Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘সেতু চালু অইলে হাঁইট্যা ওই পারে যামু, আবার ফিরা আসমু’

শেখ জাহিদুজ্জামান,স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১২ জুন ২০২২ ০৯:৫৪

ঢাকা: মুন্সিগঞ্জের মাওয়া মোড়। উৎসবের আমেজ যেন এখনই শুরু হয়েছে। চায়ের দোকানে বসে খোশ-গল্পে মশগুল এলাকার মানুষ জন। তাদের চোখে মুখে একেকটি স্বপ্নের ডানা মেলার গল্প। সেই গল্পে নদীর ভাঙ্গা-গড়া আছে। আছে পদ্মার সঙ্গে মানুষের টিকে থাকার গল্প। কিন্তু গল্পের মূলে কেবল একটিই প্লট প্রাধান্য পাচ্ছে; সেটি হলো- পদ্মা সেতু। এই সেতু নিয়ে অভিমত জানতে চাইতেই এলাকার বয়োবৃদ্ধ আলতাব মোল্লার কথায়ে যেন পদ্মার ঢেউ খেলে গেল। সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে তিনি বললেন, ‘শেখের বেটির সাহস আছে। কত কি অইলো পদ্মা নিয়া। পদ্মায় সেতু হওয়া নিয়্যা কত শঙ্কা ছিল। সেই সেতু এহন বাড়ি থিকা দেহা যায়। সেতু চালু অইলে হাঁইট্যা ওই পারে যামু, আবার হাঁইট্যা এই পারে আসমু। নাতিরে বলছি নিয়্যা যাইতে।’

বিজ্ঞাপন

বলতে থাকেন বৃদ্ধ আলতাব মোল্লা, ‘বাবারে, এই পদ্মার কত রূপ যে দেকছি। কত বাড়ি চইল্যা গেছে নদীতে। এহন সেইহানে কত বড় বড় পিলার। উপরে গাড়ি চলব। ভাবা যায়! শেখের বেটিরে আমার প্রাণভরা দোয়া।’

বহুল প্রতীক্ষিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তবে রূপ নিয়েছে। সব প্রস্তুতি ইতোমধ্যে শেষ। সেতুতে আলোও জ্বলছে। এখন শুধু অপেক্ষা উদ্বোধনের। সেই দিনক্ষণও চূড়ান্ত। ২৫ জুন দুয়ার খুলছে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ দেখছে নতুন সম্ভাবনার স্বপ্ন। আর পদ্মা পাড়ের মানুষের সামনে জীবন বদলানোর সুযোগ। তাদের মতে, পদ্মা সেতু ভাগ্য বদলানোর সেতু। যে সেতু আমূল পরিবর্তন আনবে পদ্মা পাড়ের মানুষের জীবনে।

সম্প্রতি পদ্মা পাড়ের মাওয়া অংশের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার এই প্রতিবেদকে। এসব বাসিন্দারা মনে করেন, পদ্মা সেতু শুধু সেতুই নয়। পদ্মা পাড়ের প্রতিটি মানুষের স্বপ্নের সঙ্গে মিশে আছে এই সেতু। ব্যবসায়িক ভাবনা থেকে শুরু করে এই সেতু জীবনের একটি অংশ। পদ্মার ঢেউ আর স্রোতের ভয়ংকর রূপ যাদের নিত্যদিনের সঙ্গী তারাই এখন এই পদ্মা সেতু ঘিরে নানা স্বপ্নে বিভোর।

পদ্মা পাড়ে কথা হয় মাওয়া ঘাটের বাসিন্দা এবং অস্থায়ীভাবে গড়ে ওঠা বসুমতি হোটেলের মালিক জিল্লু রহমানের সঙ্গে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এই পদ্মার কত রূপ দেখেছি ছোটবেলা থেকে। তার হিসাব নেই। জন্মের পর থেকেই নদী ভাঙন। প্রতিবার ভাঙন যেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধ করেই পদ্মা পাড়ে টিকে আছি। কখনো চিন্তায় আসেনি এখানে সেতু হবে। এই সেতু ঘিরে আমাদের স্বপ্ন তৈরি হবে। কিন্তু আজ সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। আমরা অনেক খুশি।’

বিজ্ঞাপন

কিন্তু কেন? এমন প্রশ্নে জিল্লু বলেন, ‘এই সেতু দেখতে শুধু দেশের মানুষ নয়, বিদেশ থেকেও পর্যটক আসবে। আমাদের দোকান আছে পদ্মা পাড়ে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ইলিশ খেতে এসে পদ্মা নদীতে ঘোরে। এখন ঘোরার পাশাপাশি সেতু দেখবে। এখানে নানান রকমের হোটেল গড়ে উঠবে। ব্যবসায়িক কেন্দ্র হবে। সবকিছু মিলে পদ্মা সেতু আমাদের জীবন বদলে দেবে। বদলে যাবে পদ্মা পাড়ের মানুষের জীবন।’

পদ্মা পাড়ের আরেক বাসিন্দা নাসির আলী। দীর্ঘদিন ধরে পান-বিড়ি বিক্রি করেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমরা ভ্যাগ্যবান। এই পদ্মা সেতু হওয়ায় এখানে অনেক কিছুই নতুন করে হবে। কারখানা থেকে শুরু করে নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হবে। আমাদের নতুন কর্মসংস্থান হবে। এলাকার বেকার যুবকদের কাজ হবে। আমরা অনেক আনন্দিত। এই সেতু আমাদের ভাগ্য বদলে দেবে।’

স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিয়ে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া পাড়ে এমন অভিব্যক্তি প্রতিটি বাসিন্দাদের। তাদের চোখে মুখে হাজারো স্বপ্ন। এখন তারা দিন ক্ষণ গুনছেন সেতুটির উদ্বোধনের জন্য। এদিকে, পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের কাজ ইতোমধ্যে শেষ। আর এই সেতুকে ঘিরে উন্নয়নমূলক মহাকর্মযজ্ঞ চলছে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও ফরিদপুরসহ আশপাশের জেলাগুলোতেও।

অপরদিকে, পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে পদ্মাপাড়ে হবে তাঁতপল্লী এবং আইটি পার্ক। ইতোমধ্যে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় আইটি পার্ক গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের পাশে শিবচরের কুতুবপুরের কেশবপুরে ‘শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি অ্যান্ড হাইটেক পার্ক’ নির্মাণে ৭০ একর জায়গা নির্ধারণ করেছে আইসিটি মন্ত্রণালয়। এর বাইরে শেখ হাসিনা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, শেখ রাসেল শিশু পার্ক, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব নার্সিং ইনস্টিটিউট অ্যান্ড কলেজ, আইএইচটি ভবন, ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, শিল্পকলা একাডেমি ভবন, মুক্তমঞ্চ ও অলিম্পিক ভিলেজ হবে।

এ ছাড়া পদ্মা সেতুর নিরাপত্তায় সেতুর দুই প্রান্তে পদ্মা সেতু উত্তর থানা ও পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানা নামে দুটি থানা স্থাপন করা হয়েছে। সেতুর জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার আওতায় থাকবে পূর্ব নাওডোবা ও পশ্চিম নাওডোবা নামে দুটি ইউনিয়ন। অন্যদিকে, মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতু উত্তর থানার আওতায় থাকবে মেদিনীমণ্ডল ও কুমারভোগ নামে দুটি ইউনিয়ন।

সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতুর (মূল সেতু) দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দুই প্রান্তের উড়ালপথ (ভায়াডাক্ট) ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে সেতুর দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে প্রথম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় পদ্মাসেতু। এরপর পর একে একে ৪২টি পিলারে ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যানবসিয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়েছে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর।

মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) ও নদী শাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন। দু’টি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণকরেছে বাংলাদেশের আবদুল মোমেন লিমিটেড। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হয়েছে এ সেতুটি।

উল্লেখ্য, ২০০৭ সালের আগস্টে পদ্মা সেতুর প্রকল্পের অনুমোদন দেয় তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তখন পদ্মা সেতুর ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। সর্বশেষ সেই ব্যয় গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। দ্বিতল এই সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল করবে আর নিচ দিয়ে চলাচল করবে রেল। যদিও রেললাইনের কাজ এখনো শুরু হয়নি। পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন চালু হওয়ার পর সেতু কর্তৃপক্ষ রেললাইন বসানোর জন্য রেল কর্তৃপক্ষকে সেতুটি বুঝিয়ে দেবে আসছে জুলাইয়ে। আর সেতুর ওপর রেললাইন বসাতে ছয় মাসের মতো সময় লাগবে বলে জানা গেছে।

সারাবাংলা/এসজে/পিটিএম

পদ্মা সেতু মাওয়া মোড়

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর