ঢাকায় চার ধরনের ছিনতাইকারী চক্র, টার্গেট গরুর হাট: র্যাব
৮ জুন ২০২২ ১৬:৩৭
ঢাকা: রাজধানীতে চার প্রকার ছিনতাইকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে। আসছে ইদুল আজহায় গরুর হাটকে কেন্দ্র করে ছিনতাইয়ের মহাপরিকল্পনা করছিল তারা। এমন একটি চক্রের ৪৪ ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-৩)।
র্যাবের দাবি— গ্রেফতার ছিনতাইকারীরা সন্ধ্যার দিকে প্রস্তুতি নিতে থাকে। এরপর রাতভর এমনকি ভোর পর্যন্ত ছিনতাই কাজে জড়িত থাকে। এরা প্রয়োজনে ছুরিকাঘাত করে মুল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
বুধবার (৮ জুন) দুপুরে রাজধানীর টিকাটুলীতে র্যাব-৩ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন এ সব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘রাজধানীতে প্রতিদিন অসংখ্য যাত্রী ও পথচারী অজ্ঞানপার্টি ও ছিনতাইকারী কবলে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন। এছাড়া জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন অনেকেই। এসব ভুক্তভোগীদের বেশির ভাগই কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা নেন না। সংঘবদ্ধ অজ্ঞানপার্টি ও ছিনতাইকারী চক্রের তৎপরতা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। অজ্ঞানপার্টি ও ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যদের বেশিরভাগই মাদকাসক্ত। রমযান মাস থেকে এ পর্যন্ত ১৩২ জন ছিনতাইকারীসহ মলম পার্টির সদস্যদের গ্রেফতার করেছে র্যাব-৩।’
মঙ্গলবার (৭ জুন) রাতে রাজধানীর শাহবাগ, গুলিস্তান, ইত্তেফাক মোড়, হাতিরঝিল ও রমনা এলাকায় সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে সংঘবদ্ধ মলমপার্টি ও ছিনতাইকারী চক্রের মূলহোতাসহ মোট ৪৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
একটি গোয়েন্দা তথ্যের সূত্র ধরে সিও বলেন, ‘রাজধানীতে প্রতি মাসে ৩৫টি ছিনতাই সংঘটিত হচ্ছে। এই মুহূর্তে রাজধানীতে ২০০ স্পটে ৫০টি ছিনতাইকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে। চক্রের সদস্যরা ছিনতাইয়ের সময় বাধা পেলে মরণ আঘাত করতেও পিছপা হয় না। চলতি বছরের পাঁচ মাসে এ পর্যন্ত ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে আহত হয়েছেন শতাধিক ব্যক্তি। এসব ঘটনায় ৪১টি মামলা হয়েছে। ভুক্তভোগীদের অনেকেই আইনের আশ্রয় নিতে চান না।’
চার ধরনের ছিনতাইকারী সক্রিয়
চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন নামে পরিচিত। সালাম পার্টি, মলম পার্টি, অজ্ঞান পার্টি ও হ্যান্ডসেক পার্টি। তাদের ছিনতাই ও অপরাধের ধরনও আলাদা। তারা বিভিন্ন বিভিন্ন কৌশলে কাজ করে। তবে এই চক্রের সদস্যরা অধিকাংশই গার্মেন্টসকর্মী, সিএনজি চালক ও ইট ভাটার শ্রমিক। তারা সারাদিন কাজ করে রাতে সংগঠিত হয়ে এসব অপরাধ করছে।
আসন্ন ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে সংগঠিত হতে শুরু করেছিল এই সব অপরাধী চক্র। এছাড়া তারা বিভিন্ন গুরুর হাটকে টার্গেট করেই ছিনতাইসহ অন্যান্য অপরাধের পরিকল্পনা করছিল বলে জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।
গ্রেফতাররা হলো, মিজু, উজ্জল, স্বাধীন, জিসান, মাসুদ, রানা মিয়া, সোহেল মিয়া, মাহফুজ শেখ, আলামিন, পংকজ কুমার ভৌমিক, বিল্লাল, আব্দুল হালিম, জিসান শান্ত, রাজিব মৃধা, শামীম, মেরাজ, সুমন, রিপন মোল্যা, ফরহাদ, রিংকু, সজিব হোসেন, আরিফ হোসেন, বেলাল হোসেন, রবিন, সাগর, ইয়াছিন, শাকিল আহমেদ সুমন, জুয়েল রানা, সাদ্দাম শেখ, শাকিব মিয়া, শান্ত, আরিফ হোসেন, পারভেজ, জালাল, সোহাগ, রাব্বি, শামীম, আবু বক্কর সিদ্দিক, রাকিব, রানা, অলীমউদ্দিন শেখ, তারেক হোসেন, নুর ইসলাম ও আজিজ।
এ সময় তাদের কাছ থেকে পাঁচটি সুইচ গিয়ার, ৩টি চাকু, ৪টি ক্ষুর, ৩টি এন্টিকাটার, একটি তার, ২টি ব্লেড, ৪টি গামছা, ১৯টি বিষাক্ত মলম, ১৫টি মোবাইল ফোন, ১৪টি সীমকার্ড, ৭৬০ গ্রাম গাঁজা ও নগদ ১৪ হাজার ৬০৫টাকা উদ্ধার করা হয়।
ছিনতাইকারীদের টার্গেট
আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘রাজধানীর লঞ্চঘাট, বাসস্ট্যান্ড, রেল স্টেশন এলাকায় অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা ঘোরাফেরা করে। তারপর সহজ সরল যাত্রীদের টার্গেট করে কখনও তাদেরকে ডাব, কোমল পানীয় কিংবা পানির সঙ্গে বিষাক্ত চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করে। আবার কখনও যাত্রীবেশে লঞ্চ, বাস ও ট্রেনে চড়ে যাত্রীদের পাশে বসে তাদের নাকের কাছে চেতনানাশক ওষুধে ভেজানো রুমাল দিয়ে যাত্রীদের অজ্ঞান করে থাকে।’
সিও বলেন, ‘বিষাক্ত পানীয় সেবন করার, বিষাক্ত স্প্রের ঘ্রাণ নেওয়ার পর যাত্রী অজ্ঞান হয়ে পড়লে তার সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে তারা ভিড়ের মধ্যে মিশে যায়। এছাড়াও কখনও ভিড়ের মধ্যে যাত্রীদের চোখে-মুখে বিষাক্ত মলম বা মরিচের গুড়া বা বিষাক্ত স্প্রে করে যাত্রীদের যন্ত্রণায় কাতর করে সর্বস্ব কেড়ে নেয়। এরপর কোনো সহৃদয় ব্যক্তি অজ্ঞান ও অসুস্থ যাত্রীকে হাসপাতালে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে। চেতনানাশকের পরিমাণ বেশি হলে ওই ভুক্তভোগীর জ্ঞান ফিরতে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত লেগে থাকে। অজ্ঞানপার্টির শিকার ব্যক্তি শারিরীকভাবে দুর্বল ও বয়স্ক হলে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।’
অন্যদিকে ভুক্তভোগীর চোখে-মুখে বিষাক্ত মলম লাগানোর ফলে তার দৃষ্টিশক্তি চিরতরে হারানোর সম্ভাবনা থাকে। অজ্ঞানপার্টির শিকার ভুক্তভোগীর চেতনা না থাকায় তিনি পরিবারের সঙ্গে জ্ঞান ফেরার পূর্ব পর্যন্ত যোগাযোগ করতে পারেন না।
ছিনতাইকারীদের স্পট
খিলগাঁও মালিবাগ রেইল গেইট, দৈনিক বাংলা মোড়, পীরজঙ্গী মাজার ক্রসিং, কমলাপুর বটতলা, মতিঝিল কালবার্ট রোড, নাসিরের টেক হাতিরঝিল, শাহবাগ, গুলবাগ, রাজউক ক্রসিং, ইউবিএল ক্রসিং পল্টন মোড়, গোলাপ শাহর মাজার ক্রসিং, হাইকোর্ট ক্রসিং, আব্দুল গণি রোড, মানিকনগর স্টেডিয়ামের সামনে, নন্দীপাড়া ব্রিজ, বাসাবো ক্রসিং এলাকায় সন্ধ্যা হতে ভোর রাত পর্যন্ত ছিনতাইকারীদের তৎপরতা বেশি দেখা গেছে।
অন্যদিকে সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারীরা রাজধানীর বিভিন্ন অলি গলিতে উৎপেতে থাকে। সুযোগ পাওয়া মাত্রই তারা পথচারী, রিকশা আরোহী, যানজটে থাকা সিএনজি, অটোরিকশার যাত্রীদের ধারালো অস্ত্র প্রদর্শন করে সর্বস্ব লুটে নেয়। সন্ধ্যা হতে ভোর পর্যন্ত তুলনামূলক জনশূন্য রাস্তা, লঞ্চঘাট, বাসস্ট্যান্ড, রেল স্টেশন এলাকায় ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তাদের ছিনতাইকাজে বাধা দিলে তারা নিরীহ পথচারীদের প্রাণঘাতী আঘাত করতে দ্বিধা বোধ করে না।
এ সকল অজ্ঞানপার্টি ও ছিনতাইকারীদের আইনের আওতায় আনার ফলে পথচারীদের মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে। রাজধানীবাসী এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হতে রাজধানীতে আগত যাত্রীরা যাতে নিরাপদে দৈনন্দিন কাজকর্ম সম্পন্ন করে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে সংঘবদ্ধ অজ্ঞানপার্টি ও ছিনতাইকারী চক্রের বিরুদ্ধে র্যা বের সাড়াঁশি অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান র্যাব-৩ এর সিও।
গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে রাজধানীর খিলগাঁও থানায় একটি, মতিঝিল থানায় দুটি, পল্টন থানায় তিনটি, শাহবাগ থানায় দুটি ও শাহজাহানপুর থানায় দুটি মামলা দায়ের করেছে র্যাব।
সারাবাংলা/ইউজে/একে