রেকর্ড ঘাটতি নিয়ে আসছে ৬ লাখ ৭৮ কোটি টাকার বিশাল বাজেট
৮ জুন ২০২২ ২২:৫৮
ঢাকা: মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, ভর্তুকি মোকাবিলা এবং রেকর্ড ঘাটতির চ্যালেঞ্জ নিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য আসছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বিশাল বাজেট। ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’ শিরোনামের এই বাজেটে মোট আয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। আর বিদেশি অনুদান হিসাবে নিয়ে বাজেট ঘাটতি থাকছে ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। আকারের দিক থেকে যেমন এই বাজেট নতুন রেকর্ড গড়ছে, তেমনি এর আগের কোনো বাজেটে ঘাটতির পরিমাণও এত বেশি ছিল না।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার (৯ জুন) অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে এই বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন। এটা স্বাধীন বাংলাদেশের ৫২তম, বর্তমান সরকারের টানা ১৪তম এবং অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের চতুর্থ বাজেট। রেওয়াজ অনুযায়ী এ বছরও বৃহস্পতিবারেই সংসদে বাজেট উত্থাপন করা হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আসছে বাজেটের আকার প্রথমবারের মতো সাত লাখ কোটি টাকা করে একটি সম্প্রসারণমুখী বাজেট করার ইচ্ছা ছিল সরকারের। তবে কোভিড-১৯ পরবর্তী পরিস্থিতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবের কারণে সেই ইচ্ছা ও পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে সরকার।
সূত্র বলছে, এই দুই সংকটের প্রভাব সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পড়ছে। এ কারণে আগামী অর্থবছরে পর্যাপ্ত অর্থের সংস্থান করা সম্ভব হবে না বলে মনে করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তাই সম্প্রসারণমুখী বাজেটের পরিবর্তে অনেকটা সংকোচনমুখী বাজেট প্রণয়নে মনোনিবেশ করা হয়েছে। চলমান দুই সংকটের প্রভাব থেকে নাগরিকদের সুরক্ষায় এই বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে খাদ্যপণ্য, জ্বালানি ও ভোজ্যতেলের দাম সহনীয় রাখতেও বিভিন্ন পদক্ষেপ থাকছে এই বাজেটে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আসছে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটটি চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে ৭৪ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা বা ১২ দশমিক ৩২ শতাংশ বেশি। আর সংশোধিত বাজেটের চেয়ে এটি ৮৪ হাজার ৫৬৪ কোটি বা ১৪ দশমিক ২৪ শতাংশ বেশি। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। তবে সংশোধিত বাজেটে তা ১০ হাজার ১৮১ কোটি টাকা কমে পাঁচ লাখ ৯৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নেমে আসে।
সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত আগামী বাজেটে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি থাকছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। তবে বাজেট ঘাটতি পূরণে ৩ হাজার ২৭১ কোটি টাকা বিদেশি অনুদান পাওয়া যাবে। সেক্ষেত্রে বাজেট ঘাটতি নেমে আসছে ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকায়।
বাজেটের এই ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির সাড়ে ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ছিল দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬ দশমিক ১ শতাংশ। তবে সংশোধিত বাজেটেও ঘাটতি ধরা হয় ৫ দশমিক ১ শতাংশ।
বাজেটের আয় যেভাবে আসবে
আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে মোট আয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা, চলতি অর্থবছরে যা ছিল তিন লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। মোট রাজস্ব আয়ের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে আদায় করা হবে তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর-বহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব আদায় করা হবে ১৮ হাজার কোটি টাকা।
এছাড়াও আগামী বাজেটে কর ছাড়া প্রাপ্তি থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরে এনবিআর খাতে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্য নির্ধারিত রয়েছে তিন লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এছাড়াও আগামী অর্থবছরে বাজেটে ৩ হাজার ২৭১ কোটি টাকা বিদেশি অনুদান পাওয়া যাবে বলে উল্লেখ থাকছে।
বাজেটে যেভাবে ঘাটতি পূরণ করা হবে
আগামী অর্থবছরের বাজেটে মোট ঘাটতি থাকছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এই ঘাটতি মোট বাজেটের ৩৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। এই বিশাল ঘাটতি বাজেট পূরণের সরকার অভ্যন্তরীণ ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়া হবে ৯৫ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। আর ব্যাংক বহির্ভূত খাত থেকে ঋণ নেওয়া হবে ৪০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করেও ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হবে।
এদিকে, ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের মধ্যে দীর্ঘ মেয়াদি ঋণের পরিমাণ ৬৮ হাজার ১৯২ কোটি টাকা এবং স্বল্প মেয়াদি ঋণের পরিমাণ ৩৮ হাজার ১৪২ কোটি টাকা। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারের ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৮৭ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)
আগামী অর্থবছরের জন্য এডিপি’র আকার ধরা হয়েছে দুই লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এডিপি’র আকার ছিল দুই লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে দুই লাখ ৯ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।
বাজেটে জিডিপি আকার ও মূল্যস্ফীতি
আগামী অর্থবছরে জন্য জিডিপি’র আকার প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪৪ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। অন্যদিকে আগামী অর্থছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে।
ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয় ৩ লাখ টাকা বহাল থাকছে
আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ছে না। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের মতো আগামী বাজেটেও করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ বহাল থাকছে। ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়লেও আগামী বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের জন্য নতুন কোনো সুখবর নেই। আগের নিয়মেই বছরে ৩ লাখ টাকার বেশি আয় হলে আয়কর দিতে হবে।
বাজেটে করপোরেট কর কমছে
আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে উদ্যোক্তাদের নতুন বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে করপোরেট কর ২ থেকে আড়াই শতাংশ কমানো হচ্ছে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত ও তালিকা বর্হিভূত উভয় কোম্পানির ক্ষেত্রে এ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে প্রতিবন্ধী ছাড়া কারও ভাতা বাড়ছে না
আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে প্রতিবন্ধী ভাতা ছাড়া অন্যদের ভাতা বাড়ছে না। বর্তমানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা মাসে ভাতা পান ৭৫০ টাকা। আগামী বাজেটে তা ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৮৫০ টাকা করার প্রস্তাব করা হচ্ছে।
আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী খাতের আওতায় ১২৩টি কর্মসূচি রয়েছে। এগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করছে ২৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। এগুলোর মধ্যে ৮টি কর্মসূচি হচ্ছে নগদ ভাতা, ১১টি খাদ্য সহায়তা।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ছাড়াও বয়স্ক ভাতা, স্বামী নিগৃহীতা, বিধবা, দরিদ্র মা’র মাতৃত্বকালীন ভাতা, শহিদ পরিবার ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও সম্মানি ভাতা, হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ভাতা রয়েছে। গত তিন অর্থবছর ধরে উপকারভোগীরা মাসে ৫০০ টাকা হারে ভাতা পাচ্ছেন। আগামী অর্থবছরে একই পরিমাণ ভাতা দেওয়া হবে।
পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ
আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে। এ খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৭০ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। এই খাতে বরাদ্দ ৩৯ হাজার ৪১২ কোটি টাকা।
এছাড়া শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ২৯ হাজার ৮১ কোটি টাকা, গৃহায়ন ও কমিউনিটি সুবিধা খাতে বরাদ্দ ২৪ হাজার ৪৯৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। আর পঞ্চম সর্বোচ্চ খাত হিসাবে বরাদ্দ পাচ্ছে স্বাস্থ্য খাত। এই খাতে বরাদ্দ থাকছে ১৯ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা।
সারাবাংলা/জিএস/টিআর
২০২২-২৩ অর্থবছর ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বাজেট বাজেট ২০২২-২০২৩ বাজেট উত্থাপন