স্বাস্থ্যে বরাদ্দ যাই থাকুক, খরচ করার সক্ষমতা নিয়েই প্রশ্ন
১০ জুন ২০২২ ২৩:১৮
ঢাকা: ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ ছিল ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। সে হিসাবে আগামী অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ বাড়ছে চার হাজার ১৩২ কোটি টাকা বা ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ বেশি।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের মূল বাজেট থেকে আগামী বছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার বেড়েছে ১২ দশমিক ৩২ শতাংশ। সে হিসাবে মূল বাজেটের তুলনায় স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের অনুপাত আগের অর্থবছরের তুলনায় কিছুটা হলেও বেড়েছে। তবে স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বরাদ্দের পরিমাণ নিয়ে চিন্তা না করে এই খাতের বরাদ্দ বাড়ানোর দিকে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। কেননা দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। ওই সময় এই খাতে যে পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, গত দুই অর্থবছরে দক্ষতা ও পরিকল্পনার অভাবে তার অধিকাংশই খরচ করতে পারেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষতা ও পরিকল্পনার অভাবে বাজেট বরাদ্দ খরচ না করতে পারাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা হিসেবেই দেখতে হবে। সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যয়ের সক্ষমতা না বাড়াতে পারলে বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে তেমন লাভ হবে না। তারপরও যে পরিমাণ বাজেট বাড়ানো হয়েছে, তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে সেই পরিমাণও বাড়ানো প্রয়োজন।
বৃহস্পতিবার (৯ জুন) জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উত্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে এই বাজেট পেশ করেন তিনি।
স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রস্তাবিত এই বাজেটে এই খাতের জন্য নতুন কিছু নেই। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে দীর্ঘ মেয়াদি ও টেকসই বিনিয়োগের বিষয়টিও বাজেটে সঠিকভাবে গুরুত্ব পায়নি
গত পাঁচ বছরে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের হার
দেশে ২০১৭-১৮ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বরাদ্দ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মোট বাজেটের অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের হার ৬ শতাংশের নিচেই থাকছে। দেশের বর্তমান স্বাস্থ্য পরিস্থিতি ও চিকিৎসা ব্যয়ের বিবেচনায় স্বাস্থ্য খাতের জন্য জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখা উচিত বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে দেখা যায় বরাদ্দের হার এবারও ছয় ছতাংশের নিচেই থাকছে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দের হার ছিল পাঁচ দশমিক দুই শতাংশ।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই হার কমে আসে। এই অর্থবছরে দেশে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দের হার হয় চার দশমিক আট শতাংশ।
২০১৯-২০ অর্থবছরে সেই হার আরও কমে আসে। এই অর্থবছরে মোট জাতীয় বাজেটের চার দশমিক দুই শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়।
কোভিড-১৯ সংক্রমণ পরিস্থিতিতে বাড়ে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দের হার। আর তাই ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট বাজেটের পাঁচ দশমিক আট শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয় স্বাস্থ্যখাতে।
২০২১-২২ অর্থবছরে মোট বাজেটের তুলনায় বরাদ্দ দেওয়ার হার ছিল পাঁচ দশমিক দুই শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরেও প্রস্তাবিত বাজেটে মোট বাজেটের তুলনায় বরাদ্দ দেওয়ার হার হয়েছে পাঁচ দশমিক চার শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবারের প্রস্তাবিত বাজেটেও ব্যয় বৃদ্ধি বিবেচনায় স্বাস্থ্যখাতের বৃদ্ধির হার কম। তবে এই খাতে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা না থাকার কারণে বাজেট খরচ না করতে পারার যে ধারাবাহিকতা আছে— তা থাকলেও বৃদ্ধি করেও লাভ নেই। ২০২১-২২ অর্থবছরে যে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্যখাতে তার মাত্র ৪১ শতাংশ ব্যয় করতে পেরেছে মন্ত্রণালয়। অর্থাৎ প্রায় ৫৯ শতাংশই ফেরত যাওয়ার সম্ভাবনা এবারও। মূলত স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের এই খাত নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও দক্ষ জনবল না থাকার ব্যর্থতার কারণে এগুতে পারছে না দেশের স্বাস্থ্যখাত।
প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে বিশেষজ্ঞদের ভাবনা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগের অর্থবছরগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনা করা হয়েছে। এর ফলে হয়তবা স্বাস্থ্য খাতেরস্বল্পমেয়াদী ও তাৎক্ষণিক কিছু প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হতে পারে। তবে তা দীর্ঘমেয়াদে সমাধান আনবে না। এই অর্থবছরের দেখা গেছে আগের অর্থবছরের তুলনায় টাকার অঙ্ক কিছুটা বাড়িয়ে বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এটি আগেও করা হয়েছে।
গত দুই বছরের দেশের স্বাস্থ্যখাতের যে চিত্র উঠে এসেছে তাতে কিন্তু সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কথা ছিল বাজেটে। কিন্তু অন্যান্য বছরের মতোই উপেক্ষা করে স্বাস্থ্যখাতের বাজেট শুধুমাত্র গাণিতিক সংখ্যার পরিবর্তন ছাড়া অন্য কিছু নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ‘প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে তেমন কোনো নতুনত্ব নেই। কিছু প্রকল্প সম্প্রসারণের বিষয় প্রস্তাবনায় থাকলেও এতে কোনো চমক নেই। যে গাণিতিক সংখ্যা বলা হচ্ছে বৃদ্ধি হিসেবে তা মূলত ক্রমবর্ধমান ব্যয় এবং মুদ্রাস্ফীতির ব্যবস্থা মেটাতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘গত দুই বছরে করোনা মহামারিতে দেশের স্বাস্থ্যখাতের প্রকৃত চিত্র উঠে এসেছে নানাভাবে। কিন্তু সেই স্বাস্থ্যখাতকে পরিকল্পনার সঙ্গে ঢেলে সাজানোর কোনো ইঙ্গিত নেই প্রস্তাবিত বাজেটে। তাছাড়া সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো প্রস্তাবনাও দেখা যায়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আগের বছরের বাজেটের চেয়ে পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ বাড়িয়ে পরের বছরের বাজেট তৈরি করা হয়। দেখা গেল অনেক খাতে বরাদ্দ বাড়ছে কিন্তু সেখানে ব্যয়ের সক্ষমতা ও দক্ষতা নেই। বাজেট অব্যবহৃত থেকে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ কিন্তু এই সক্ষমতা ও দক্ষতা না থাকা। আর তাই এসব বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে বাজেট বিষয়ে ভাবতে হবে।’
অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ‘স্বাস্থ্য বাজেটের উন্নয়ন অংশের ব্যয় নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে কেনাকাটার বিষয়ে আটকে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের দক্ষতা কম। তাদের প্রশিক্ষণের ঘাটতি আছে, এ সব বিষয়ে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে আছি। এ সংক্রন্ত নিয়মকানুনেও গলদ আছে। সমস্যা আছে অডিট বা নিরীক্ষণে। সঠিক কাজটা কী করা উচিত, সেটি করছে না।’
স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে সংস্কারে হাত দিতে হবে না কি, স্বাস্থ্য খাত সংস্কার করার পর সেই অনুযায়ী বরাদ্দ দিতে হবে? —এই প্রশ্নের উত্তরটাও ভাবা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন সৈয়দ আবদুল হামিদ।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, ‘দেশের স্বাস্থ্যখাতে সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। এটা করতে না পারলে দেশের জনগণের যথাযথ স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত সম্ভব নয়। একইসঙ্গে নীতি ও পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে ভাবতে হবে। নতুবা দেখা যাবে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হলেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা তো অবশ্যই বেশি বরাদ্দের দাবি জানাই। দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতির জন্য এটা প্রয়োজন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রতি অর্থবছরে যে হারে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে সেটিই খরচ করতে পারছে না। কেন পারছে না?-সেটার উত্তর খুঁজে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে পরিকল্পনার সঙ্গে বাজেট খরচ করতে পারার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। নতুবা বাজেট যাই হোক না কেন সেটা কোনো উপকারে নাও আসতে পারে দেশের জন্য।’
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) এর মহাসচিব ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাজেট বাড়িয়ে কী লাভ যদি সেটা খরচ করতে পারার দক্ষতা না থাকে? আমাদের বাস্তবতা হচ্ছে— যারা স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বরাদ্দ এবং ব্যয় করেন, তাদের যথেষ্ট পরিমাণ অভিজ্ঞতা কিংবা দক্ষতা নেই। তাই বাজেট বাড়ালেই হবে না। বরং বরাদ্দ খরচ করার জন্য ব্যবস্থাপনায় ও যথাযথভাবে ব্যয়ের পরিকল্পনায় সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণেরও প্রয়োজন রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘দুর্নীতির অনেক বিষয়ও সামনে আসে এ অদক্ষতার কারণে। এটি সমাধানে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। আর তাই আমি মনে করি, শুধুমাত্র স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বৃদ্ধি নয়; সেই বাজেটগুলো সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে কিভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দৌড়গড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া যায় সেই পরিকল্পনা করার জন্য দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য দেশে-বিদেশে বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যাপক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন।’
সারাবাংলা/এসবি/একে