২০৪১ সালে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হব: প্রধানমন্ত্রী
২২ জুন ২০২২ ১৯:০৭
ঢাকা: সরকারের রূপকল্প অনুযায়ী আগামী ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হবে বলে আশাবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, নানামুখী উদ্যোগ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আমরা ২০৩১ সালে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হব ইনশাআল্লাহ।
বুধবার (২২ জুন) জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য মো. আফজাল হোসেনের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী সংসদে এ কথা বলেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশনের কার্যক্রম শুরু হয়।
সংসদে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, দক্ষ জনবল তৈরি, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো স্থাপন ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির উদ্দেশ্যে আমাদের সরকার বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছে। এর মধ্যে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো ও কর্মসংস্থান তৈরিসহ সার্বিকভাবে দেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতি অর্জনে সরকার কাজ করছে বলে জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন খাতভিত্তিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি প্রথম প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, ষষ্ঠ ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছি। এর ধারাবাহিকতায় বর্তমানে দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-২০৪১) ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (জুলাই ২০২০ থেকে জুন ২০২৫) বাস্তবায়নে আমরা নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি বিভিন্ন সংকট মোকাবিলা করে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আমরা কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছি।
আরও পড়ুন- ‘সব দলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন অবাধ-সুষ্ঠু হবে’
কোভিড-১৯ সংকট মোকাবিলায় এবং অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব কাটিয়ে উঠতে চারটি প্রধান কৌশলগত দিক সম্বলিত স্বল্প, মাঝারি ও দীর্ঘ মেয়াদি লক্ষ্য নিয়ে একটি সামগ্রিক কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে আমাদের কৌশলগুলো ছিল সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি ও কর্মসৃজনকে প্রাধান্য দেওয়া এবং কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যয় নিরুৎসাহিত করা, ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্পসুদে কতিপয় ঋণ সুবিধা প্রবর্তন করা যেন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত হয়। এছাড়া হতদরিদ্র ও কর্মহীন হয়ে পড়া নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত জনগণকে সুরক্ষা দিতে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা ও বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বাড়ানোর কাজ করা হয়।
সংসদ নেতা বলেন, এসব কৌশলের আলোকে আমরা এ পর্যন্ত ১ লাখ ৮৭ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকার ২৮টি আর্থিক ও প্রণোদনা প্যাকেজ চালু করেছি এবং এগুলোর সফল বাস্তবায়ন করে চলেছি। সরকারের সময়োপযোগী যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ ও সেগুলোর কার্যকর বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ আজ কোভিড-১৯-সৃষ্ট ভয়াবহ বিপর্যয়কর অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। কোভিডকালীন যেখানে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে, সেখানে আমরা ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি।
বর্তমানে সরকারি, বেসরকারি ও বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, এ উদ্দেশ্যে যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো বিনির্মাণ করছি। আমরা সারাদেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কার্যক্রম হাতে নিয়েছি, যেখানে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। আমরা বিনিয়োগ আকর্ষণে দেশ ও দেশের বাইরে সেমিনার ও ওয়ার্কশপ, রোডশো, ট্রেড শো, আয়োজন ও পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছি। সরকারের এসব কর্মসূচি উদ্যোক্তা ও কর্মসংস্থান তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে বিনিয়োগ সংক্রান্ত সব সেবা সমন্বিত করে একই প্ল্যাটফর্ম থেকে দেওয়ার জন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিস পোর্টালের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থার বিনিয়োগ সংক্রান্ত সেবাগুলো ওই পোর্টালে পর্যায়ক্রমে যুক্ত করা হচ্ছে।
ওয়ান স্টপ সার্ভিস পোর্টালের মাধ্যমে ৩৯টি সংস্থার ১৫০টি বিনিয়োগ সংক্রান্ত সেবা অনলাইনে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে বর্তমানে ১৯টি প্রতিষ্ঠানের ৫৮টি সেবা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। বলেন, শিগগিরই বাকি সেবাগুলো এ পোর্টালে সংযোজন করা হবে। কাস্টমস বন্ডেড অটোমেশনের কাজ চলমান রয়েছে, যা খুব শিগগিরই শেষ হবে। এখন উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর লক্ষ্যে আমরা উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারের ওপর বিশেষ জোর দিচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কৃষিকে আধুনিকায়নের লক্ষ্যে কৃষকদের কৃষিযন্ত্রের ক্রয়মূল্যের ওপর ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত সহায়তার মাধ্যমে কম দামে কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হচ্ছে। শিল্প খাতের উন্নয়নে আমরা যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কৌশল নির্ধারণ করেছি। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ছিল ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ, যা চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৫ দশমিক ৩৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আমরা এ হার ২০২৪-২৫ সাল নাগাদ ৪১ দশমিক ৮৬ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। সেবা খাতেও আমাদের রয়েছে নানা উদ্যোগ।
তিনি আরও বলেন, পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক মানের আবাসন ও বিনোদন সুবিধা নিয়ে কক্সবাজার জেলায় সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের ফলে ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশ ঘটেছে। আইসিটি খাতের রফতানি এরই মধ্যে ১৪০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। দেশে ৩৯টি হাইটেক পার্ক/আইটি ইনকিউবেশন সেন্টার গড়ে তোলা হচ্ছে। এরই মধ্যে ৯টিতে ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পার্কগুলোতে এ পর্যন্ত দেশি বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা এবং প্রস্তাবিত বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৪৩ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার।
সরকারপ্রধান বলেন, উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড, আইডিয়া প্রকল্প ও বঙ্গবন্ধু ইনোভেশন গ্রান্ট (বিগ)। সরকারের এরকম নানা উদ্যোগের ফলে ক্রমশ দেশে স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম গড়ে উঠেছে। বর্তমানে দেশে আড়াই হাজারের বেশি স্টার্টআপ রয়েছে। স্টার্টআপ খাতে এ পর্যন্ত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ মানুষের। আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ২০২৫ সালে আইসিটি রফতানি ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থান ৩০ লাখে উন্নীত করা এবং সেজন্য এ খাতে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইনোভেশন ফান্ডের মাধ্যমে উদ্ভাবনী সংস্কৃতি চলমান রাখা ও উদ্ভাবনী আইডিয়া বাস্তবায়নের জন্য অভ্যন্তরীণ ও অন্যান্য তহবিলের মাধ্যমে উদ্ভাবনী আইডিয়াগুলোকে প্রকল্পরূপে বাস্তবায়ন করার জন্য অর্থায়ন করা হচ্ছে। সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযুক্ত তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা। সে উদ্দেশ্য পূরণে সরকার স্টেম (সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও ম্যাথমেটিকস)-ত্তিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, সরকার শ্রেণিকক্ষে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চাহিদা মেটানোর উপযুক্ত প্রযুক্তিভিত্তিক বিষয়গুলো পড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে। সে লক্ষ্যে এনসিটিবিকে পাঠ্যক্রমের উপযুক্ত পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ৩০ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়েছে, যা বর্তমানে ১৪ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। ডিপ্লোমা ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাক্রমের মূল টেকনোলজি ও মূল টেকনোলজির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ইমেজিং টেকনোলজিগুলো অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সরকারি চাকরি পাওয়া বিষয়ক সমস্যার সমাধান এবং ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের সুযোগ বিবেচনায় টেকনোলজিগুলো পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে এবং ডুয়েল সার্টিফিকেশন কার্যক্রম চালু হয়েছে।
তিনি বলেন, চলমান ও ভবিষ্যতের শিল্প-বাণিজ্যের চাহিদার কথা বিবেচনায় রেখে শ্রমিকের দক্ষতার বিকাশ ঘটাতে সরকার স্কিলস্ ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (SEIP)-এর মাধ্যমে এ পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এছাড়া, প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণের মান উন্নয়ন, দক্ষ প্রশিক্ষক তৈরি, আন্তর্জাতিক সনদ প্রদান ইত্যাদি বিষয়েও কার্যক্রম পরিচালনা করে SEIP প্রকল্প দেশের মানবসম্পদ ও দক্ষতা উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।
সংসদ নেতা বলেন, এ প্রকল্পের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে সরকার চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় নিয়ে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকার লক্ষ্যে শিল্প খাতে নিয়োজিত জনশক্তির যুগোপযোগী দক্ষতা নিশ্চিত করতে আরও বেশি ফলাফলভিত্তিক একটি প্রশিক্ষণ প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে, যার প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম বর্তমানে চলছে। দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের অর্থায়ন নিশ্চিত করতে ‘জাতীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন তহবিলে’র কার্যক্রম পূর্ণাঙ্গভাবে শুরু করার জন্য স্থায়ী জনবল নিয়োগ শুরু হয়েছে। জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এনএসডিএ) জাতীয় দক্ষতা পোর্টাল বিনির্মাণ ও জাতীয় দক্ষতা নীতি প্রণয়ন করে বাস্তবায়ন শুরু করেছে।
ফাইল ছবি
সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর
প্রধানমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্নোত্তর সংসদ অধিবেশন