পদ্মা পাড়ের বাসিন্দাদের স্বপ্নপূরণ, এখন কেবল জয়োৎসবের অপেক্ষা
২৪ জুন ২০২২ ১৫:০৩
ঢাকা: ‘পাড়ির আশায় তাড়াতাড়ি/ সকাল বেলা ধরলাম পাড়ি/ আমার দিন যে গেল সন্ধ্যা হলো/ তবু না কূল পাই/ কূল কিনারা নাই…’
আব্দুল লতিফের কালজয়ী এই গানে উঠে এসেছে পদ্মা পাড়ের মানুষদের চিরকালীন এক বেদনার কথা। কখনো বৈরী আবহাওয়া, কখনো মানুষের চাপ— কিছু একটা হলেই পদ্মা পাড়ের মানুষের জন্য পদ্মা পাড়ি দেওয়া যেন এক ভীষণ যুদ্ধ। প্রমত্ত পদ্মা তাই তাদের কাছে ‘সর্বনাশা’। সেই সর্বনাশা দিন পেরিয়ে যুদ্ধ অবসানের দিন আসছে। পদ্মা পাড়ি দিতে আর কাউকে ঝড়-ঝঞ্ঝার মুখে বসে থাকতে হবে না ঘাটে। ইদ-পার্বণে মানুষের ঢল নামলেও আর বসে থাকতে হবে না ঘাটের মুখে। তাদের সেই দুশ্চিন্তার অবসান ঘটাতেই যে উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছে পদ্মা সেতু।
অপেক্ষা আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার। আগামীকাল শনিবার (২৫ জুন) সকালেই খুলছে সেই স্বপ্নের দ্বার, যে দ্বার দিয়ে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার কোটি মানুষ নির্বিঘ্নে প্রবেশের সুযোগ পাবে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বাকি অংশে। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে উপস্থিত থেকে সেই স্বপ্নপূরণের মাহেন্দ্রক্ষণের সূচনা করবেন। এর জন্য প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি এরই মধ্যে শেষ। এখন কেবল পদ্মা পাড়ে জয়োৎসবের অপেক্ষা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও লাখো জনতার উপস্থিতিতে সেই মাহেন্দ্রক্ষণকে বরণ করে নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সূচি বলছে, সকালে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে সুধি সমাবেশে উপস্থিত থেকে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাজিরা প্রান্তের টোল প্লাজার সামনে উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করে সুধী সমাবেশ শেষে তিনি যোগ দেবেন জাজিরা প্রান্তের জনসভায়। মাদারীপুরের শিবচরের সেই কাঁঠালবাড়িতে উদ্বোধনী জনসভার মঞ্চটি তৈরি করা হয়েছে পাল তোলা নৌকার আদলে।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী জনসভা সফল করতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দিনরাত ব্যস্ত সময় পার করছেন। জনসভায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার ১০ লাখেরও বেশি মানুষের সমাগম ঘটানোর প্রত্যাশা তাদের।
প্রধানমন্ত্রীর শনিবারের কর্মসূচিতে জানানো হয়েছে, এদিন সকাল সাড়ে ৯টায় তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে হেলিকাপ্টারে করে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তের উদ্দেশে রওনা হবেন তিনি। সকাল ১০টায় মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন। এরপর ১১টায় পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকিট, স্যুভেনির শিট, উদ্বোধনী খাম ও সিলমোহর অবমুক্ত করবেন। ১১টা ১২ মিনিটে টোল দিয়ে মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-১ উন্মোচন করে মোনাজাতে অংশ নেবেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী এরপর ১১টা ২৩ মিনিটে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্ত থেকে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তের উদ্দেশে সড়কপথে যাত্রা করবেন। ১১টা ৪৫ মিনিটে জাজিরা প্রান্তে উপস্থিত হয়ে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ফলক ও ম্যুরাল-২ উন্মোচন শেষে মোনাজাতে অংশ নেবেন। দুপুর ১২টায় মাদারীপুর শিবচর উপজেলার কাঠালবাড়ীতে অনুষ্ঠেয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জনসভায় অংশ নেবেন। জনসভা শেষে বিকেল সাড়ে ৫টায় জাজিরা প্রান্ত থেকে হেলিকাপ্টারে করে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করবেন।
স্থানীয় প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য বলছে, স্বপ্নপূরণের মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় এখন পদ্মার পাড়ের মানুষ। বহুল প্রতীক্ষিত ও কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের পদ্মা সেতুকে ঘিরে স্বপ্ন দেখছে গোটা দক্ষিণাঞ্চল। এই অঞ্চলের অধিবাসীদের প্রত্যাশা, জনপদের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে এই অঞ্চল। এজন্যই পদ্মা সেতুকে ঘিরে এতো স্বপ্ন এবং উচ্ছ্বাস এখন মানুষের মধ্যে।
এরই মধ্যে পদ্মা সেতুর জনসভাস্থলে মঞ্চ তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আজ শুক্রবার (২৪ জুন) বিকেলের মধ্যে মোটামুটি সব প্রস্তুতি শেষ হয়ে এসেছে। লাখ লাখ মানুষের জনসভায় উপস্থিতিকে প্রাধান্য দিয়ে সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে ৫০০ টয়লেট, থাকছে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা। নদীপথে আসা মানুষের জন্য তৈরি করা হচ্ছে ২০টি পন্টুন। ২৫ তারিখের জন্য সবাই অপেক্ষায় রয়েছে। ঘরে ঘরে যেন উৎসব আনন্দের বন্যা।
শিবচরের কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নের মানুষেরা বলছেন, আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। এখন যেন সময় যেতেই চাচ্ছে না। ২৫ তারিখের জন্য অপেক্ষায় আছি। জনসভার মঞ্চ প্রস্তুতসহ চারপাশে সাজানো হচ্ছে। আলোকসজ্জা করা হচ্ছে। দেখতেই ভালো লাগছে। পদ্মায় সেতু হতে পারে— এমন ভাবনা কল্পনাতেও ছিল না। ঝড়-বৃষ্টি, বর্ষায় ঢাকা যাওয়া ছিল এ এলাকার মানুষের কাছে সবচেয়ে কঠিন এবং কষ্টের। আমাদের এলাকায় তেমন রাস্তাঘাট ছিল না। বৃষ্টিতে কাদাপানি পায়ে মেখে চলতে হয়েছে। এক পদ্মা সেতুই এখন এই এলাকার চিত্র পাল্টে দিতে যাচ্ছে। আগে আমাদের ‘গাঁও-গেরামের লোক’ বলে ডাকত সবাই। এখন আবার অসংখ্য মানুষ আমাদের এখানেই ঘুরতে আসছে। গোটা এলাকা এখন জমজমাট। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ।
পদ্মাপাড়ের গ্রাম চরজানাজাত এলাকার তরুণ মারুফ হাসান বলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে আমাদের উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। জনসভা হবে আমাদের শিবচরের বাংলাবাজার ঘাটে। পদ্মার পাড়েই। আমাদের এলাকায় উৎসবের আমেজ বইছে।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ক‘দিন আগেই বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আগামী ২৩ জুন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। তার পরপরই বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রতীক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বীর কন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ম শেখ হাসিনার সাহসের প্রতীক সোনালী ফসল পদ্মা সেতুর উদ্বোধন।
উচ্ছ্বাসের সঙ্গে কাদের বলেন, অনেক গীবত-বাধা-বন্ধুর পথ অতিক্রম করে অনেক প্রতিকূল স্রোতকে উপেক্ষা করে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকে অতিক্রম করে পরাজিত করে বঙ্গবন্ধুকন্যা আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছেন। এই পদ্মা সেতু মানেই শেখ হাসিনা, শেখ হাসিনার বীরত্ব সাহসিকতার প্রতীক হচ্ছে পদ্মা সেতু। এই সেতু ঘিরে গোটা শেখ পরিবারকেই দুর্নীতির অপবাদ দেওয়া হয়েছে। এত অপবাদ, এত মিথ্যাচারের পরও শেখ হাসিনা ছিলেন হিমালয়ের মতো অটল। যে কারণেই এই পদ্মা সেতু আমরা নির্মাণ করতে পেরেছি।
সম্প্রতি পদ্মা সেতু পরিদর্শনে যাওয়া একদল সাংবাদিকদের সামনে পদ্মা সেতুর সার্ভিস এলাকার মিলনায়তনে বসে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন সেতুমন্ত্রী। সেখানে তিনি বলেন, এই প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি। যত সমালোচনা হয়েছে, মনোবল তত দৃঢ় হয়েছে। বিশ্বব্যাংক সেই ভুল স্বীকারও করেছে। সেতু উদ্বোধনে তাদেরও আমন্ত্রণ জানানো হবে। শুধু তারাই নয়, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ড. মুহাম্মদ ইউনূস থেকে শুরু করে যারা এর বিরোধিতা করেছিলেন, সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। এই সেতু আমাদের সামর্থ্য ও সক্ষমতার সেতু। এই সেতু একদিকে যেমন সম্মান আর মর্যাদায় প্রতীক, তেমনি আমাদের যে অপমান করা হয়েছিল, সেই অপমানের প্রতিশোধের প্রতীকও।
সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী এরই মধ্যে সবাইকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। তবে আমন্ত্রণপত্র পেয়েও সেটি প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি।
এর মধ্যে গত ২২ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে জাজিরা প্রান্তে সমাবেশস্থল পরিদর্শন এবং জনসভার প্রস্তুতি সফল করার কার্যক্রম পরিদর্শনে যান আওয়ামী লীগ নেতারা। সেখানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন আগামী ২৫ জুন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ১০ লাখ মানুষের সমাগম হবে। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য থাকবে ১৫ থেকে ২০ লাখ মানুষের সমাগম করা। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসতে শুরু করেছে। শুধু তাই নয়, বিদেশ থেকে দেশে আসার টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ বিদেশে থাকা প্রবাসী আমাদের ভাইয়েরা দেশে আসতে শুরু করেছে । তারাও স্বপ্নের সোনার পদ্মা সেতু দু’চোখে দেখতে চায়, তারাও সেতুর উদ্বোধনী দিনের সমাবেশে যোগ দিতে চায়।
নানক বলেন, উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের জনগণের উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, এই পদ্মা সেতু তৈরি করতে ষড়যন্ত্রকারীরা দেশে-বিদেশে চক্রান্ত করেছে। তাই আগামী ২৫ জুন সমাবেশ সফল করার মাধ্যমেই ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙা জবাব দিতে হবে।
বৃহস্পতিবার (২৩ জুন) দলের ৭৩তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য আব্দুর রহমান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার উদ্দেশে বলেন, আপা, গতকাল আমরা কয়েকজন গিয়েছিলাম। পদ্মা আপনার জন্য অধীর আগ্রহে আছে। পদ্মা পারের লাখো কোটি মানুষ আপনাকে এক নজর দেখার জন্য সাহসী ও সাহসীকার জননী ‘পদ্মা কন্যা’ শেখ হাসিনাকে চোখে দেখার জন্য অপেক্ষা করে আছে। প্রিয় নেত্রী, আপনি ধারণাই করতে পারবেন না— ওখানে শুধু মানুষের সমাবেশ হবে না, ওখানে উৎসবের সমাবেশ হবে। ওখানে আনন্দের জোয়ারে নতুন পদ্মা সৃষ্টি হবে, সেই অপেক্ষায় আছে মানুষ।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান সারাবাংলাকে বলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের গর্বের সেতু এই পদ্মা সেতু। প্রতিটি মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলনের প্রতীক হচ্ছে পদ্মা সেতু। আমি মনে করি, পদ্মা সেতুর জন্য এক থেকে দেড় শতাংশ আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়বে। এটার কারণে শুধু আমাদের দেশের ভেতরে না, দেশের বাইরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলেও যাতায়াত সহজ হবে এবং এর মাধ্যমে আমাদের সংযোগ বাড়বে। আর সংযোগ যখন বাড়বে, তখন সাধারণ মানুষের উপকার হবে। আমি আমার কথা বলছি না, সাধারণ একজন মানুষ তারা ঢাকা থেকে মাওয়া ঘাটে যেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। আর বৈরী আবহাওয়া বা ইদের সময় তো প্রচণ্ড কষ্ট করতে হয়েছে মানুষকে। পদ্মা সেতুর ফলে আমরা আশা করি সেই কষ্টগুলো অনেক দূরীভূত হবে।
‘আমি মনে করি, পদ্মা সেতু নির্মাণ আমাদের শৌর্য-বীর্য, আমাদের স্বাধীনতা এবং আমাদের এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার একইভাবে বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানেও এ ধরনের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। আমরা আশা করি, শিগগিরই আরও এমন অনেক স্থাপনাই পাবে বাংলাদেশ,’— বলেন সাবেক মন্ত্রী ফারুক খান।
সারাবাংলা/এনআর/টিআর
জয়োৎসব পদ্মা পাড়ে জয়োৎসব পদ্মা সেতু পদ্মা সেতুর উদ্বোধন পদ্মা সেতুর জনসভা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বপ্নপূরণ