পাচার করা টাকা কর দিয়ে ফিরিয়ে আনার প্রস্তাবের সমালোচনা সংসদে
১৩ জুন ২০২২ ০০:২১
ঢাকা: বাজেটে বিদেশে পাচার করা টাকা কর দিয়ে ফেরত আনার যে সুযোগ বাজেটে প্রস্তাব করা হয়েছে, তার ব্যাপক সমালোচনা করেছেন বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যরা। তারা বলছেন, এভাবে পাচার করা টাকা ফেরত আনার সুযোগ দিলে মানুষ অবৈধভাবে উপার্জনের প্রতি আগ্রহী হবে। কোনোভাবেই এই সুযোগ নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য হতে পারে না।
রোববার (১২ জুন) স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদে আলোচনায় অংশ নিয়ে বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যরা এমন সমালোচনা করেন। সরকারি দলের অনেক সংসদ সদস্যও এই প্রস্তাবনার সমালোচনা করেছেন।
প্রস্তাবিত বাজেটে বিদেশে পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনতে সরকারের উদ্যোগের কঠোর সমালোচনা করে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান বলেন, বাজেটে অর্থ পাচারকারীদের দায়মুক্তির যে সুযোগ রাখা হয়েছে, এই সুযোগ থাকলে অর্থ চোরেরা হয়ে যাবে শ্রেষ্ঠ করদাতা। এই দায়মুক্তি আমি সমর্থন করি না। যারা অর্থ পাচার করেছে, যারা অবৈধভাবে অর্থ আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। না হলে মানি লন্ডারিং আইনের তো কোনো দরকার নেই বাংলাদেশে।
তিনি আরও বলেন, যদি বিদেশে অর্থ পাচার করে আবার সেটাকে কর দিয়ে বৈধ করা যায়, তাহলে তো অনেকে সন্দেহ করছেন— আরও বিশাল একটি গোষ্ঠী হয়তো সেই টাকা বিদেশে পাচার করে বৈধভাবে দেশে আনার জন্য বসে আছে। এটি বাস্তবায়ন হলে তাদের সেই উদ্দেশ্য সফল হবে। যারা অবৈধভাবে টাকা অর্জন করেছেন লুটপাটের মাধ্যমে, তারা সেই টাকাটা বৈধ করার জন্য নিয়ে বসে আছেন। এই দায়মুক্তি দিলে মানুষ উৎসাহিত হবে অবৈধ টাকা রোজগারের জন্য।
আরও পড়ুন- কর দিলে বৈধ হবে পাচার করা টাকা, কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবেন না
পীর ফজলুর রহমান বলেন, যেখানে মানুষ দিনরাত পরিশ্রম করছে স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য, একটি মানসম্পন্ন জীবনযাপনের জন্য, সেখানে কিছু মানুষ অবৈধভাবে লুটপাট করবে আর বিদেশে পাঠিয়ে পরে আবার বিদেশ থেকে সামান্য ট্যাক্স দিয়ে দেশে এনে সব বৈধ করে ফেলবেন, এটা তো হতে পারে না। পরে দেখা যাবে, শ্রেষ্ঠ করদাতা পুরস্কার পেয়ে যাবেন এই অর্থ চোরেরা। চোরেরা হয়ে যাবে শ্রেষ্ঠ করদাতা।
জাতীয় পার্টির আরেক সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বিদেশে পাচার হওয়া টাকা দেশে আনার ক্ষেত্রে দায়মুক্তি দেওয়ার তীব্র বিরোধিতা করে বলেন, কেউ ব্যাংক ডাকাতি করে, দুর্নীতি করে বিদেশে টাকা পাচার করে। তাদের বিরুদ্ধে কী কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে না? কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও ফৌজদারি মামলা রয়েছে। তারা কেন এই সুবিধা ভোগ করতে পারবে? বিদেশ থেকে আনা কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ, তাতে দুর্নীতি বাড়বে এবং এটি অনৈতিক। এই প্রস্তাব পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানান তিনি।
বিএনপির সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা বলেন, দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে বলে সরকার যে আত্মতৃপ্তিতে ভুগছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় টিসিবির গাড়ির পেছনের লাইন দেখলে। সেখানে ক্যানসারের রোগী থেকে শুরু করে ৫ বছরের শিশুও দিনভর লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে পণ্য না পেয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
তিনি বলেন, দেশে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বাড়ছে। দেশে চিকিৎসা ব্যয় এমনভাবে বাড়ছে যে, কোনো পরিবারের একজন আক্রান্ত হলে সেই সংসারের দুর্যোগ নেমে আসে।
বাজেট নিয়ে রুমিন বলেন, ২৭ মন্ত্রণালয়ের সম্পূরক বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। অথচ এডিবির ৫৮ শতাংশ এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। তাছাড়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তার বরাদ্দের ৪১ শতাংশ ১১ মাসেও ব্যয় করতে পারেনি। অথচ এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের কোনো জবাবদিহিতা চাওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, দেশে নিবন্ধিত বেসরকারি ক্লিনিকের সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার। কিন্তু এর কয়েকগুণ বেশি অবৈধ ক্লিনিক রয়েছে। সে দিকে কারও নজর নেই। তারা রোগীদের নিঃস্ব করে দিচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সমালোচনা করে বিএনপির এই সংসদ সদস্য বলেন, এ মন্ত্রণালয় তো আশ্চর্যজনক এক মন্ত্রণালয়। দ্রব্যমূল্য, বিশেষ করে ভোজ্যতেলের দাম আকাশছোঁয়া। তেল মিলের কয়েকজন মালিক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মিলে সিন্ডিকেট তৈরি করে ভোজ্যতেলেই শুধু কয়েক মাসে ১ হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে। এ লুটপাটের অর্থ কতদূর পর্যন্ত ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।
সরকারি দলের সংসদ সদস্য ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, আমরা স্বাস্থ্য বিমা করতে পারি। কেননা আমাদের প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি কর্মচারীরা স্বাস্থ্য ভাতা পান। মাছ ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সবাই যেন ক্লিনিকের লাইসেন্স না পান, সেদিকে নজর রাখতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
বিদেশে পাচার করা টাকা দেশে বিনা প্রশ্নে ফিরিয়ে আনার প্রস্তাবনার বিরোধিতাও করেন প্রাণ গোপাল দত্ত। এটিকে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার সুযোগ অভিহিত করে তিনি বলেন, যারা অবৈধভাবে বিদেশে টাকা পাচার করে, তারা ভালো মানুষ নয়। সুতরাং এ সুযোগ একবার দিলে বছরে পর বছর বিদেশে অর্থ পাচার হবে এবং অসাধু ব্যক্তিরা সামান্য ট্যাক্স দিয়েই সেই টাকা সাদা করার সুযোগ নেবে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকার দলীয় সদস্য মহিউদ্দীন খান আলমগীর বলেন, করোনাকলীন বৈশ্বিক বিপর্যয়ের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন খাত ও গণমানুষকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছেন। যে কারণে সম্পূরক বাজেট প্রস্তাবিত বাজেটের থেকে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। এই সময়ে বঙ্গবন্ধুকন্যার সুযোগ্য নেতৃত্বে এ বৈশ্বিক মহামারি সফলভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণ, গৃহহীনদের ঘর প্রদানে সরকরের সফলতা এখন বিশ্ব স্বীকৃত। এই সফলতা অব্যাহত থাকলে দেশে অচিরেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সুখি-সমৃদ্ধ ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশে পরিণত হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
সরকারি দলের শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, আরও দৃঢ় প্রত্যয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে সাহসী বাজেট দিয়েছে সরকার। করোনা মহামারির সময় সরকার বিশাল অঙ্কের টাকা ভর্তুকি দিয়ে একদিকে দেশের মানুষের জীবন রক্ষা করেছে, অন্যদিকে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখেছে। পৃথিবীর অনেক দেশে দুর্ভিক্ষ অবস্থা বিরাজ করছে। কিন্তু সেই পরিস্থিতি হতে দেননি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। পৃথিবী দেখছে, এই মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশ বুক উঁচু করে এগিয়ে চলেছে। রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে সারাবিশ্বের মতো আমাদের এখানেও জিনিসপত্রের দাম কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু সেটি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি।
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী দেশের ধারাবাহিক উন্নয়নের বিবরণ তুলে ধরে বলেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনায় বিশ্বের সব দেশ যখন বিপর্যস্ত, সেসময় শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখে গণমানুষের জীবন-জীবিকা স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হয়েছে। বিশেষ করে এ মহমারির সময় শিল্প-বাণিজ্য থেকে শুরু করে সব খাতে এবং শহর থেকে তৃণমূল পর্যন্ত মানুষকে প্রণোদনা প্রদান করা হয়েছে।
তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে নিন্দুকরা এখনো সমালোচনা করছেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আগে সরকারের উন্নয়ন চোখে দেখতেন না। কারণ চোখে অসুখ ছিল। এখন সেই অসুখ মাথায় উঠেছে। এ বিষয়ে দেশবাসীকে সতর্ক থাকতে হবে।
গণফোরামের মোকাব্বির খান বলেন, দেশে যদি একজন বড় দুর্নীতিবাজকে ধরে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা যেত, তবে একদিনে দেশে দুর্নীতি ৫০ ভাগ কমে যেত। চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি, বড় বড় দুর্নীতিবাজদের ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিন। দেশে ৫০ ভাগ দুর্নীতি না কমলে সংসদ সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করব।
সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর