প্রতিকূলতাকে জয় করে ভোট কেন্দ্রে তারা, ইভিএমে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
১৬ জুন ২০২২ ২৩:০৯
কুমিল্লা থেকে: বুধবার (১৫ জুন) কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো শান্তিপূর্ণ পরিবেশে। কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া প্রায় সব কেন্দ্রেই নিয়ম মেনেই ভোট দিতে যায় সবাই। শারীরিকভাবে নানা প্রতিবন্ধকতা জয় করে কারো সাহায্য নিয়ে বা পায়ে হেঁটে বয়স্ক থেকে তরুণ সব বয়সী ভোটাররাই কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেন। ভোট দিতে পেরে খুশি প্রায় সব ভোটার। তবে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ ইভিএমে ভোট দেওয়ার প্রক্রিয়াকে সহজ ভাবছে আবার কারো কাছে এটা কঠিন এক পদ্ধতি।
কুসিকের ১৬ নম্বর ওয়ার্ড সংরাইশ সালেহা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভোট দেন প্রায় শতবর্ষী সুজিয়া থাকুন। বয়সের ভারে শরীর চলে না কিন্তু তাও তিনি ভোট দিতে এসেছেন ছেলে আব্দুল জলিলের কাঁধে ভর দিয়েই। মা-ছেলে দুইজনেই জানালেন ভোট দিয়ে তাদের সন্তুষ্টির কথা। আরও জানালেন যানজট-জলাবদ্ধতা-পাকা রাস্তায় গর্তসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত এলাকার উন্নয়নের জন্য যাকে ভালো মনে করেছেন তাকেই ভোট দিয়েছেন।
সুজিয়া খাতুন সারাবাংলার এই প্রতিবেদকে বলেন, ‘এক কালে ভোট দিছি কাগজে। অহন দিলাম বোতাম চাইপে মেশিনে। এইডা (ইভিএম) কিন্তু ভালা লাগজে।’ ছেলে আব্দুল জলিলও খুশি ভোট দিতে পেরে। তাই তিনি বললেন, ‘ভোট মানেই আনন্দ। আর ভোটের মূল্য অনেক। আমরা সুস্থ দেখে ভোট দেব, আর অসুস্থ দেখে মা দিতে পারবে না- এমনটা তো হয় না। সেজন্যেই মাকেও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। আমাদের একদিনের কষ্ট করে দেওয়া ভোটে যদি শহরের উন্নতি হয় তবে দরকার হলে আরও কষ্ট করতে রাজি আছি।’
কুসিকের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কেন্দ্রে নূরজাহান বেগমকে কোলে করে নিয়ে এসেছেন ছেলে সাইফুল আলম। জানালেন ৯০ বছর বয়সী নূরজাহান বেগম কানে ভালোভাবে শুনতে পায় না। কিন্তু তাও ভোট দেওয়ার ইচ্ছে জানানোয় তাকে কেন্দ্রে নিয়ে আসা। ভোটও দিয়েছেন ছেলের কাঁধে ভর করেই। ইভিএম বিষয়ে জানালেন মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বললেন, ‘ভোট দেওয়ার আগে লাইনে দাঁড়াতে সময় একটু বেশি লাগে। তবে ভোট দিতে বেশি সময় লাগে নাই।’
ঘড়ির কাঁটায় যখন সকাল ১০টা তখন কুসিকের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার মো. আবুল কাশেম ভোট দিতে আসেন। তিনি যখন কেন্দ্রের কাছে পৌছান তার আগ থেকেই বৃষ্টি হচ্ছিল। তাও হুইল চেয়ারে বসে কেন্দ্রে চলে এসেছেন জনপ্রতিনিধি বাছাইয়ে নিজের ভোট দেওয়ার জন্য। ভোট দিয়ে জানালেন, ‘ইভিএমে প্রথমবারের মতো ভোট দিলাম। ওইটা কি জিনিস সেটা দেখতে আসলাম। খারাপ না একবারে। মানুষ যেমনে কইছিল এক বোতামের চাপ দিলে আরেকখানে যায় ভোট, তেমন কিছুই দেখি নাই।’
এলাকার উন্নয়নে কেমন প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নিজের পছন্দের প্রতিনিধি বেছে নেওয়া একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর তাই নিজের ভোট নিজেই দেব, নিজের পছন্দেই মেয়র বানাব।’
প্রথমবারের মতো কুসিক নির্বাচনে নিজেদের ভোট দিয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার প্রীতি ও লতা। ঢাকা থেকে এসে নগরীর পুলিশ লাইন কেন্দ্রে ভোট দেন তারা সকাল ১১টায়। ভোট শেষে তারা বলেন, ‘ইভিএমে এবার ভোট দিতে পেরে ভালো লাগছে। গতবার দিলেও এবার একটু বেশি পরিবর্তন আছে বলে মনে হলো। সেইসঙ্গে এবারের ভোটের পরিবেশও ছিল অনেক ভালো।’
তরুণদের কাছে অবশ্য একটু কষ্টকর মনে হয়েছে ইভিএমে ধীরগতি ভোটের কারণে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার বিষয়টা। একইসঙ্গে হাতের আঙ্গুলের ছাপ না মেলার বিষয়েও কিছুটা বিরক্ত প্রথমবারের মতো ভোট দিতে আসা ভোটাররা। কুসিকের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের সংরাইশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট আসেন ১৯ বছর বয়সী রাশেদুল আলম। প্রায় দুই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানোর শেষে তিনি ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে যাওয়ার সুযোগ পান। তবে প্রথম তাকে ভোট দিতে দেওয়া হয়নি জাতীয় পরিচয় পত্র না থাকার কারণে। পরে সেটা নিয়ে আসার পরে ভোট দেওয়া সম্ভব হয়।
তার প্রশ্ন, ‘ভোটার আইডি কার্ড যদি না থাকে তবে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়েই তো চেক করা যায় সেটা। নইলে এই ফিঙ্গার প্রিন্টের আর মূল্য কি?’ তবে কুসিক নির্বাচনের সকাল দিকে যারাই ভোট দিতে এসেছেন তাদের প্রায় অনেকেরই লম্বা সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে বলে জানান।
নগরীর আলীয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রে ৬০ বছর বয়সী সীমা বেগম প্রায় তিন ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেন। তার ইভিএমে ভোট দিতেও প্রায় পাঁচ মিনিট সময় লেগেছে বলে জানান। কুসিকের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কুমিল্লা হাই স্কুল কেন্দ্রে দেখা যায় ৫১ মিনিটে শুধুমাত্র একটি ভোট কাস্ট করা হয়। নারীদের এই কেন্দ্রে ইভিএম মেশিন নিয়েও অভিযোগ ভোটারদের। পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসারও তা স্বীকার করেন।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভোট দিতে আসে প্রথমবারের মতো ভোট দিতে আসা আঁখি চৌধুরী। সপরিবারে এই কেন্দ্রে ভোট দিতে এসে তারা জানান, লাইনে ধরার সময়টা বাদে সবকিছুই ভালো ছিল। এ সময় আঁখি চৌধুরী বলেন, ‘বাবা-মা বলেন কুমিল্লা এক সময় নাকি শান্তির শহর ছিল। কিন্তু এখন অনেক পাল্টে গেছে। আমাদের এখানে এখন রাস্তায় নামা মানেই আতঙ্ক কাজ করে। ইভিএমে ভোট দিতে পেরে আমি খুশী। তবে আরও বেশি খুশি হবো যদি দেখি আমি যাকে ভোট দিয়েছে তিনি জয়লাভ করেন। তবে যেই জিতুক না কেনো আমার প্রত্যাশা একটাই। আর তা হলো একটা সুশৃঙ্খল নগরীর নাগরিক হিসেবে যেন আমরা শান্তিতে পড়াশোনা করতে পাড়ে। কুমিল্লা যেন হয়ে ওঠে মাদক ও জলাবদ্ধতা মুক্ত, যেমনটা আগে ছিল। সোজা ভাষায়, আমার বাবা-মা যে শান্তির শহরের কথা বলে- সেটা আমরা ফিরে পেতে চাই।’
পাশেই থাকা আঁখির মা কথা টেনে বলেন, ‘শান্তির শহরে আমরা শান্তিতে থাকতে চাই। মেয়র কে হবে বা কাউন্সিলর কে হবে তা নিয়ে আমাদের আগ্রহ তেমন বেশি নাই। আমরা যেন শান্তিতে থাকতে পারি সেই ব্যবস্থা করতে পারাটাই তাদের দায়িত্ব।’
এই প্রতিবেদন যখন লেখা হচ্ছিল তখন কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ফলাফল শেষ হয়েছে। বুধবার (১৫ জুন) রাত সাড়ে ৯টার দিকে রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরী জেলা শিল্পকলা অ্যাকাডেমিতে এই ফলাফল ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ‘নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত পেয়েছেন ৫০ হাজার ৩১০ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মনিরুল হক সাক্কু পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৯৬৭ ভোট। অর্থাৎ আরফানুক হক রিফাত ৩৪২ ভোটে জয়লাভ করেছেন।’
তরুণ হিসেবে আঁখি চৌধুরী থেকে শুরু করে সুজিয়া খাতুনেদের দৃষ্টি তাই এখন আরফানুল হক রিফাতের দিকে। কুমিল্লাকে শিক্ষা ও শান্তিময় গড়ে তোলার জন্য মেয়র হিসেবে তো তিনিই নির্বাচিত। ভোটারদের প্রত্যাশা পূরণের দায়িত্বও এখন তারই কাঁধে।
সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম