Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ডিসিবাংলো পার্ক নিয়ে প্রতিবেদনের জেরেই গ্রেফতার সাংবাদিক এলাহী

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
৮ জুন ২০২২ ১৩:২৭

রাঙ্গামাটি: রাঙ্গামাটির সাংবাদিক ফজলে এলাহীকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের গ্রেফতার করা হয়েছে। ডিসি বাংলো পার্ক নিয়ে জেলা প্রশাসন ও সাবেক এমপি কন্যার বিরোধ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের জেরেই হয়রানিমূলক মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে অভিযোগ করছেন সহকর্মীরা। সাংবাদিক ফজলে এলাহীকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে ক্ষোভ জানিয়েছে বিভিন্ন মহল। অবিলম্বে তার মুক্তির দাবিতে ঢাকা, রাঙ্গামাটিসহ বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচির ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে গ্রেফতারের পূর্বে নিজের ফেসবুক ওয়ালে দেওয়া স্ট্যাটাসে ফজলে এলাহী লিখেছেন, ফিরোজা বেগম চিনু ও তার মেয়ের মামলায় আমার বিরুদ্ধে গ্রেফতার ওয়ারেন্ট দেখিয়ে থানায় নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। সাংবাদিকতার এই প্রতিদান???
আমার মৃত্যুর জন্য চিনু ও তার মেয়েকে দায়ী করে গেলাম। রাঙামাটিবাসী এদের বিচার করিও।

২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর পার্বত্য অঞ্চলের অনলাইন দৈনিক পাহাড় টোয়েন্টিফোর ডটকমে ‘রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের “পাইরেটস বিড়ম্বনা!’ এমন শিরোনামে একটি প্রতিবেদন লেখেন সাংবাদিক ফজলে এলাহী। প্রতিবেদনে ডিসি বাংলো পার্কে অবস্থিত পাইরেটস নিয়ে জেলা প্রশাসনের বিড়ম্বনার সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরেন তিনি। মূলত: পাইরেটস এর স্বত্ত্বাধিকারী ছিলেন রাঙ্গামাটি জেলা মহিলা লীগ সভাপতি ও সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক এমপি ফিরোজা বেগম চিনুর মেয়ে নাজনীন আনোয়ার নিপূন। যদিও সেই পাইরেটস এর লিজ নিয়েছেন মোহাম্মদ হোসেন নামের এক ব্যক্তি; সাবলিজ নিয়েছিলেন চিনু কন্যা নাজনীন আনোয়ার নিপূন।

রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের অফিস আদেশের বরাত দিয়ে সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার সাহিদা আক্তারের সই করা অফিস আদেশে ১৩টি শর্ত উল্লেখপূর্বক জেলা শহরের দেবাশীষ নগরের বাসিন্দা মোহাম্মদ হোসেনকে ডিসি বাংলো পার্ক ও পার্ক সংলগ্ন লেকের অংশ পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ব্যবহার করার অনুমতি নির্দেশক্রমে প্রদান করা হলো। সেই ১৩টি শর্তের মধ্যে অন্যতম শর্ত ছিলো- ‘পার্কটি কোনরূপ উপ-ভাড়া বা সাবলিজ দিতে পারবেন না। যদি এমন প্রমাণ পাওয়া যায় যে, পার্কটি সাবলিজ দিয়েছেন তাহলে বিনানোটিশে কর্তৃপক্ষ উচ্ছেদ করতে পারবেন। প্রদত্ত অনুমতির মেয়াদ হবে দুই বছর, তবে কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনে ২ মাস পূর্বে নোটিশ প্রদান করে পার্কটির দখল গ্রহণ করতে পারবেন। আর ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে অনুমতি প্রদান কার্যকর হবে।’

বিজ্ঞাপন

সেই হিসাবেই ২০২০ সাল পর্যন্ত পার্কটি লিজ পান মোহাম্মদ হোসেন। তবে সেই নিয়মের ব্যত্যয় করেই সাবেক এমপি কন্যাকে সাবলিজ দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে মোহাম্মদ হোসেনের বিরুদ্ধে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীণ রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশিদ এই মেয়াদ বৃদ্ধিতে রাজি হননি। এরপর জেলা প্রশাসন উচ্ছেদের নোটিশ দেয় ভাড়া গ্রহিতাকে। এছাড়া এ পার্কেই জেলা মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক অভিযোগে দেশি-বিদেশি মদসহ গ্রেফতার করা হয় চারজনকে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৯ ও ২০২০ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক এ কে এম মামুনুর রশিদ ও তার কর্মচারীদের বিরুদ্ধে চারটি মামলা করেন নাজনীন আনোয়ার নিপূন। মামলাগুলো হলো- সিআর- ৫৮/২০১৯; পিটিশন- ১৫৩/২০১৯, সিভিল মামলা নং- ১৭৬/২০২০ ও সিআর- ১৬০/২০২০। আবার ‘ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক এ কে এম মামুনুর রশিদ কর্তৃক হয়রানির’ অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলনও করেন এমপি কন্যা নিপূন। এসব ঘটনা নিয়ে অসন্তোষ দেখা দেয় জেলা প্রশাসনে। বিব্রতকর জেলা প্রশাসন ও ডিসি পার্ক নিয়ে অনিয়মের দিকসমূহ উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রকাশের জেরে ক্ষুব্ধ হন ফিরোজা বেগম চিনু। এ ঘটনায় ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর ফজলে এলাহীর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫/১৯ ধারায় মামলা করেন নাজনীন আনোয়ার। এই মামলায় চট্টগ্রাম সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতের ২৮/২১ মামলার গ্রেফতারি ওয়ারেন্টে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় গ্রেফতার করা হয়েছে সাংবাদিক ফজলে এলাহীকে।

এদিকে গ্রেফতারের পর রাঙ্গামাটি কোতোয়ালী থানার ওসি কবির হোসেন জানান, ‘দুপুরে গ্রেফতার ওয়ারেন্ট আসার পর তাকে (ফজলে এলাহী) গ্রেফতার করা হয়েছে। আগামীকাল (আজ বুধবার) সকালে তাকে আদালতে প্রেরণ করা হবে।’ রাঙ্গামাটির পুলিশ সুপার মীর মোদদাছছের হোসেন বলেন, মামলার বিষয়ে বিস্তারিত কিছুই জানি না। আদালত থেকে একটি ওয়ারেন্টের পরিপ্রেক্ষিতে তাখে (ফজলে এলাহী) গ্রেফতার করা হয়েছে।

পাহাড়ের মেধাবী সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত ফজলে এলাহী দৈনিক পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পাহাড় টোয়েন্টিফোর ডটকমের সম্পাদকের দায়িত্বপালনের পাশাপাশি কাজ করছেন জাতীয় দৈনিক ও টেলিভিশনে। তিনি স্যাটেলাইট টেলিভিশন এনটিভির স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (রাঙ্গামাটি), দৈনিক কালের কন্ঠ, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি।

এদিকে, এ ঘটনায় সাংবাদিক ফজলে এলাহী স্ত্রী সেলিনা সুমি সারাবাংলাকে বলেন, দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে কলম কখনোই থামবে না। অন্যায় করে যারা ভাবে ক্ষমতা, পেশিশক্তি আর টাকার জোরে সব কিছুই সম্ভব। অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে ফেলা যায়, তাদের বিরুদ্ধে ফজলে এলাহীর কলম চলবেই। ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে এই জনপদের সব মানুষের অধিকার, প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় এই জনপদের ভবিষ্যত প্রজম্মকে সুন্দর পরিবেশের জন্য অন্যায়ের সাথে আপস না করে একজন ফজলে এলাহী লড়াই করে গেছে।

তিনি বলেন, এই লড়াইয়ে সে একাই পথ হেটেছে সঙ্গে যোগ দিয়েছে একদল মুক্ত মানুষ। তাই কালো আইন করে তাকে আপোষ করানো যাবে না। বরং ধীরে ধীরে যে সংবাদ প্রকাশে সে স্বার্থহীন সাহস দেখিয়েছে তার তদন্ত হোক। ক্ষমতা ও টাকার খেলায় এই জনপদের মানুষকে কিভাবে শোষণ করা হচ্ছে; তা বেরিয়ে আসুক সব সংবাদকর্মীর অনুসন্ধানি লেখনিতে। অন্যায়ের সঙ্গে কখনো আপোষ করা হবে না। একই সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দ্বারা মানুষকে হয়রানি বন্ধ করতে হবে। এই কালো আইন বাতিল করতে হবে।

ফজলে এলাহী যে পত্রিকার সম্পাদক সেই পাহাড় টোয়েন্টিফোর ডটকমের নির্বাহী সম্পাদক হেফাজত উল বারী সবুজ সারাবাংলাকে বলেন, এটি সংবাদ পত্রের স্বাধীনতার ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার। যে কারণে প্রথম থেকেই এই আইনের বিরোধীতা করে আসছে দেশের সাংবাদিক সমাজ। ঘটনার সূত্রপাত যদি বলি থাকে তাহলে ২০১৮ সালের দিকে জেলা প্রশাসক বাংলোর পাশ^স্থ পার্ক লীজ নেন জনৈক মোহাম্মদ হোসেন। যেখানে শর্তছিলো উপ ভাড়া দেয়া যাবে না এবং মেয়াদ হবে দুই বছর। এখানে নাজনীন আনোয়ার কোথা থেকে কিভাবে এলেন সে কারণটা আমার বোধগম্য নয়। সেই বিষয়ে নিউজ করতে ব্যক্তির পরিচয় দিতে গিয়ে কারও নাম আসলে কিভাবে সেটা মানহানি হয় সেটা বুঝতে পারছিনা। এই ঘটনাকে পুঁজি করেই দলের নাম ভাঙিয়ে প্রভাব বিস্তার করে গণমাধ্যমকর্মীদের হেনস্তা করা হচ্ছে। যা স্বাধীনভাবে সত্য তথ্য প্রকাশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। আমরা এ জঘন্যতম ঘটনার তীব্য নিন্দা জানাই এবং ফজলে এলাহীর মুক্তি চাই।

রাঙামাটি সাংবাদিক সমিতির সভাপতি জিয়াউল হক সারাবাংলাকে বলেন, সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে হয়রানি করতেই সাংবাদিক ফজলে এলাহীকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। আমরা তার মুক্তির দাবি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে মানুষকে হয়রানি বন্ধের দাবি জানাই। জিয়া বলেন, আজ সারাদেশের সাংবাদিক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। ফজলে এলাহীর পাশে দাঁড়িয়েছেন।

বিভিন্ন মহলের প্রতিবাদ ও কর্মসূচি ঘোষণা:
এদিকে, সাংবাদিক ফজলে এলাহীকে গ্রেফতারের পরপরই রাঙ্গামাটির কোতোয়ালী থানার উপস্থিত ছিলেন রাঙ্গামাটির গণমাধ্যমকর্মীসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ। এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে রাঙ্গামাটি রিপোর্টার্স ইউনিটি, সাংবাদিক সমিতি, ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টি, ব্যাচ ৯৪, খাগড়াছড়ি সাংবাদিক ইউনিয়নসহ খাগড়াছড়ি-বান্দরবানের সাংবাদিকরা। বুধবার সকাল দশটায় রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে রাঙ্গামাটিতে কর্মরত সাংবাদিকরা। এছাড়া এদিন সকাল ১১টায় খাগড়াছড়ির সাংবাদিক সমাজের ব্যানারের মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণঅ দেয়া হয়েছে।

অন্যদিকে একই ঘটনায় সাংবাদিক ফজলে এলাহীর মুক্তি ও জিডিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে বুধবার বিকাল ৪টায় শাহবাগে বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিয়েছে প্রগতিশীল গণসংগঠনসমূহ।

সারাবাংলা/এএম

ফজলে এলাহি

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

২ দিনে আয় ২৮৯ কোটি টাকা
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৮:৩২

মৌসুমী হামিদের সংসার যেমন চলছে
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৮:২৬

সম্পর্কিত খবর