হাওরে আগাম বন্যা ও ফলন কম হওয়ায় এবার ধানের দাম বেশি।’

একই এলাকার কৃষক মোস্তফা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এখানে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় প্রতিমণ ধান বিক্রি হচ্ছে। ১০ দিন আগেও যা ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকায় বিক্রি করেছি। এর আগে ধানের দাম কখনও এতো বেশি ছিল না। মৌসুমটির প্রথম দিকে ৭০০ টাকা মণে ধান বিক্রি হয়েছে। মাড়াইয়ের সময় কিছুটা ভেজা ধান ৬৫০ টাকা মণে বিক্রি হয়েছে।’

কুষ্টিয়ায় ধানের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বিপ্লব হোসাইন বাচ্চু সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এখানে মিনিকেট নামের যে ধানটি আছে তা ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৪৫০ টাকায় প্রতিমণ বিক্রি হচ্ছে। আটাশ ধান বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ২৫০ টাকা মণে। আর কাজললতা ১ হাজার ২০০ টাকা ও বাসমতি ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৫৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘এই সময়ে আগে কখনও ধানের এত ক্রেতা দেখিনি। এবার ধানের দাম রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে। চালের দামও অনেক বেশি। এর কারণ হচ্ছে- সিটি গ্রুপ, মজুমদার গ্রুপসহ বড় বড় প্রতিষ্ঠান চালের বাজারে আসায় ধানের কৃত্রিম সংকট দেখা দিয়েছে। রশিদ সাহেব তো আছেনই। তারা দেদারসে ধান কিনছেন। বড় বড় গুদামে মজুত করছেন। ফলে বাজারে ধান পাওয়া যাচ্ছে না। আগে যারা অন্য ব্যবসা করতো এখন তারাও ধান কিনছে, চালের ব্যবসা করছে। এ কারণেই বাজারে ধানের কৃত্রিম সংকট দেখা দিয়েছে।’

নাটোরের গুরুদাসপুরে তালুকদার অটো রাইস মিলের পরিচালক আরিফুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘মিনিকেট (জিরা) ধান ৩৮ কেজির মণ ১ হাজার ৪০০ টাকায় আমরা কিনছি। আর ৪০ কেজির মণ কেনাবেচা হচ্ছে ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৫৫০ টাকা মণে।’

তিনি বলেন, ‘ধানের বাজার এখন অস্থির। একেক যায়গায় ধান একেক দামে বিক্রি হচ্ছে। বড় বড় অটো মিলার ও গৃহস্থরা এখন ধান বিক্রি করতে চাচ্ছে না। বড় বড় প্রতিষ্ঠান (স্কয়ার, অটোমিলার) আমাদের এলাকার বাজারে এসে ধানের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা ইচ্ছেমত ধান কিনেছে। যারা হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করে তারা এখন চালের ব্যবসায় এসেছে। এ কারণেই ধানের দাম এত বেড়েছে।’

নওগাঁর চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন সরদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘জিরা কাটারি আমরা কিনছি ১ হাজার ২৫০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা মণে, মোটা হাইব্রিড ৯৮০ থেকে এক হাজার টাকা ও আটাশ ধান কিনছি এক হাজার থেকে ১২০০ টাকা মণে।’

চালের বাজার এতটা অস্থির কেন? জানতে চাইলে দেশের চালকল মালিকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ কে এম লায়েক আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাজারে ধানের দাম বেড়েছে। ধানের দামের সঙ্গে চালের দামে মিল আছে। আমরা এখন ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায় প্রতিমণ ধান কিনছি। তবে গতকাল থেকে ধান-চালের বেচাকেনা কম।’

সরকারের অভিযান প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করার হলে করুক। এতে সঠিক বিষয় বের হয়ে আসবে। আমরা আমাদের কেনাকাটার প্রতিমাসের রিপোর্ট কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে থাকি। আমরা অবৈধভাবে ধান-চাল মজুত করিনি।’

সারাবাংলা/ইএইচটি/পিটিএম

ধানের দাম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর