ঢাকা: পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-১৯৯৭ আমূল পরিবর্তিত হয়ে আসছে নতুন বিধিমালা এ কথা জানিয়েছেন পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক সৈয়দ নজমুল আহসান।
মঙ্গলবার (৭ জুন) পরিবেশ অধিদফতর অডিটরিয়ামে বিশ্ব পরিবেশ দিবস-২০২২ উপলক্ষে পরিবেশ অধিদফতর, ঢাকা কলিং ও পরিবেশ বাচাঁও আন্দেলান (পবা) আয়োজিত পরিবেশবান্ধব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ শীর্ষক সেমিনারে অংশ নিয়ে তিনি এ কথা জানান।
পবা চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে আয়োজিত সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘এখানে যে রিকমেন্ডেশনগুলো এসেছে তার অধিকাংশই ইতোমধ্যে হয় বাস্তবায়িত হয়ে গিয়েছে অথবা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭ আছে। এটিকে আমূল পরিবর্তন করে নতুন পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-২০২২ করা হয়েছে। সম্প্রতি আইন মন্ত্রণালয়ে একটি মিটিং হয়েছে। সম্ভবত এক মাসের মধ্যে এই নতুন বিধিমালা জারি করা হবে। নতুন এই বিধিমালায় মহাপরিচালককে দেওয়া রিকমেন্ডেশনের অনেক কিছুই রয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য যে জিনিসগুলো বলা হয়েছে তা আমাদের মাথায় আছে। কার্যক্রম শুরু হলে অফিসিয়ালি আপনাদের জানানো হবে।’
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমরা আপনাদের দলেই সামিল। আমাদের কাছে আপনারা যে দাবি উপস্থাপন করেছেন, যে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েছেন সেটি গ্রহণ করে আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। আমি যথারীতি এটির ব্যবস্থা নেব। কিছু আমরা ইতোমধ্যে চিহ্নিত করেছি। এরপর যেখানে যা লাগবে সেখানে সেটি করব।’
‘পরিবেশ অধিদফতরের কাজ দুধারি তলোয়ারের মত। সাধারণ মানুষের অভিযোগ আমরা কোন কাজ করি না। রাস্তাঘাটে ময়লা, প্লাস্টিক দূষণ ইত্যাদি অনেক কিছু। আবার আমরা যখন এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করে পরিবেশের ছাড়পত্র দেই না, ছাড়পত্র বাতিল করি, মামলা করি তখন দেখা যায় তখন তারা অভিযোগ করে পরিবেশ অধিদফতর হচ্ছে বাংলাদেশের উন্নয়নের একমাত্র বাধা। তাদের বাধার কারণে অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে না। এই সমস্যার সমাধানও প্রধানমন্ত্রীর ‘গ্রিন ডেভেলপমেন্ট’ দর্শনের মধ্যে আছে অর্থাৎ পরিবেশকে রক্ষা করেই উন্নয়ন করতে হবে’, বলে জানিয়েছেন তিনি।
অধিদফতর নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে মনিরুজ্জামান বলেন, ‘স্রোতের বিপরীতে কাজ করতে পারে বলেই আমি পরিবেশ অধিদফতরের কর্মীদের পরিবেশের যোদ্ধা বলি। আমরা প্লাস্টকের অভিযান পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু এই দায় নিয়ে আমরা বসে যাইনি। আইনের ঘাটতি না থাকলেও অন্যান্য বিভিন্ন কারণে ঘাটতি ছিল। গত এক বছরের মধ্যে আমরা সেই ঘাটতি অনেকটাই পূরণ করেছি। এর আগে ২৬ টি জেলায় পরিবেশ অফিস ছিল যা বর্তমানে ৫০ টির উপরে করা হয়েছে। আগামী জুলাই আগস্টের মধ্যে আমরা প্রতিটি জেলায় পরিবেশ অফিস করতে পারবো।’
সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে সমাজবিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. দেবাশীষ কুমার কুন্ডু বলেন, সাম্প্রতিক একটি গবেষণা অনুযায়ী ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজার টন কঠিন (সলিড) বর্জ্য তৈরি হয়। কিন্তু নগর কর্তৃপক্ষ দুটো ফিল্ডের মাধ্যমে এর অর্ধেক বর্জ্য ডিসপোজাল করতে পারে। বাকি অর্ধেক পড়ে থাকে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করতে এই ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত যারা তাদেরকে লাভবান করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, পৃথিবী একটি হলেও সবার পৃথিবী একরকম নয়। ধনী মানুষ ও রাষ্ট্ররা সবচেয়ে বেশি বর্জ্য উৎপাদন করেন। ধনী রাষ্ট্রের বেহিসেবি জীবনের ফলাফল হল পরিবেশ দূষণ। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার রাজনৈতিক অর্থনীতি রয়েছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংস্কৃতির সঙ্গেই যুক্ত এবং এটা দৃষ্টিভঙ্গিরও বিষয়।
বারসিকের পরিচালক রোমাইসা সামাদ বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেবল কর্তৃপক্ষের দায় নয়। সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় পরিবেশ দূষণ কমানো সম্ভব।
ইউএসএআইডি প্রতিনিধি সুমনা বিনতে মাসুদ, কাউন্টারপার্ট ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধি মইনুদ্দীন আহমেদ, ইফফাত জেরিন। অনুষ্ঠানে ধারণাপত্র উত্থাপন করেন লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ। সেমিনারের শুরুতে শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন বারসিকের প্রজেক্ট ম্যানেজার ফেরদৌস আহমেদ ও সঞ্চালনা করেন কনসোর্টিয়াম কোর্ডিনেটর সানজিদা জাহান আশরাফি।
নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বিশিষ্ট কবি কামুরুজ্জামন ভূইয়া, পুরান ঢাকার নাগরিক উদ্যোগের নাজিম উদ্দিন, সুজনের কেমেলিয়া চৌধুরী, নাসফের সাধারণ সম্পাদক তৈয়ব আলী, বস্তিবাসী অধিকার সুরক্ষা কমিটির সভা প্রধান হোসনে আরা বেগম রাফেজা, জনউদ্যোগের তারিক হোসেন মিঠুল, এনবাসের হান্নান আখন্দ, ফাতেমা আক্তার, ইয়ুথ প্রতিনিধি শাহিনুর আক্তার, উজ্জল মাহমুদ।
সেমিনারের শুরুতে ঢাকা কলিং প্রকল্পের কাজ নিয়ে একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয় এবং বস্তিবাসী সংগঠনের প্রতিনিধিরা মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মনিরুজ্জামানের হাতে স্মারকলিপি তুলে ধরেন এবং পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক সৈয়দ নজমুল আহসানের হাতের আরেকটি পৃথক স্মারকলিপি তুলে দেন।
ইউএসএআইডি এর অর্থায়নে প্রোমোটিং অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড রাইটস (পার) কর্মসূচিটি কাউন্টারপার্ট ইন্টারন্যাশনাল এর কারিগরি সহযোগিতায় স্থানীয় সংস্থা দুঃস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্র (ডিএসকে) তার কনসর্টিয়াম সদস্যদের (বারসিক, কাপ ও ইনসাইট্স) নিয়ে ঢাকা কলিং প্রকল্প কাজ করছে। দুঃস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র (ডিএসকে), জাতীয় পরিবেশ পদকপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বারসিক, কাপ ও ইনসাইট্স যৌথভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করছে।
সেমিনার থেকে যে সুপারিশগুলো তুলে ধরা হয়:
১. ব্যক্তি, পরিবার ও কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
২. এলাকায় এলাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কমিটি করতে হবে এবং নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে।
৩. সিটি কর্পোরেশনে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কমিটিতে বস্তিবাসী প্রতিনিধি রাখতে হবে।
৪. গণমাধ্যমে বর্জ্যব্যবস্থাপনার সমস্যা এবং বস্তিবাসীদের ইতিবাচক ঘটনাগুলোও তুলে ধরতে হবে।
৫. বর্জ্যকে জিম্মি/ময়লার উছিলায় বস্তিবাসীকে জিম্মি করা যাবে না
৬. ময়লা নিতে এসে হুমকী দেওয়া যাবে না।
৭. যত্রতত্র রাস্তায় ও বস্তি এলাকায় বর্জ্য ফেলা যাবে না। নির্দিষ্ট স্টেশনে বর্জ্য ফেলতে হবে। বর্জ্য ভাগ করে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে।
৮. প্রতিমাসে কর্মকর্তাদের বস্তি ও স্টেশন মনিটরিং ও ভিজিট করতে হবে।
৯. বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করা ও বর্জ্যকে পুনরায় ব্যবহার করার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
১০. স্কুলের শিক্ষার্থী ও যুবদের সাথে সচেতনতামূলক কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হবে।
১১. জাতীয় বাজেটে সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তরিত করার পৃথক ও সুনির্দিষ্ট খাত বরাদ্দ করতে হবে।
১২. কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০২১ এবং ‘চিকিৎসা বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা ২০০৮ এর বিধানাবলী অনুসরণে সমাজভিত্তিক বর্জ্যব্যবস্থাপনা কার্যক্রমকে জোরদার করা সম্ভব। আর এই পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনাই আমাদের এক স্বাস্থ্যকর পরিবেশবান্ধব সবুজ আগামী উপহার দিতে পারে। সবাই মিলে এক পৃথিবীর স্বপ্ন বাস্তবায়নে কেবলমাত্র প্রাণ-প্রকৃতি সংরক্ষণ করলেই হবে না, পরিবেশবান্ধব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।