বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে শিক্ষাখাতে নতুন বিপর্যয়
১৮ জুন ২০২২ ১৪:০৮
ঢাকা: ২০২০ সালে মহামারির কারণে পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল ওই বছরের উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) ও সমমান পরীক্ষা। মড়কের ঢেউয়ে পিছিয়ে দেওয়া সেই পরীক্ষা দুবছরেও আর নেওয়া সম্ভব হয়নি। দিতে হয়েছিল অটোপাস। এই দারুণ বিপর্যয়ের বছর না ঘুরতেই নতুন বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলো শিক্ষাখাত। এবারের বিপর্যয়ের নাম বন্যা আর পাহাড়ি ঢল।
বন্যায় আর ভারতের মেঘালয়-আসাম থেকে নেমে আসা জলের ঢলে তলিয়ে গেছে গোটা সিলেট অঞ্চল। এ কারণে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা পিছিয়ে দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বন্ধ ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে ২৯০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এর বাইরেও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন ভেসে গেছে বানের তোড়ে, এখনো পর্যন্ত যার হিসেবই নেই কারও কাছে। বন্যায় ভিটেমাটি ডুবে যাওয়ায় দারুণ বিপাকে রয়েছেন সিলেট অঞ্চলের সকল শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা।
রাতিম ও রাতুল নামে দুজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার। এই জমজের আর দু’দিন বাদেই এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল। তারা বলেছে, তাদের সব বই খাতা ভিজে গেছে, এমনকি পরীক্ষার প্রবেশপত্রও। বাড়িতে বুক সমান পনি। যে ভবনে বসে পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল সেখানেও একই অবস্থা। বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই দুদিন হলো, ফোনের শেষ দাগ চার্জ নিয়ে এখন প্রয়োজনীয় যোগাযোগ সাড়ছে।
সিলেট জেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা গকুল চন্দ্র দেবনাথ সারাবাংলাকে বলেছেন, ‘এখন পর্যন্ত তারা ৩০০টির বেশি বিদ্যালয় পানিতে তলিয়ে যাওয়ার খবর পেয়েছেন। এ সব বিদ্যালয়ে কোনোভাবেই শ্রেণি কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।’
তিনি বলেন, ‘কাগজে কলমে ১৭ জুন পর্যন্ত ২৯০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেণী কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। বন্যা না কমা পর্যন্ত এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান সম্ভব নয়।’
সিলেটের বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলে জানা গেছে, গণমাধ্যমে যে পরিস্থিতি দেখানো হচ্ছে বাস্তবতা তার চেয়েও ভয়াবহ। পানির তোড়ে রাস্তার কোনো ভারী যানবাহনই দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ঘরবাড়ি সমেত ভেসে যাচ্ছে ভিটার মাটি। অনেক বিদ্যালয় তলিয়ে গেছে, ভেসে গেছে অনেকগুলো, পানি কমলে সঠিকভাবে জানা যাবে কতটা ক্ষতি হয়েছে। এই মুহূর্তে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব না।
সিলেট অঞ্চলের এসব শিক্ষকেরা বলছেন, করোনার পর এটিই শিক্ষাখাতে সবচেয়ে বড় এবং ভয়াবহ আঘাত। এই ক্ষতিও পুষিয়ে নিতে সময় লাগবে দীর্ঘ।
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবু সাঈদ মো. ওয়াদুদ জানিয়েছেন, মাধ্যমিক পর্যায়ে তারা ৭০টির মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তলিয়ে যাওয়ার খবর পেয়েছেন। তবে অন্যান্য পর্যায়ে কতটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তলিয়ে গেছে, নিশ্চিত ভাবে তিনি জানেন না বলে জানিয়েছেন।
সিলেট শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক অরুণ চন্দ্র পাল বলেন, ‘সিলেটে সব মিলিয়ে ১২টির মতো উপজেলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তলিয়ে যাওয়ার খবর পেয়েছি, এর মধ্যে বেশিরভাগই ছিল এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র। একারণেই মন্ত্রণালয় পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি না হলে এদেরকে ছাড়াই এসএসসি পরীক্ষায় দিতে হতো!’
পরিস্থিতি কতোটা খারাপ সেটি বুঝাতে গিয়ে সিলেট শিক্ষাবোর্ডের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেছেন, ‘এই অবস্থায় স্কুল বন্ধ না করায় স্কুল যাওয়ার পথে কয়েকজন শিক্ষার্থী নৌকা ডুবে মারা গেছে ‘
তিনি বলেন, ‘আপনি খোঁজ নিয়ে দেখেন আমি মিথ্যা বলেছি কিনা?’
ওনার বক্তব্য যে মিথ্যা নয় সেটি সুনমাগঞ্জের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা প্রিয়াংকাও জানিয়েছেন দুজন শিক্ষার্থীর সলিল সমাধির মর্মান্তিক সংবাদ। এরা আবার আপন ভাই-বোন।
জানা গেছে, নৌকায় করে এসএসসি পরীক্ষার প্রবেশপত্র আনতে যাওয়ার পথে (১৫ জুন) ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকুডুবির শিকার হয়ে মারা যায় এই দুই ভাই বোন। ঘটনাটি ঘটে দোয়ারাবাজারের সুরমা ইউনিয়নের রাজনপুর গ্রামে। তাদের নাম তামান্না ও সৌরভ।
যে বিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি দেওয়ার কথা ছিল তামান্নার, সেই সমুজ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ অসীম মোদকও সারাবাংলাকে খবরটি নিশ্চিত করেছেন।
সিলেট শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান ড. রমা বিজয় সরকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই বন্যা স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ আর বন্যার আঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষা খাত। এই ক্ষতি অপূরণীয়। যাদের দুই দিন পরে পরীক্ষায় বসার কথা ছিল, তারা এখন পড়তে বসতেই পাড়ছে না। সামনে এইচএসসি পরীক্ষা, সেখানেও পরীক্ষার্থীরা পড়তে বসতে পারছে না। কোথায় বসবে? বাড়ি ঘর ডুবে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘শিক্ষায় মহামারিতে যে ক্ষতি হয়েছে, সরকারের সূদুর প্রসারি পরিকল্পনায় আমরা সেটি সামলিয়ে উঠছিলাম। সব কিছু আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। এর মাঝেই এসেছে এই বন্যা। এই বন্যায় ক্ষতি কেমন হবে সেটি এখনই নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না, তবে বড় ক্ষতিই হবে। আমরা এসএসসির মতো পরীক্ষা স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছি।’
এদিকে কেবল স্কুল কলেজ নয়, বন্যায় তলিয়ে গেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও। গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পানি ঢুকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক তলিয়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী রবিন সারাবাংলাকে বলেছেন, ক্যাম্পাসের প্রবেশের সড়ক, চেতনা-৭১-এর সামনের অংশ, অ্যাকাডেমিক ভবন, ইউনিভার্সিটি সেন্টার, প্রথম ছাত্রী হলের সামনের রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফরিদ উদ্দীন আহমেদ জানিয়েছেন, ১৯৯৮ সালের পর এবারই প্রথম ক্যাম্পাসে পানি ঢুকেছে। আমরা সেটি কীভাবে সামলানো যায় সেই চেষ্টা করছি। আশা করছি দুয়েকদিনে মধ্যেই পানি নেমে যাবে।
উল্লেখ্য, কয়েক সপ্তাহ আগেই সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তবে গত তিন দিনে বাংলাদেশের উজানে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে প্রায় আড়াই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। ওই পানি ঢল হয়ে বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের সব কটি জেলায় প্রবেশ করে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির ভয়ানক অবনতি হয়।
সারাবাংলা/টিএস/একে