নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলেন বোয়ালমারীর ইউএনও, ভর্ৎসনা করলেন হাইকোর্ট
২২ জুন ২০২২ ০০:১৭
ঢাকা: ফরিদপুরের জেলা জজ আদালতের নেজারত শাখার জারিকারক কামাল হোসেন ও মেহেদী হাসানের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে তাদের শাস্তির হুমকি দেওয়ার ঘটনায় বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রেজাউল করিম ও অফিস সহকারী উকিল মিয়াকে ভৎসনা করেছেন হাইকোর্ট।
মঙ্গলবার (২০ জুন) ইউএনও ও অফিস সহকারী আদালতে হাজির হয়ে নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা করলে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ তাদের ভর্ৎসনা করেন।
আদালতে ইউএনও ও অফিস সহকারীর পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ ও মাহবুব শফিক। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়।
শুনানিতে হাইকোর্ট ইউএনও’র উদ্দেশে করে বলেন, আপনাকে ক্ষমা করলে আমরা আটকে যাব। আদালত সবার ওপরে। আদালতের আদেশ সবার মানতে হয়। আপনি আদালতের আদেশ মানেননি। আদালতের সমন নিয়ে নোটিশ জারিকারকরা আপনাদের কাছে গিয়েছিল। আপনার উচিত ছিল তাকে ধন্যবাদ দেওয়া। অথচ কী দুর্ব্যবহার না করলেন! কত অজুহাত দেখালেন!
আদালত আরও বলেন, আপনি একটি ছোট্ট বিষয় হ্যান্ডেল (মোকাবিলা) করতে পারেন না, কীভাবে জনসেবা করবেন? একটা কথা মনে রাখবেন, আইন-আদালত আছে বলেই আপনি সম্মান পান। আপনি যদি আইন না মানেন, আপনাকে কেউ মানবে (সম্মান করা) না।
আদালত বোয়ালমারী উপজেলা কার্যালয়ের অফিস সহকারী উকিল মিয়ার উদ্দেশে বলেন, আপনি মূল অপরাধী। আপনি সিনক্রিয়েট (অন্যায়) করেছেন। খুব খারাপভাবে মিসগাইড (দুর্ব্যবহার) করেছেন।
এরপর আদালত এ বিষয়ে আগামী ২৬ জুন আদেশের জন্য দিন ধার্য করেন।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ‘ছরোয়ার শেখ বনাম নির্বাহী প্রকৌশলী, সওজ’-এর এক মামলায় ফরিদপুরের বোয়ালমারী সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে বিচারাধীন। এ মামলার নোটিশ জারির জন্য ফরিদপুর জেলা জজ আদালতের নেজারত শাখার জারিকারক কামাল হোসেন ও মেহেদী হাসান গত ২৭ এপ্রিল দুপুরে বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে যান। ওই কার্যালয়ের অফিস সহকারী উকিল মিয়াকে নোটিশ গ্রহণের অনুরোধ করেন তারা। কিন্তু অফিস সহকারী উকিল মিয়া নোটিশ গ্রহণ না করে ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে তাদের বসিয়ে রাখেন। বিকেল ৪টায় পুনরায় উকিল মিয়ার কাছে গেলে তাদের ইউএনও অফিসের ওপর তলায় গিয়ে বসতে বলেন।
এসময় নোটিশ জারিকারকরা বলেন, আরও নোটিশ জারি করার জন্য তাদের অন্য স্থানেও যেতে হবে। তখন উকিল মিয়া বলেন, তাতে আমার কী? জজ কোর্টের নোটিশ না রাখলে আমার কী হবে? তিনি এর চেয়ে বড় কাজে ব্যস্ত আছেন বলে জানান।
উকিল মিয়া এসময় নোটিশটি পাশের টেবিলে জমা দিতে বলেন। কিন্তু পাশের টেবিলের দায়িত্বরত কর্মচারী নোটিশ গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এ সময় জারিকারক মেহেদী হাসান নোটিশ জারি না করে চলে আসার জন্য কামাল হোসেনকে বলেন। এ ছাড়া বিষয়টি আদালতকে অবহিত করা হবে বলে জানান।
তখন উকিল মিয়া বলেন, জজের (বিচারক) ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। আমরা নির্বাহী বিভাগের লোক। নোটিশ না রাখলে আমাদের কিছু হবে না। তখন জারিকারক মেহেদী হাসান ঘটনাস্থল ত্যাগ করার জন্য পুনরায় কামাল হোসেনকে বললে ওই সময় উকিল মিয়া নোটিশ বুঝে নেন।
তবে এরই মধ্যে ওই অফিসের একজন কর্মচারী বিষয়টি ইউএনওকে অবহিত করলে ইউএনও জারিকারকদের তার কক্ষে ডেকে নিয়ে দরজা আটকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করতে থাকেন। একইসঙ্গে ইউএনও অফিসের স্টাফদের সঙ্গে বাজে ব্যবহারের অভিযোগ তুলে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে তাদের শাস্তি দেওয়ার হুমকি দেন।
ইউএনও এসময় জারিকারক কামাল হোসেন ও মেহেদী হাসান উভয়ের মোবাইল ফোন কেড়ে নেন এবং মুচলেকা দিয়ে চলে যেতে বলেন। তাদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিতও করা হয়। এক পর্যায়ে জোর করে মুচলেখা আদায় করে তাদের ছেড়ে দেন।
পরে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ সংশ্লিষ্ট জেলার বিচার প্রশাসনকে লিখিতভাবে জানান দুই নোটিশ জারিকারক। এ অভিযোগের অনুলিপি আইন ও বিচার বিভাগের সচিব ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবর পাঠান ফরিদপুরের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মো. আকবর আলী শেখ।
পরে বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনা হলে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ইউএনও ও অফিস সহকারীকে তলব করেন আদালত। তলব আদেশ অনুযায়ী নির্ধারিত দিনে হাইকোর্টে সশরীরে উপস্থিত হয়ে ইউএনও ও অফিস সহকারী নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা করলে আদালত তাদের ভর্ৎসনা করে এ বিষয়ে আদেশের জন্য আগামী ২৬ জুন (রোববার) দিন নির্ধারণ করে দেন।
সারাবাংলা/কেআইএফ/টিআর