সৌদি খেজুরে সফল জাহিদুল, পুরো গ্রামই আজ নার্সারি
১৩ জুন ২০২২ ০৮:১১
গাইবান্ধা: পৈতৃক সম্পত্তি ছিল সাকুল্যে এক বিঘা জমি। তাতে ধান চাষ করলে থাকত সবজির অপূর্ণতা। আবার সবজি চাষ করলে জুটতো না দু’বেলা দু’মুঠো ভাত বছর জুড়ে। এমন অভাব আর টানপোড়েন পরিস্থিতিই তাকে বাধ্য করে সামান্য একখণ্ড জমি থেকে অধিক অর্থকরী ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে। আর এই লক্ষ্যেই আড়াই যুগের পরিশ্রম আর একাগ্রতা আজ তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করেছে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে।
‘অভাবই আমাকে শিখিয়েছে অভাব তাড়ানোর মন্ত্র’ গর্বের সঙ্গে উচ্চকণ্ঠে এই কথা বলা মানুষটির নাম জাহিদুল ইসলাম। নিজের ছোট্ট জমিতে গড়ে তোলা নানা বিদেশি ফলের গাছের চারা উৎপাদনের নার্সারি এখন ১৮ বিঘা জমির এক বিশাল চারা ও নতুন নতুন জাতের ফলের সাম্রাজ্য। চারা ও ফল বিক্রি করে প্রতি বছর তার আয় এখন প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার গুমানিগঞ্জ ইউনিয়নের কুষ্ণপুরছয়ঘড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা ৫০ বছর বয়সী এই মানুষটির নার্সারিতে কাজ করে অভাব ঘুচিয়েছে আরও অনেক পরিবার। তার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ওই এলাকার আরও অনেকগুলো নার্সারি গড়ে ওঠায় ইতোমধ্যে গ্রামটি নার্সারি গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বর্তমানে ওই এলাকার শতাধিক বিঘা জমিতে ছোট-বড় প্রায় অর্ধশত নার্সারি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
স্ত্রীর নামে নামকরণ করা নার্গিস নার্সারির মালিক জাহিদুল ইসলাম গর্বের সঙ্গে জানান, তার বা ওই গ্রামের নার্সারির নতুন জাতের ফলের চারা ছাড়া রাজধানী ঢাকায় প্রতি বছর অনুষ্ঠিত জাতীয় বৃক্ষমেলা পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় না। বিদেশি উন্নতজাতের জাপানি মিয়াজাকি, কিং অব চাকাপাত, চাইনিজ চ্যাঙমাই, আমেরিকান পালমার, ব্রুনাইয়ের ব্রুনাই কিংসহ ১০-১২টি নতুন প্রজাতির আমের সঙ্গে এবার তার নার্সারিতে ফলেছে সৌদি জাতের খেজুর। এ বছর নার্সারির চারা গাছে উৎপাদিত শুধু নতুন জাতের আমই বিক্রির লক্ষ্য ধরেছেন তিনি ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা।
গত শনিবার (১১ জুন) গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমের গ্রাম কুষ্ণপুরছয়ঘড়িয়া গ্রামে সৌদি জাতের খেজুর ফলনের খবর সংগ্রহে গিয়ে এসব জানা যায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে এ খেজুরের কথা জানা গেলেও রংপুর বিভাগে জাহিদুল ইসলামের নার্সারিতেই প্রথম এ খেজুর ফলেছে বলে তিনি দাবি করেন।
নার্গিস নার্সারির মালিক জাহিদুল ইসলাম জানান, আড়াই যুগেরও বেশি সময় ধরে নতুন নতুন জাতের নানাপ্রকার ফলের চারা ও ফল উৎপাদনের অংশ হিসেবেই তিনি ১০ বছর আগে আজওয়া, বারিহি, সুপকারি, বড়াইসহ কয়েকটি প্রজাতির খেজুরের বীজ রোপণ করেন। বস্তার বেডে লাগানো চারাগুলোতে ৯ বছরেও ফুল না আসায় গত বছর তিনি ওই ২৫০টি চারা তুলে মাটিতে নতুন করে রোপণ করেন। এ বছর এর মধ্যে ১২টি চারায় ফুল আসে। পাশাপাশি প্রায় সব চারার গোড়া থেকেই পার্শ্ব চারা বের হয়েছে বেশ কয়েকটি করে।
বর্তমানে তিনি পার্শ্ব চারাগুলো বিক্রির জন্য প্রস্তুত করছেন। বীজের চারার চেয়ে এসব পার্শ্ব চারায় নিশ্চিতভাবে খেজুর ফলবে বলে তিনি আশাবাদী। ছোট ছোট এবং গোলাকৃতির সবুজ খেজুরের ভারে নুয়ে পড়া ৫-৬টি গাছের সৌদি খেজুর দেখতে এখন প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসছে বলে তিনি জানান।
তার আম এবং মিশ্র ফলের চারার নার্সারিতে গিয়ে দেখা যায়, ছোটবড় বিভিন্ন আকারের প্রায় সহস্রাধিক আমের চারায় বিভিন্ন রঙের অসংখ্য আম ফলে আছে। পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষায় কোনো রাসায়নিক ব্যবহারের বদলে প্যাকেট দিয়ে ঢেকে রেখেছেন অধিকাংশ আম। এর মধ্যে রয়েছে পৃথিবীর সবচাইতে দামি আম হিসেবে খ্যাত জাপানি মিয়াজাকি বা সূর্যডিম, প্রায় ২ কেজি ওজনের ব্রুনাই কিং, পাকা কলার মত আকার ও রংয়ের থাই বানানা জাতেরসহ বিভিন্ন প্রজাতির আমের চারা রয়েছে।
তিনি জানান, প্রতিটি চারায় ৫-৭টি করে ঝুলন্ত আমসহ এসব চারা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে কিনে নিয়ে যান পাইকাররা। বর্তমানে জাত এবং প্রকারভেদে প্রতিটি চারা ৩০০ থেকে ৫ হাজার টাকা দামে বিক্রি করা হচ্ছে।
জাহিদুল ইসলাম আরও জানান, কিছুটা বড় চারা গাছ থেকে প্রথমে সায়ান (চারা তৈরির জন্য গাছের ছোট ডাল), এরপর ফল এবং শেষে চারা বিক্রি করা হয়। নার্সারি পণ্য হিসেবে একটি চারার বহুমুখী ব্যবহারের ফলে তাদের কয়েক গুণ বেশি আয় হয়। এখানকার সব নার্সারি মালিকই এখন এ পদ্ধতিতেই ব্যবসা করছেন।
নার্গিস নার্সারির কর্মী সজিব মিয়া বলেন, ‘আমিসহ এ নার্সারিতে ১৫ থেকে ২০ জন মানুষ সারাবছর কাজ করে। এলাকায় কোনো মানুষ আর বেকার নাই এখন।’
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সৈয়দ রেজা-ই-মাহমুদ জানান, প্রচণ্ড আত্মপ্রত্যয়ী এবং আধুনিক চাষি জাহিদুল ইসলাম এখন ওই এলাকার নার্সারি পেশার মানুষদের আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তাকেসহ ওই এলাকার সব নার্সারি মালিককে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে।
সারাবাংলা/এমও