‘এ ব্রিজ শুধু শ্রম দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়ে বানাইছি’
২১ জুন ২০২২ ২২:৩১
পদ্মা সেতু থেকে ফিরে: মো. আজিম হোসেন। বয়স ২৯ বছর। বাড়ি মানিকগঞ্জ। পদ্মা সেতুর নদী শাসন প্রকল্পে চীনের সিনোহাইড্রো কোম্পানিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। বাড়িতে ছোট্ট একটি কন্যা সন্তান আছে। মেয়ের জন্য খুব মায়া তার। বাৎসল্য প্রেমের টানে অন্যদের তুলনায় একটু বেশিই বাড়িতে যান তিনি। মাসে কখনো একবার, কখনো দুই বার, কখনো তিন বার।
বাড়িতে গেলেই আয়ে কিছু ভাটা পড়ে আজিমের। তবুও যান, সন্তানকে আদর করেন। আবার ফিরে আসেন পদ্মা সেতু এলাকায়। অক্ষরজ্ঞানহীন সহজ-সরল আজিম হোসেন পদ্মা সেতু আর কন্যা সন্তানকে সমান্তরাল প্রেমে বাঁধেন। একটি ছেড়ে আরেকটি কল্পনা করতে পারেন না তিনি। এই মুহূর্তে দুইটিয় তার হরিহর আত্মা। নিজ হাতে গড়া স্বপ্নের পদ্মা সেতু আর আত্মজার প্রতি কী অদ্ভূত প্রেম তার! শোনা যাক আজিম হোসেনের মুখেই—
‘(বাগড়িতে) যাই… এক মাস পরে বা প্রতি মাসে ২/৩ বার করে বাড়ি যাই। বাড়ি যেতে ভালো লাগে। আবার এখানে থেকে পদ্মা সেতুর দিকে তাকিয়ে থাকতেও ভালো লাগে। এ ব্রিজ আমরা কেবল শ্রম দিয়ে বানাই নাই, হৃদয় দিয়ে বানাইছি।’
উদ্বোধনের ৯ দিন আগে গত ১৬ জুন পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় আজিম হোসেনের। একজন চীনা প্রকৌশলীর তত্ত্বাবধানে ১৫/১৬ জন্য বাঙালি শ্রমিকের সঙ্গে তিনিও কাজ করছিলেন। কাজটি ছিল নদী শাসনের জন্য বসানো ব্লকের র্যাশন কার্পেটিংয়ের।
বাংলাদেশের আইকনিক স্থাপনা স্বপ্নের পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার অনুভূতিটা কেমন? আজিমের উত্তর— ‘এটা আমাদের কাজ, দেশের কাজ। দেশ উন্নত হলো। ঢাকা থেকে মাওয়ার যোগাযোগ উন্নত হলো। শুধু ঢাকা-মাওয়া না, দেশব্যাপী, বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ মাধ্যম সৃষ্টি হলো। আমার অনেক আনন্দ লাগে। অনেক ভালো লাগে।’
মো. আজিম হোসেনের এসব অগোছালো অথচ আবেগমোথিত কথাগুলোর মধ্যে নেই কোনো ভনিতা, নেই জড়তা, নেই কোনো আরোপিত সত্য। বরং নিরেট-নিপাট ভদ্রবচনে তিনি বলে গেলেন— ‘হ্যাঁ, এরকম ফিলিংস কাজ করছে যে পদ্মা সেতুর উন্নয়নে অংশীদার হতে পারছি। এখন আমরা আছি, এক সময় আমরা থাকব না। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নামটা স্মরণ করবে। উনার (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) মতো একজন নেত্রী এই খরস্রোতা পদ্মার মধ্যে সেতুটা নির্মাণ করছেন, অনেক অসাধ্য সাধন করছেন।’
‘এটা কওয়া (বলা) ভালো না, আমার জীবনের প্রথম ভোটটা উনাকেই দিছি। আজকে যে ব্রিজ হলো, সেটা জননেত্রীর জন্যই। আমরা উনার জন্য দোয়া করি, উনি আমাদের গর্ব। উনি না হলে এই ব্রিজ কোনোদিনও হতো না। পরের ভোট উনাকেই দেবো,’— বলেন আজিম হোসেন।
টানা পাঁচ বছর পদ্মা সেতুতে কাজ করা ২৯ বছর বয়সী মো. আজিম হোসেন স্বপ্ন দেখেন নিজ জেলা মানিকগঞ্জের আরিচা অথবা পাটুরিয়া দিয়ে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণে অংশীদার হওয়ার। তার ভাষায়— ‘এরকম স্বপ্ন দেখি আমি। ওইখানে (আরিচা-দৌলদিয়া, পাটুরিয়া-দৌলদিয়া) যদি ব্রিজ হয়, সেইখানেও আমি কাজ করার স্বপ্ন দেখি। ওইখানে ব্রিজ হলে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও ভালো হবে। বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু আছে, পাটুরিয়া যদি হয়, আর এটা (পদ্মা সেতু) তো হয়েই গেল, তাহলে পুরো বাংলাদেশ একেবারে স্বয়ংসম্পূর্ণ।’
‘এই যেমন এখন দৃশ্যমান পদ্মা সেতু দেখে সবারই ভালো লাগে, আমারও ভালো লাগে। ২৫ তারিখে (২৫ জুন) তো উদ্বোধন। এটা চালু করে দিলে অনেক ভালো লাগবে। আরিচা থেকে দৌলতদিয়া যদি একটা দিয়ে দেয়, নগরবাড়ি দুই লাইনে… একটা যাবে দৌলতদিয়া, আরেকটা নগরবাড়ী— এই দুই লাইনে যদি দেয়, তাহলে আর সেতু দরকার হয় না বাংলাদেশে,’— বলেন আজিম হোসেন।
নিজের কাজের ধরন ও পারিশ্রমিক সম্পর্কে আজিম বলেন, ‘আমরা লেবারে আছি সিনোহাইড্রোতে। আমরা করি রাজমিস্ত্রির কাজ। প্রতিদিন আমাদের বেতন আসে ১২-১৩ শ টাকা।’
কবে নাগাদ শেষ হচ্ছে কাজ— জবাবে আজিম হোসেন বলেন, ‘এটা টপ ফ্লোর পর্যন্ত আসবে। সামনের বছর লাগবে। এখন বর্ষার সিজন। কাজ অফ। পানির নিচে সিক্স মিটার ড্রাফ হচ্ছে, ওপরের দিকে আরও হবে।’
সারাবাংলা/এজেড/টিআর