আষাঢ় এলো
১৫ জুন ২০২২ ১০:২৫
আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য বলছে, রাজধানী ঢাকার আকাশ আজ আংশিক মেঘলা থাকলেও বৃষ্টির সম্ভাবনা কম। তবে দেশের বাকি এলাকাগুলোতে ঠিকই রয়েছে বৃষ্টির সম্ভাবনার কথা। কোথাও কোথাও ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনাও যে নেই, তা নয়।
আবহাওয়ার পূর্বাভাসে যাই থাকুক, শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি হোক কিংবা রোদের তেজ অব্যাহত থাকুক— আজ আষাঢ়ের প্রথম দিন। আজ বর্ষার প্রথম দিন। নাগরিক জীবনে বৃষ্টি মানে যতই প্যাচপেচে কাঁদা, মাঝ সড়কে ছোট নদীর মতো জমে থাকা হাঁটুজল কিংবা বেড়ে যাওয়া রিকশা ভাড়া আর এক ডিগ্রি বাড়তি যানজটের যন্ত্রণা হোক— বর্ষা এখনো বাঙালির মন ও মননে রোমান্টিসিজমের অন্যতম উৎস। প্রেম ও বিরহগাঁথা এখনো বর্ষা ঘিরে ছুঁয়ে যায় বাঙালিকে।
বর্ষপঞ্জির পাতা বলছে, আজ বুধবার ১ আষাঢ়। বর্ষা ঋতুর শুরুর দিন৷ গ্রীষ্মের দাবদাহ আর কালবৈশাখি ঝড়ের তাণ্ডবকে শান্ত করতে আগমন এই বর্ষার। আকাশজুড়ে মেঘের ঘনঘটা, বলা নেই কওয়া নেই হুট করে অঝোর ধারায় নেমে আসা বৃষ্টির ধারা— এই তো বর্ষার চিরচেনা রূপ। প্রকৃতিতে মানবসৃষ্ট বিভিন্ন ‘উন্নয়নে’র অভিঘাতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ঋতুবদলের স্বাভাবিকতা অনেকটাই ম্রিয়মান৷ তবু জুনের এই মাঝামাঝি সময়েই নিয়ম করে বর্ষার আগমন থেমে নেই।
আবহাওয়াবিদরা জানাচ্ছেন, গ্রীষ্মকালে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে ভূখণ্ডে প্রচণ্ড তাপের কারণে তৈরি হয় নিম্নচাপ কেন্দ্র। একই সময়ে ভারত মহাসাগর তুলনামূলকভাবে শীতলতর হওয়ায় উচ্চ চাপ কেন্দ্রও তৈরি হয়। ফলে সাগর থেকে প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প নিয়ে মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয় ভূখণ্ডে। ভারী বৃষ্টিপাত ঘটায় সেই মৌসুমি বায়ু। ভারত মহাসাগর অঞ্চলে গ্রীষ্মকালীন মৌসুমি বায়ুর দুই শাখার মধ্যে দুই শাখার মধ্যে বঙ্গোপসাগরের মৌসুমি বায়ুপ্রবাহই মূলত গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চল ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আবহাওয়ার প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। জুন মাসের শুরুর দিকে এই বায়ুপ্রবাহ দক্ষিণ ভারত হয়ে মিয়ানমারকে স্পর্শ করে বাংলাদেশের টেকনাফ দিয়ে প্রবেশ করলেই শুরু হয় বর্ষকাল।
ঢাকা আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন সারাবাংলাকে জানালেন, বঙ্গোপসাগরের সেই বর্ষা বয়ে আনা সেই মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশে প্রবেশ করে সপ্তাহখানেক হলো। গত ক’দিন থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যে বৃষ্টিপাত হচ্ছে, সেটি এই মৌসুমি বায়ু তথা বর্ষার প্রভাবেই। তবে বর্ষপঞ্জির হিসাবে বর্ষা ঋতুর শুরুটা আজই।
মনোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে মৌসুমি বায়ু এখন সক্রিয়ভাবে অবস্থান করছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও এর প্রভাব রয়েছে। বর্ষার প্রথম দিন আজও (বুধবার) দেশের কোথাও কোথাও হালকা, অনেক এলাকাতেই মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে।
মঙ্গলবারের (১৪ জুন) আবহাওয়ার পূর্বাভাসও একই কথা বলছে। তাতে বলা হয়েছে— রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায় এবং বাকি বিভাগগুলোর কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হতে পারে। কোথাও কোথাও মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণেরও সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রকৃতিতে বর্ষার এই উপস্থিতি আবহমান কাল থেকেই বাঙালিকে আনমনা করেছে। চতুর্দশ শতকের কবি বিদ্যাপতি যেমন তার ‘ভরা বাদর মাহ ভাদর’ পদে বর্ষণের মুখরতায় একাকিত্বের গাঁথা লিখেছেন— ‘তিমির দিগ্ ভরি, ঘোর যামিনী,/ অথির বিজুরিক পাঁতিয়া/ বিদ্যাপতি কহে কৈছে গোঙায়বি/ হরি বিনে দিন রাতিয়া।’
ঋতু হিসেবে বর্ষায় বাঙালির বিরহযাপনের নজির আরও পুরনো। সেই পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকে মহাকবি কালিদাস তার মেঘদূতমে বিরহী প্রেমিকের সহায় করেছিলেন বর্ষার মেঘকে। যক্ষ যখন প্রিয়াকে ছেড়ে রামগিরিতে নির্বাসনে, প্রেয়সীর কাছে অতৃপ্ত হৃদয়ের বাসনার কথা জানাতে বেছে নিয়েছিলেন মেঘকে, বাতলে দিলেন স্বর্গের রাজধানী অলকায় যাওয়ার পথ। সে পথের বর্ণনায় ফুটে উঠল গোটা ভারতের নয়নাভিরাম প্রকৃতি আর মানুষের কথা।
কালিদাসের সেই মেঘদূতকে ভুলতে পারেননি বাংলার বেশিরভাগ কবিই। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো বর্ষার আগমনের সঙ্গে মিলিয়ে লিখেই ফেললেন— ‘কবিবর, কবে কোন বিস্মৃত প্রদোষে, বরষে/ কোন পূণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে/ লিখেছিলে মেঘদূত।’ মানুষের সঙ্গে মানুষের বিরহের শ্বাশত বার্তায় মেঘদূত প্রবন্ধে আরও লিখলেন— ‘কেবল অতীত বর্তমান নহে, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে অতলস্পর্শ বিরহ। আমরা যাহার সহিত মিলিত হইতে চাহি সে আপনার মানসসরোবরের অগমতীরে বাস করিতেছে; সেখানে কেবল কল্পনাকে পাঠানো যায়, সেখানে সশরীরে উপনীত হইবার কোনো পথ নাই।’
বিদ্রোহ আর প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলামও তার ছেড়ে যাওয়া প্রেয়সী নার্গিসকে স্মরণ করে চিঠিতে লিখছেন— ‘আষাঢ়ের ঘন মেঘপুঞ্জকে আমার নমস্কার। এই মেঘদূত বিরহী যক্ষের বাণী বহন করে নিয়ে গিয়েছিল কালিদাসের যুগে, রেবা নদীর তীরে, মালবিকার দেশে, তার প্রিয়ার কাছে। এই মেঘপুঞ্জের আশীর্বাণী আমার জীবনে এনে দেয় চরম বেদনার সঞ্চয়। এই আষাঢ় আমার কল্পনার স্বর্গলোক থেকে টেনে ভাসিয়ে দিয়েছে বেদনার অনন্ত স্রোতে।’
এমন করেই বর্ষা বাঙালিকে ভাসিয়েছে প্রেমের আবেগে, বিরহে কাতর করে তুলেছে যুগে যুগে। ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’র সঙ্গে শ্রাবণের গান উপহার দিতে কবির যে আর্তি, বর্ষার সেই রোমান্টিসিজম সমানভাবে দোলা দিয়ে যায় বাঙালির মনে। বর্ষা এলেই তাই রাজধানীর যানজটে আটকে থাকা সিগন্যালে পথশিশুর হাতে দেখা মেলে কদম ফুলের। টিএসসি কিংবা রমনায় হয়তো কোনো তরুণ-তরুণী একগুচ্ছ কদম তুলে দেবেন ভালোবাসার মানুষটির হাতে। যাপনের বাধ্যবাধকতায় ভালোবাসার মানুষটি থেকে যিনি দূরে, বহু দূরে, তিনি হয়তো স্মরণ করবেন সেই মেঘকেই, যে মেঘকে বাহন করেছিলেন যক্ষ তার প্রিয়তমা পত্নীর কাছে নিজের হৃদয়ের অব্যক্ত ভালোবাসার বাণী পৌঁছে দিতে। মেঘ আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে বৃষ্টি হয়ে ঝরুক না ঝরুক, প্রেমের সেই বারতা বয়ে নিয়ে যেতে ভুল করবে না নিশ্চয়।
সারাবাংলা/টিআর