Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

লাইসেন্সহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্সধারীদের বিমানে নিয়োগ

শেখ জাহিদুজ্জামান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২২ জুন ২০২২ ২২:৩৬

ঢাকা: বাংলাদেশ বিমানে রয়েছে নতুন প্রজন্মের ‍উড়োজাহাজ বোয়িং ৭৭৭। এইসব উড়োজাহাজ পরিচালনার জন্য সম্প্রতি ১৪ বৈমানিককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আটজন ক্যাপ্টেন এবং ছয়জন ফাস্ট অফিসার। তবে এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রীতিমতো নিয়ম ভাঙার রেকর্ড হয়েছে। বিমানে নিয়োগ পাওয়া আট ক্যাপ্টেনের মধ্যে সাতজনের লাইসেন্সের মেয়াদ ছিল না। আরেকজনের তো বাংলাদেশি লাইসেন্সও নেই। যারা নিয়োগের জন্য আবেদন করার যোগ্যতা রাখেন না, সেখানে তাদের-ই রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমানের ক্যাপ্টেন হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজে ক্যাপ্টেন হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন- শাহ নাসিমুল আওয়াল, মো. হারুনর রশিদ, আবদুল্লাহ মারুফ, ইরফান উল হক, হোসাইন মো. শওকত জাহান, আবু নুর মো. তাহমিদুল ইসলাম, নাসিম ইবনে আহমেদ, ক্যাপ্টেন আজিজুল হক।

সারাবাংলার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ক্যাপ্টেন আওয়ালের বাংলাদেশে বিমান পরিচালনার এয়ারলাইন্স ট্রান্সপোর্ট পাইলট লাইসেন্সের (বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন থেকে ইস্যু করা) মেয়াদ শেষ হয়েছে প্রায় সাত বছর আগেই। এছাড়া মারুফের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়েছে প্রায় ১০ বছর আগে, ইরফানের প্রায় আট বছর আগে, শওকতের নয় বছর আগে, নাসিমের প্রায় আট বছর আগে, হারুণের প্রায় সাত বছর আগে এবং ক্যাপ্টেন হিসেবে নিয়োগ পাওয়া তাহমিদের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়েছে প্রায় সাত বছর আগে।

অনুসন্ধানে আরও বেরিয়ে এসেছে, বাংলাদেশ বিমানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন আজিজুল হক। যার বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন অথরিটি থেকে ইস্যু করা কোনো লাইসেন্স নেই। ক্যাপ্টেন নিয়োগে বাংলাদেশ বিমানের অপারেশন ম্যানুয়েল (অ) এর প্যারা ২.১.৪.৭.৪ এর (ই) এর পাতা ২.৭-তে উল্লেখ আছে, বাংলাদেশে বৈমানিক হিসেবে নিয়োগ পেতে হলে একজন বৈমানিকের প্রথম এবং প্রাথমিক যোগ্যতা হলো বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশনের ইস্যুকৃত বৈধ (এটিপিএল- এয়ারলাইন্স ট্রান্সপোর্ট পাইলট লাইসেন্স) থাকতে হবে। তবে ক্যাপ্টেন হিসেবে নিয়োগ পাওয়া আটজনের মধ্যে সাতজনেরই লাইসেন্স ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ। আর একজনের বাংলাদেশি লাইসেন্স-ই নেই। যা বাংলাদেশ বিমানের নিয়োগ প্রক্রিয়ার পরিপন্থী।

বিজ্ঞাপন

ক্যাপ্টেন হিসেবে নিয়োগ পাওয়া আজিজুল হকের ছিল না বাংলাদেশি কোনো এয়ারলাইন্স ট্রান্সপোর্ট পাইলট লাইসেন্স। সারাবাংলার অনুসন্ধান বলছে, ক্যাপ্টেন আজিজুল হকের জন্ম ১৯৬৪ সালের ২৩ নভেম্বর। তিনি বাংলাদেশে এসএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। এরপর শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন যুক্তরাজ্যে। আর সেখানেই ১৯৯৮ সালে আজিজুল হকের বৈমানিক জীবন শুরু হয়। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি ট্রান্সএয়ার ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের এয়ারবাস এ৩২০ বিমানে ফাস্ট অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অতঃপর দোহার-কাতার এয়ারলাইন্সে ফাস্ট অফিসার হিসেবে ২০০০ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত এয়ারবাস এ৩২০ বিমানে কাজ করেন তিনি। এরপর ২০০৫ সালের অক্টোবর থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত কাতার এয়ারলাইন্সের এ৩২০/এ৩৩০ বিমানের ক্যাপ্টেন হিসেবে কর্মরত ছিলেন আজিজুল হক। তিনি চার্টাড বৈমানিক ও ফ্লাইং ইন্সট্রাকটর হিসেবেও কাজ করেছেন।

এদিকে সারাবাংলার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ২০২০ সালে আজিজুল হক কাতার এয়ারওয়েজের এয়ারবাস৩৮০ বিমানের ক্যাপ্টন ট্রেনিংয়ের সময় অকৃতকার্য হন। পরে একই বছর কাতার এয়ারওয়েজ থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয় আজিজুল হককে। সাধারণত কোনো বৈমানিককে বাংলাদেশে বিমান পরিচালনার জন্য লাইসেন্স নিতে হলে সেই ব্যক্তিতে অবশ্যই সব গ্রাউন্ড সাবজেক্টে বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশনে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পাশাপাশি মেডিকেলেও ফিট থাকতে হবে। কিন্তু বিমানের বোয়িং ৭৭৭ বিমানের মতো উড়োজাহাজের ক্যাপ্টেন হিসেবে নিয়োগ পাওয়া এই বৈমানিক বাংলাদেশি লাইসেন্স নিতে এখন পর্যন্ত সিভিল এভিয়েশনের কোনো ধাপই সম্পন্ন করেননি।

জানা গেছে, সর্বশেষ ২০২০ সালের ৭ অক্টোবর ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন আজিজুল হক। ট্রেনিংয়ে অকৃতকার্য, বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো এবং বাংলাদেশে বিমান পরিচালনার কোনো লাইসেন্স না থাকলেও এই ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ বিমান। অথচ বাংলাদেশ বিমানের নিয়োগ নীতিমালায় যেকোনো বৈমানিককে অবশ্যই বাংলাদেশি লাইসেন্স থাকতে হবে। একইসঙ্গে মেডিকেলেও উত্তীর্ণও হতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ বিমানের নিয়োগে ১ নম্বর শর্তের ১ ও ২ অনুচ্ছেদই অনুসরণ করা হয়নি।

অনুসন্ধান জানাচ্ছে, ক্যাপ্টেন হিসেবে নিয়োগ পাওয়া হোসেন মো. শওকত জাহান কাতার এয়ারওয়েজে ক্যাপ্টেন প্রশিক্ষণে তিন বার ব্যর্থ হন। ফলে তাকে ক্যাপ্টেন হিসেবে পদোন্নতি না দিয়ে স্থায়ীভাবে ফার্স্ট অফিসার হিসেবে রাখে কাতার এয়ারওয়েজ। কাতার এয়ারওয়েজে ফার্স্ট অফিসার হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করলেও আন্তর্জাতিক রুটে ক্যাপ্টেন হিসেবে ফ্লাই করার কোনো অভিজ্ঞতা নেই শওকত জাহানের। এরফানুল হকও কাতার এয়ারওয়েজে ক্যাপ্টেন প্রশিক্ষণে তিন বার অকৃতকার্য হন। তাকেও ক্যাপ্টেন হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা করে স্থায়ীভাবে ফার্স্ট অফিসার হিসেবে রাখে কাতার এয়ারওয়েজ কর্তৃপক্ষ।

নাসিমুল আওয়াল সবশেষ ইত্তেহাদ বিমানের ফার্স্ট অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক রুটে ক্যাপ্টেন হিসেবে বিমান পরিচালনার কোনো অভিজ্ঞাতা এই বৈমানিকের নেই। মারুফ দীর্ঘদিন এমিরেটস এয়ারলাইন্সে ফার্স্ট অফিসার হিসেবে কর্মরত থাকলেও তিনি ক্যাপ্টেন প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ হতে পারেননি। নাসিমকে নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। দুর্ঘটনা ও উড়োজাহাজের নিরাপত্তাব্যবস্থা লঙ্ঘনের দায়ে কাতার এয়ারওয়েজ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন তিনি।

বাংলাদেশ বিমানের ক্যাপ্টেন পদে অভিজ্ঞ বৈমানিকরা আবেদন করলেও অজানা কারণে তারা নিয়োগ পাননি বাংলাদেশ বিমানে। ইতোমধ্যে বিমানে বৈমানিক নিয়োগে দুর্নীতির কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে বিমান মন্ত্রণালয়কে। এ বিষয়ে জানতে ক্যাপ্টেন শাহ নাসিমুল আওয়াল, মো. হারুনর রশিদ, আবদুল্লাহ মারুফকে ফোন দেওয়া হলেও তারা ফোনটি রিসিভ করেননি। অপরদিকে ক্যাপ্টেন হোসাইন মো. শওকত জাহান, আবু নুর মো. তাহমিদুল ইসলামের ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।

তবে নিয়োগ পাওয়ার বিষয় নিয়ে সারাবাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন ক্যাপ্টেন ক্যাপ্টেন আজিজুল হক। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে বিমান বা সিভিল এভিয়েশন ভালো বলতে পারবে।’ বাংলাদেশের সিভিল এভিয়েশন থেকে ইস্যু করা লাইসেন্স আপনার আছে কি না? জানতে চাইলে বলেন, ‘সেটা আপনাকে জানানো উচিত বলে মনে করছি না। এছাড়া আমার জীবনের সব চাকরি আমি বাইরে করেছি। বাংলাদেশে প্রথম চাকরি করতে এসেছি। আমার বয়সও হয়েছে অনেক। এই নিয়োগ নিয়ে যা চলছে সেটা আমার কাছে ভালো লাগছে না। তাই আমি এটা নিয়ে আর কিছুই বলব না।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী (সিইও) ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামালের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এদিকে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পাইলট হিসেবে নিয়োগ পেতে হলে বাংলাদেশি লাইসেন্স এবং লাইসেন্সের মেয়াদ থাকতে হবে কি না?- জানতে চাইলে সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে বিমান পরিচালনা করতে হলে অবশ্যই সিভিল এভিয়েশনে পরীক্ষা দিয়ে বিমান পরিচালনার লাইসেন্স নিতে হবে এবং সেই লাইসেন্সের মেয়াদ থাকতে হবে।’

তাহলে বিমানের ক্যাপ্টেন হিসেবে নিয়োগ পাওয়া আজিজুল হক বাংলাদেশি লাইসেন্স ছাড়া কিভাবে নিয়োগ পেলেন?- জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি অবশ্যই এ বিষয়ে খোঁজ নেব। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের অনিয়ম হয়ে থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সারাবাংলা/এসজে/পিটিএম

ক্যাপ্টেন বাংলাদেশ বিমান বৈমানিক মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্সধারী লাইসেন্সহীন সিভিল এভিয়েশন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর