Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস: অবহেলায় ঝুঁকি বাড়ছে প্রসূতি ও নবজাতকের

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
৪ জুন ২০২২ ১২:৫৫

ঢাকা: রাজধানীর উত্তরায় বসবাস করেন ফখরুল ইসলাম ও সোহানা নূর দম্পতি। রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ (পেডিয়াট্রিক) চিকিৎসকের চেম্বারের সামনে অপেক্ষা করছিলেন নবজাতককে কোলে নিয়ে। কথা বলে জানা গেল, সন্তানের হৃদযন্ত্রে সমস্যা দেখা গেছে জন্মের পরেই। আর তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে এসেছেন। কথা বলার সময় সোহানা নূর বারবার চোখের পানি মুছছিলেন।

এই দম্পতি জানালেন, ২০১৭ সালে গর্ভধারণের পর নিয়মিত গাইনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মেনেই চলছিলেন সোহানা। এর মধ্যেই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জেস্টেশনাল বা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ধরা পড়ে তার। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলার কারণে সন্তানের জন্মদান পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি। সবার কাছে জানতে পারেন, সন্তান জন্মদানের পর আর এই ডায়াবেটিস থাকে না। ফলে প্রথম সন্তান জন্মদানের পর আর ফলোআপ করেননি তারা।

সোহানা বললেন, চার বছর পর ফের গর্ভধারণ করেন তিনি। শারীরিকভাবে তেমন সমস্যা বোধ না হওয়ায় এবার আর চিকিৎসকের পরামর্শ নেননি। ৩২ সপ্তাহ পার করে যখন চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করলেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় রক্তে সুগারের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেশি পাওয়া গেল— খালি পেটে ১৪ (14 mmol/L) ও খাওয়ার পর ২৬ (26 mmol/L)। আল্ট্রাসনোগ্রামেও গর্ভে পানির পরিমাণ বেশি দেখা গেল। চিকিৎসক দ্রুতই তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে বলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য ইনসুলিন নিতে পরামর্শ দেন।

সোহানা বলেন, ‘প্রায় তিন সপ্তাহ পর বাচ্চা হয়। প্রসবের পর দেখা গেল, বাচ্চা কান্নার সময় এবং দুধপান করানোর সময়ও নীল হয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গেই তাকে ইনকিউবেটরে দেওয়া হলো। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বাচ্চার হার্টে পাওয়া গেল ফুটো। আমাদের ভুলের কারণেই ডায়াবেটিসের বিষয়টি বুঝতেই পারিনি। সে কারণেই হয়তো বাচ্চার এ অবস্থা।’ বলতে বলতে চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলেন না সোহানা।

রাজধানীর শিশু হাসপাতালে নবজাতককে নিয়ে নোয়াখালীর মাইজদী থেকে এসেছেন ফরিদূর রহমান ও তার স্ত্রী। জন্মের পর থেকেই বাচ্চার ঠোঁট কাটা। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে এসেছেন। এটি তাদের দ্বিতীয় সন্তান। এই দম্পতির ক্ষেত্রেও স্ত্রীর প্রথমবার প্রসবের পর আর চিকিৎসকের কাছে ফলোআপ করেননি। দ্বিতীয়বার গর্ভধারণের পরও নেননি চিকিৎসকের পরামর্শ। পরিচিত এক ফার্মেসির মালিকের পরামর্শে ওষুধপত্র খাচ্ছিলেন। এবারে ২৯ সপ্তাহ পর চিকিৎসকের কাছে গেলে পরীক্ষায় রক্তে উচ্চ মাত্রার সুগার ধরা পড়ে। ৩৪ সপ্তাহে সন্তান জন্ম দেন তিনি। সেই সন্তানের ঠোঁটই জন্ম থেকেই কাটা। তারই চিকিৎসার জন্য তারা এখন ঢাকয়।

সোহানা নূরের মতো প্রায় একইরকমের আক্ষেপ নিয়ে ফরিদুর রহমান বলেন, চিকিৎসকের পরামর্শ শুনে যদি ফলোআপে যেতাম, তাহলে হয়তো স্ত্রীর ডায়াবেটিস থাকার বিষয়টি জেনে সতর্ক থাকতে পারতাম। কিন্তু সময়মতো যাইনি। এখন আর কী করা!

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সোহানা নূর ও ফরিদুর রহমানের এমন আক্ষেপই বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ডায়াবেটিস রোগীদের বাস্তবতা। দেশে প্রতি সাত জন প্রসূতির একজন গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ৩০ বছরের কম বয়সী নারীদের মধ্যেই এই হার বেশি। এক্ষেত্রে ডায়াবেটিস আছে— এমন নারীদের কিডনি ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ডায়াবেটিস না থাকা প্রসূতিদের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেশি।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, কেবল প্রসূতিই নয়, যাদের টাইপ-১ ডায়াবেটিস আছে তাদের গর্ভস্থ সন্তান নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থেকে সন্তান জন্মদানের পরে সুস্থ হয়ে উঠলেও পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে তাদের অর্ধেকেরও বেশি টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শুধু তাই নয়, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস দেখা দেওয়ার পরে সন্তান জন্মদান শেষে অনেকেই আর তেমন গুরুত্ব দেন না। এর ফলে নারীদের মাঝে বাড়ছে ডায়াবেটিস, আক্রান্ত হচ্ছেন নানা রকমের অসংক্রামক রোগে। কেবল সচেতনতার অভাবে নবজাতক ও শিশুরাও বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় ভুগছে। সন্তান জন্মদানের পরে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসকে গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে মৃত্যুবরণের ঘটনাও বাড়ছে।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস কী?

গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের কারণে অনেক সময় প্রসূতির রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়। তবে সন্তান প্রসবের পর বেশিরভাগ প্রসূতির ক্ষেত্রেই তা স্বাভাবিক মাত্রায় নেমে আসে। এটিকেই গর্ভকালীন বা জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস বলা হয়। গর্ভাবস্থায় শরীরের অতিরিক্ত চাহিদা অনুযায়ী রক্তে শর্করার হার নিয়ন্ত্রণকারী বাড়তি ইনসুলিন তৈরি করত না পারায় এই লক্ষণ দেখা দেয়। গর্ভাবস্থায় যেকোনো সময়ে এটি দেখা গেলেও গর্ভধারণ করার প্রথম তিন মাস অতিবাহিত হওয়ার পর থেকে এই ডায়াবেটিসের লক্ষণ দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, গর্ভধারণের আগে ডায়াবেটিস না থাকলেও গর্ভকালীন এই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফাউন্ডেশন বা আইডিএফ অবশ্য গর্ভকালীন ডায়াবেটিসকে অসংক্রামক রোগ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। কারণ গর্ভকালীন ডায়াবেটিস প্রসূতির পাশাপাশি গর্ভস্থ শিশুর জন্যও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তথ্য বলছে, এ ধরনের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে শিশুদের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি।

আইডিএফের তথ্য আরও বলছে, বাংলাদেশের ৮ থেকে ১৩ শতাংশ নারী গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এসময় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে তা বিভিন্ন ধরনের সমস্যা তৈরি করতে পারে।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেশি কাদের?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব নারীর স্থুলতা বা অতিরিক্ত ওজনজনিত সমস্যা রয়েছে, তাদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। প্রথম সন্তান প্রসবের সময় গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হলে এবং নবজাতকের ওজন চার কেজি বা এর বেশি হলে তাদের ঝুঁকির মাত্রাও বাড়তে পারে। পরিবার থেকে বা বংশগতভাবে কারও ডায়াবেটিস থাকলেও গর্ভকালীন সময়ে ঝুঁকি বাড়তে পারে প্রসূতিদের।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের প্রভাব

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের কারণে গর্ভে শিশুর আকৃতি স্বাভাবিকের চেয়ে বড় হতে পারে। এর ফলে সন্তান প্রসবের সময় জটিলতা তৈরি হতে পারে। পলিহাইড্রামনিওস বা গর্ভের ভেতরে শিশুকে ঘিরে অতিরিক্ত পরিমাণে অ্যামনিওটিক ফ্লুইড তৈরি হতে পারে। ফলে সময়ের আগেই প্রসব বেদনা শুরু হওয়া এবং প্রসবের সময় জটিলতার ঝুঁকি দেখা দিতে পারে। এছাড়াও প্রিম্যাচিওর বার্থ অর্থাৎ নির্ধারিত সময়ের আগেই সন্তান ভূমিষ্ঠ হতে পারে।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের কারণে প্রি-এক্ল্যাম্পশিয়াও হতে পারে। এর ফলে গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। প্রসবের পর শিশুর রক্তে শর্করার পরিমাণ কমে যাওয়া এবং চোখ ও চামড়া হলুদাভ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। এক্ষেত্রে মৃত সন্তান প্রসব করার মতো সমস্যাও তৈরি হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সন্তান জন্মদানের পরে চিকিৎসকের ফলোআপে না থাকা এবং ছয় সপ্তাহ পরে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করলে দীর্ঘমেয়াদে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের প্রভাব পড়তে পারে। পরবর্তী সময়ে গর্ভধারণেও এই ডায়াবেটিস হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে রোগী স্থায়ীভাবে টাইপ-টু ডায়াবেটিসেও আক্রান্ত হতে পারেন।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে সন্তানের ঝুঁকি

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সন্তান গর্ভে থাকার সময় মায়ের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকলে তা বিভিন্নভাবে সন্তানকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। জন্মগ্রহণের পরপরই শিশুর হৃৎপিণ্ড ও শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। শিশু যখন বড় হতে থাকবে, তখন তার স্থূলাকৃতি দেহ (অতিরিক্ত ওজন) হওয়ার বা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এছাড়া জন্মের পর থেকেই স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যার পাশাপাশি আরও কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের লক্ষণ

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট লক্ষণ নেই। তবে কিছু নারীর রক্তে শর্করার হার অতিরিক্ত বেড়ে গেলে কয়েকটি লক্ষণ দেখা যেতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে— তৃষ্ণা বেড়ে যাওয়া, সাধারণ সময়ের চেয়ে বেশি মাত্রায় প্রস্রাবের বেগ পাওয়া, ঘন ঘন মুখ শুকিয়ে যাওয়া, দ্রুত ক্লান্ত হয়ে যাওয়া। গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিকভাবেও এরকম লক্ষণ দেখা যেতে পারে। এ কারণেই গর্ভকালীন ডায়াবেটিস আছে কি না, তা জানার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।

সচেতনতা, স্ক্রিনিংয়ে সমাধান

কুমিল্লা ডায়াবেটিক হাসপাতালের কনসালট্যান্ট ডা. দিলরুবা বলেন, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস অনেকের মাঝেই হয়, একে জিটিএম বলা হয়। আমাদের এখানে যারা চিকিৎসা নিতে আসেন, তাদের ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সন্তান জন্মদানের পরে আর ডায়াবেটিস থাকে না। যদি নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন ও ফলোআপে থাকেন, তবে তাদের ঝুঁকি অনেক কমে আসে। তবে এক বছর পর্যন্ত ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

তিনি বলেন, আমরা রোগীদের ডায়েট চার্ট ফলো করতে বলি। একইসঙ্গে ছয় সপ্তাহ, ছয় মাস বা এক বছর পরে জিসিটি করে ফলোআপ করতে বলি। তবে অনেকেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন না। খামখেয়ালির কারণে ডায়েট চার্ট মানেন না। তখন ৫০ শতাংশের জায়গায় ৯০ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেড়ে যায়। তবে এই পরিসংখ্যান কেবল ডায়াবেটিক হাসপাতালে আসা রোগীদের।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) গাইনি ও প্রসূতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল বলেন, আগে ডায়াবেটিসের ইতিহাস না থাকলেও গর্ভকালীন সময়ে যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন, ইনসুলিন প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা সেটি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করি। এক্ষেত্রে সন্তান জন্মদানের ছয় সপ্তাহ পরে আমরা রোগীকে আবার আসতে বলি। কারণ এই ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত প্রসব পরবর্তী বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে যায়। আর তাই এই সময়ের পরেই আমরা রোগীর ডায়াবেটিসের মাত্রা পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেই, অন্তত যেন পরিষ্কার একটি ধারণা পাওয়া যায়।

তিনি বলেন, ছয় সপ্তাহ পরেও যদি রক্তে আগের মতোই শর্করার মাত্রা বেশি থাকে, তার অর্থ তার গর্ভকালীন ডায়াবেটিস স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেনি। এক্ষেত্রে তিনি ডায়াবেটিক রোগী হিসেবে চিহ্নিত হবেন। তবে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। যে ৩০ শতাংশের রক্তের শর্করা বা ব্লাড সুগার স্বাভাবিক পর্যায়ে আসে না, তাদের বাকি জীবন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হিসেবেই কাটাতে হবে।

তিনি আরও বলেন, গর্ভকালীন একজন প্রসূতির ডায়াবেটিস সঠিকভাবে নির্ণয় করে যত ভালোভাবে চিকিৎসা করা যায়, তার সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা তত বাড়ে। কিন্তু গর্ভকালীন ডায়াবেটিস যদি অনিয়ন্ত্রিত থাকে, তাহলে সন্তান জন্মদানের পরও তার ডায়াবেটিস রোগী হয়ে থাকার ঝুঁকি আরও বেশি বাড়বে। আমাদের দেশে কেবল সচেতনতার অভাবে ৩০ শতাংশ গর্ভকালীন ডায়াবেটিস রোগীর ঝুঁকি বেড়ে যায়। তারা চিরতরে ডায়াবেটিস আক্রান্ত হয়ে যান। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায় ডায়াবেটিস। কারণ তারা জানেনই না যে কখন সেটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

প্রসবের পর চিকিৎসকের ফলোআপে থাকার গুরুত্ব তুলে ধরে এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, আমাদের দেশে প্রসব পরবর্তী চিকিৎসকের ফলোআপে থাকার প্রবণতা একেবারেই কম। যেসব চিকিৎসক কাউন্সেলিং করে রোগীকে ফলোআপে আসার কারণটি বোঝাতে পারেন, তাদের অনেক রোগীই ফলোআপ করেন। কিন্তু সব চিকিৎসক এই গুরুত্ব তুলে ধরতে পারেন না। তাই প্রসূতিরাও ফলোআপ করেন না। এ ক্ষেত্রে তার ডায়াবেটিস থেকে গেলে তিনি হয়তো বুঝতেই পারবেন না যে নিজের অজান্তেই তার কিডনি বা হৃদযন্ত্রের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। এই সচেতনতাটি সবার মধ্যে তৈরি হওয়াটা জরুরি।

তবে ঝুঁকি এড়ানোর জন্য গর্ভকালীন ডায়াবেটিসই শুধু না, সরকারিভাবে যেকোনো সময়ে যেকোনো স্থানে রোগীদের স্ক্রিনিং সুবিধা বাড়ানোর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ডা. রেজাউল করিম কাজল। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারের ভূমিকা বেশি। সচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যমকে ব্যবহার করা যেতে পারে। চিকিৎসকদের এ সংক্রান্ত কাউন্সেলিং বাড়াতে হবে। কেবল প্রসূতি নয়, তার পরিবারের সদস্যদেরও কাউন্সেলিংয়ের আওতায় আনা যেতে পারে। তাতে ফলোআপের প্রবণতা বাড়তে পারে।

বাংলাদেশ অ্যান্ডোক্রাইন সোসাইটির (বিইএস) সাধারণ সম্পাদক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, গর্ভকালীন ও তার আগে-পরে তিন ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। প্রথমত, একজনের আগে থেকেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারী গর্ভধারণের পর রক্তে সুগারের মাত্রা বেশি হতে পারে। দ্বিতীয়ত, আগে ডায়াবেটিস না হলেও গর্ভধারণের পর রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রসবের পর ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিক হয়ে যায়। তৃতীয়ত, কোনো পর্যায়েই স্ক্রিনিংয়ের আওতায় থাকেন না। তারা গর্ভধারণের আগে বা গর্ভধারণের সময়ও স্ক্রিনিংয়ের অভাবে জানতেই পারেন না যে তাদের রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি।

তিনি বলেন, যারা কখনোই স্ক্রিনিংয়ের আওতায় ছিলেন না, তাদের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস নিয়ে জটিলতা বেশি। তারা গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলেও বুঝতে পারেন না। পরে ফলোআপও করেন না। এ ধরনের নারীদের প্রায় ৫০ শতাংশের মধ্যেই প্রসবের পরও ডায়াবেটিস থেকে যায়। ফলে স্ক্রিনিংয়ের আওতা বাড়াতে হবে।

ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, যারা সন্তান গ্রহণের পরিকল্পনা করেন, তাদের সবাইকে আগেই স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে স্বামী ও স্ত্রী নিজেরাই সচেতনভাবে ব্লাড সুগার ও থাইরয়েড টেস্ট করাতে পারেন। প্রথম বাচ্চাই হোক বা পরবর্তী বাচ্চা যখনই হোক না কেন, এই স্ক্রিনিংটা জরুরি। এটা আমাদের দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অবিবাহিত কোনো তরুণীও চাইলেই ডায়াবেটিস ও থাইরয়েড স্ক্রিনিং করাতে পারেন। এতে তার ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। কারণ তিনি আগেই জানতে পারবেন তার ডায়াবেটিস রয়েছে কি না। গর্ভধারণের পরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হলে জানতে পারবেন গর্ভকালীন ডায়াবেটিস রয়েছে কি না। এ বিষয়ে জানতে পারলে কিন্তু তিনি যথাযথ চিকিৎসা নিয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে পারবেন। যেহেতু ডায়াবেটিস সন্তান ও প্রসূতির জন্য তীব্র ঝুঁকির কারণ, তাই আমাদের খুবই গুরুত্ব দিয়ে স্ক্রিনিং করানো প্রয়োজন।

সারাবাংলা/এসবি/টিআর

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস ডায়াবেটিস


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

সালমান শাহ্‌ স্মরণে মিলাদ মাহফিল
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২০:০৩

নাফ নদীর মোহনায় ২ শিশুর মরদেহ উদ্ধার
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৯:৪৯

সম্পর্কিত খবর