Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জাল খতিয়ানে ৩ বোনের জমি লিখে নিয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যান

মো. আশিকুর রহমান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
৭ জুন ২০২২ ০৯:৪৩

রাজবাড়ী: বোনদের নামে জাল বিএস খতিয়ান বানিয়ে নিজের নামে অর্ধ কোটি টাকার জমি রেজিস্ট্রি করে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানখানাপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এ কে এম ইকবাল হোসেনের বিরুদ্ধে। যদিও ইউপি চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন বলছেন, বোনেরা তাদের ওয়ারিশের সম্পত্তি তার নামে হেবা দলিল করে দিয়েছেন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানখানাপুর ইউনিয়নের চর খানখানাপুর মৌজার চূড়ান্ত প্রকাশিত বিএস ১৬৩৯ নম্বর খতিয়ানে ১৬টি দাগে ৬ একর ৪১ শতাংশ জমি রয়েছে। দাগগুলো হলো- ৬৭৭২, ৬৯০৩, ৭২৮৪, ৭২৮৬, ৭২৮৮, ৭২৮৯, ৭৩৭৭, ৭৩৮৬, ৭৬৮৭, ৭৬৮৯, ৭৬৯০, ৭৬৯৪, ৭৮০৩, ৯০০৯, ৯০১৩ ও ৯১০৩।

বিজ্ঞাপন

খতিয়ানটিতে এই ৬ একর ৪১ শতাংশ জমি চর খানখানাপুর মৌজার মৃত হবিবর রহমানের তিন ছেলে ফজলুর রহমান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন ও লুৎফর রহমানের নামে সমান তিনভাগে রেকর্ডভুক্ত হয়। কিন্তু একই মৌজার এবং একই বিএস ১৬৩৯ নম্বরের আরও একটি খতিয়ান এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। সে খতিয়ানেও ১৬টি দাগে ৬ একর ৪১ শতাংশ জমিই রয়েছে।

তবে হবিবর রহমানের তিন ছেলে ফজলুর রহমান, ইকবাল হোসেন ও লুৎফর রহমানের নামের পাশাপাশি আরও তিন নারীর নাম রয়েছে খতিয়ানটিতে। এই নামগুলো হলো- শামসুন নাহার, নুরুন নাহার ও বুলু খাতুন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এই তিন নারী হবিবর রহমানের তিন মেয়ে। অর্থাৎ খানখানাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম ইকবাল হোসেনের তিন বোন। মূলত এই খতিয়ান দিয়েই তিন বোনের কাছ থেকে জমি রেজিস্ট্রি (হেবা দলিল) করিয়ে নেন ইকবাল হোসেন।

খতিয়ানটি আসল কিনা তা যাচাই করার জন্য রাজবাড়ী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রেকর্ড রুম থেকে চর খানখানাপুর মৌজার ১৬৩৯ নম্বর বিএস খতিয়ানের সার্টিফাইড কপি (পর্চা) সংগ্রহ করা হয়। ওই খতিয়ানেও দেখা যায় ৬ একর ৪১ শতাংশ জমি হবিবর রহমানের তিন ছেলে ফজলুর রহমান, ইকবাল হোসেন ও লুৎফর রহমানের নামে সমান তিনভাগে রেকর্ডভুক্ত রয়েছে। অর্থাৎ, একেক ভাইয়ের অংশে জমির পরিমাণ রয়েছে ২ একর সাড়ে ১৩ শতাংশ করে। এতেই পরিস্কারভাবে বোঝা যায় তিন বোনের নাম বসিয়ে যে খতিয়ানটি তৈরি করা হয়েছে সেটি জাল।

বিজ্ঞাপন

জাল এই খতিয়ানটিতে হবিবর রহমানের তিন ছেলের প্রত্যেকের জমির পরিমাণ ২ একর সাড়ে ১৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ একর সাড়ে ৪২ শতাংশ করে দেখানো হয়েছে। আর তিন মেয়ের প্রত্যেকের জমির পরিমাণ ৭১ শতাংশ ১৮ লিংক করে দেখানো হয়েছে।

এই জাল খতিয়ানের মাধ্যমে ২০২০ সালের ১১ জুন রাজবাড়ী সদর সাব রেজিস্ট্রি অফিস থেকে প্রথম দলিলটি (২৪৮৫ নম্বর দলিল) রেজিস্ট্রি করা হয়। ওই দলিলে ইকবাল হোসেনের বোন নুরুন নাহার ৭১ শতাংশ ১৮ লিংক জমি ইকবাল হোসেনকে রেজিস্ট্রি (হেবা) করে দেন।

একই জাল খতিয়ানের মাধ্যমে ২০২২সালের ২৫ মে রাজবাড়ী সদর সাব রেজিস্ট্রি অফিস থেকে দ্বিতীয় দলিলটি (৪১৭৭ নম্বর দলিল) রেজিস্ট্রি করা হয়। ওই দলিলে ইকবাল হোসেনের বোন শামসুন নাহার ও ফজিলাতুন নেছা ওরফে বুলু খাতুন যৌথভাবে ১ একর ৪২ শতাংশ ৩৬ লিংক জমি ইকবাল হোসেনকে রেজিস্ট্রি (হেবা) করে দেন।

দু’টি দলিলের মধ্যেই ইকবাল হোসেনের তিন বোন উল্লেখ করেন, ‘রেজিস্ট্রিকৃত জমি তারা তিন ভাই ও তিন বোন পিতার ওয়ারিশ সূত্রে প্রাপ্ত হয়ে বিএস জরিপে ১৬৩৯ নম্বর খতিয়ানে তাদের নিজ নামে চূড়ান্তভাবে রেকর্ড করিয়ে খাজনা পরিশোধ করে ভোগদখলে আছেন। এ অবস্থায় তাদের নিজ নিজ অংশের জমি তারা তাদের ভাই এ কে এম ইকবাল হোসেনকে হেবা করে দিলেন।’

অথচ, চর খানখানাপুর মৌজার বিএস ১৬৩৯ নম্বর খতিয়ানে ইকবাল হোসেনের তিন বোনের কোন নামই নেই।

জাল খতিয়ান বানিয়ে কিভাবে ভাইকে জমি রেজিস্টি করে দিলেন এমন প্রশ্ন ছিল এ কে এম ইকবাল হোসেনের তিন বোনের কাছে। তাদের সবার উত্তর ছিলো, তারা ভুয়া খতিয়ানের বিষয়ে কিছুই জানেন না। সবকিছু তাদের ভাই ইকবাল করেছেন। তারা শুধু রেজিস্ট্রির দিন সাব রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে স্বাক্ষর করে দিয়ে এসেছেন।

ইকবাল হোসেনের বোন শামসুন নাহার বলেন, ‘আমার বাবার ওয়ারিশের জমি আমি পেয়ে ভাইকে দিয়েছি। খতিয়ানের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আমার ভাই ইকবাল জানাবোঝা মানুষ। আমি শুধু রেজিস্ট্রি করার দিন গিয়ে সই করে দিয়ে এসেছি। খতিয়ানের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আপনারা আমার ভাই ইকবালের কাছে জিজ্ঞেস করেন।’

ইকবাল হোসেনের বাকি দুই বোন নুরুন নাহার ও বুলু বেগমের উত্তরও ছিল একই রকম।

ইকবাল হোসেনের বড়ভাই ফজলুর রহমান বলেন, ‘আমার তিন বোন তাদের প্রাপ্ত সম্পত্তি আমাদের তিন ভাইকে মৌখিকভাবে দিয়ে দেন। সে কারণে বিএস রেকর্ডে আমাদের তিন ভাইয়ের নাম আসে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হয় একেক ভাই এক লাখ টাকা করে মোট তিন লাখ টাকা শুধু আমার ছোট বোনকে দিতে হবে। কিন্তু পরবর্তীতে আমার ভাই ইকবাল তার ভাগের এক লাখ টাকা দিতে গড়িমশি করে। একপর্যায়ে আমি আমার ছোট বোনকে ওই তিন লাখসহ আরও এক লাখ টাকা দিই। কিন্তু আমার ভাই ইকবাল কৌশলে জালিয়াতির মাধ্যমে জাল খতিয়ান করে আমার বোনদের কাছ থেকে ২ একর ১৩ শতাংশ ৫৪ লিংক জমি রেজিস্ট্রি করে নেন।’

ইকবাল হোসেনের ছোট ভাই লুৎফর রহমান বাবু বলেন, ‘আমার ভাই ইকবাল হোসেন জাল খতিয়ান বানিয়ে আমাদের দুই ভাইয়ের জমিও বোনদের মাধ্যমে নিজের নামে রেজিস্ট্রি করে নিয়েছেন। আমরা তার নামে মামলা করবো।’


ইউপি চেয়ারম্যান এ কে এম ইকবাল হোসেন বলেন, ‘বাবার সম্পত্তি বোনেরা পাবে। বিএস রেকর্ডে তাদের নাম আসেনি কিন্তু তারা ওয়ারিশ। আমি উকিলের সাথে আলাপ করেছি যে, আমার বোনদের নামে জমি রেকর্ড হয় নাই, কিন্তু তারা তাদের অংশের সম্পত্তি আমাকে দিতে চায়। জবাবে উকিল আমাকে পরামর্শ দিয়েছেন যে, আপনি হেবা করে নেন। হেবা করে নিয়ে বোনদের দিয়ে রেকর্ড সংশোধনী মামলা করান। রেকর্ড সংশোধনী হয়ে যাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার বোনরা আমাকে জমি দিয়েছে এটা তো দোষের না। আর জাল খতিয়ান কিভাবে হলো সেটা আমিও জানি না এবং আমার বোনরাও জানে না।’

হেবা দলিল সম্পাদনকারী দলিল লেখক আমিনুল ইসলাম বাবলু ও হাসেম জানান, ইকবাল চেয়ারম্যান ও তার তিন বোন খতিয়ান এবং খাজনার দাখিলা নিয়ে এসেছিলেন। সেগুলোর ভিত্তিতেই দলিল সম্পাদন করা হয়েছে। খতিয়ানটি জাল কিনা সেটা যাচাই বাছাই করার সুযোগ তাদের নেই।

রাজবাড়ী সদর সাব রেজিস্ট্রার মো. রেজাউল করিম বকসী বলেন, ‘হেবা দলিল সম্পাদনের সময় ওয়ারিশরা সবাই এজলাস কক্ষে উপস্থিত থাকেন। সে কারণে গভীরভাবে কাগজপত্র যাচাইবাছাইয়ের প্রয়োজন পড়ে না। এছাড়া তাৎক্ষণিকভাবে খতিয়ান যাচাইবাছাই করার মতো কোনো সুযোগও আমাদের কাছে থাকে না। দাতা-গ্রহীতারা বিএস রেকর্ডের খতিয়ান ও খাজনার দাখিলা নিয়ে এলেই জমি রেজিস্ট্রি করা হয়।’

তবে ভুয়া খতিয়ান বানিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করা আইনত অপরাধ বলেও জানান তিনি।

সারাবাংলা/এমও

ইউপি চেয়ারম্যান জাল খতিয়ান জাল বিএস খতিয়ান বোনদের জমি রাজবাড়ী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর