বজ্রপাতে নিহত ৩ হাজার, মৃত্যুর সংখ্যা নামাতে আসছে পাইলট প্রকল্প
২৬ জুন ২০২২ ২৩:১৫
ঢাকা: জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব তো বটেই, এর বাইরে ভৌগোলিক অবস্থান, সচেতনতার অভাব, উঁচু গাছ কাটাসহ নানা কারণে প্রতিবছরই বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। গত ১২ বছরে এ সংখ্যা তিন হাজারে ঠেকেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষকে সচেতন করা গেলে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা অনেকাংশে কমে যেত। এদিকে বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে অ্যারেস্টর বা বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রায় ৯শ কোটি টাকা ব্যয়ে নেওয়া পাইলট প্রকল্পটি এখন একনেক বৈঠকে অনুমোদনের অপেক্ষায়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী বলেছেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা গেলে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কমে আসবে।
আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের মতে, বজ্রপাতের অন্যতম কারণ তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া। সেক্ষেত্রে ১ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে বজ্রপাতের আশঙ্কা বেড়ে যায় অন্তত ১২ শতাংশ। বজ্রপাত কমবেশি সব দেশেই হয়ে থাকে। তবে তা নির্ভর করে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে।
নানা সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী— দক্ষিণ এশিয়ায় বজ্রপাত বেশি হওয়া দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। আর এখানে বজ্রপাত বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে গবেষকরা বলছেন, বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর থেকে আসা গরম ও আর্দ্র বাতাস এবং উত্তরাংশ থেকে আসা পাহাড়ি ঠান্ডা বাতাসের কারণে বাংলাদেশে বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে— বাংলাদেশে মূলত ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর এই ৯ মাস জুড়েই হয় বজ্রপাত। তবে এপ্রিল ও জুনে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়ে থাকে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসেবে গত ২০১১ সাল থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত সাড়ে এগার বছরে বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে ২৯ হাজার ৯৫১ জন মানুষের।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে— ২০১১ সালে বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে ১৭৯ জনের, ২০১২ সালে ২০১ জন, ২০১৩ সালে ১৮৫ জন, ২০১৪ ১৭০ জন, ২০১৫ সালে ২২৬ জন, ২০১৬ সালে ৩৯১ জন, ২০১৭ সালে ৩০৭ জন, ২০১৮ সালে ৩৫৯ জন, ২০১৯ সালে ১৯৮ জন, ২০২০ সালে ২৫৫ জন। ২০২১ সালে ৩৬৩ জন এবং ২০২২ সালে মে মাস পর্যন্ত মারা গেছে ১১৭ জন।
এ হিসাব অনুযায়ী বছরে গড়ে বজ্রপাতে ২৬৫ দশমিক ৫ জনের মৃত্যু হয় এই বজ্রপাতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তালগাছ সহ উঁচু গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বজ্রপাতে মৃত্যু বাড়ছে।
বজ্রপাত দিয়ে একটা দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগ। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. তৌহিদা রশীদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বজ্রপাত এমন একটা দুর্যোগ, যাতে মানুষের দ্রুত মৃত্যু ঘটে। ভৌগলিক কারণে যেহেতু আমাদের দেশ বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ন, সেহেতু সচেতনতা আমাদের জন্য বেশি জরুরি।’
তিনি বলেন, ‘উন্নত দেশগুলো ত্রিশ শতাংশে নামিয়ে এনেছে শুধুমাত্র মানুষকে সচেতন করে। এটি এমন একটা বিষয় যে আপনি এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন এখানেই বজ্রপাত পরবে। তার পূর্বাভাস দেওয়া যায় না। তবে যে এলাকা অর্থাৎ যে উপজেলায় বজ্রপাত হতে পারে তার পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব।’
তিনি বলেন, ‘এলাকাবাসীরও বুঝতে হবে যে বজ্রপাত যখন হবে তাকে কী করতে হবে? আকাশের কি অবস্থায় বজ্রপাত হতে পারে সেটি তাকে বুঝতে হবে। বজ্রপাতের সময় কোথায় সে আশ্রয় নেবে। বজ্রপাত হওয়ার ত্রিশ মিনিট রিস্ক থাকে। এই যে বজ্রপাতের আগে, হওয়ার সময় এবং পরের ত্রিশ মিনিট সময়কে একটা শেল্টারে থাকতে হবে। যেটা হতে হবে সেভ শেল্টার। যদি সে খোলা মাঠে থেকেও যায় তাহলে কিছু কৌশল রয়েছে সেগুলো মানুষকে জানানো যেতে পারে। বাংলাদেশে মানুষকে যদি সচেতন করানো যেতো তাহলে মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনা যেত।’
প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত বলছে— বাংলাদেশে বজ্রপাত হয়ে থাকে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পুরা নয় মাস। তবে মৌসুম নির্ভর হয়ে থাকে বেশি। জানা গেছে মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে বজ্রপাত বেশি হয় হাওরাঞ্চলে। যেমন কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট ও নেত্রকোনা জেলায়। জুন, জুলাই, আগস্টে হয়ে থাকে সুনামগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, টাঙ্গাইল, বরিশাল। অন্যদিকে কুড়িগ্রাম ও পঞ্চগড়ে বজ্রপাত বেশি হয়। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরে পাবর্ত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কক্সবাজারে সবচেয়ে বেশী বজ্রপাত হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবহাওয়ার ভৌগলিক কারণে একেক অঞ্চলে একেক সময়ে বজ্রপাত কম বেশি হয়ে থাকে। তবে বজ্রপাত বেশিরভাগ হয়ে থাকে খোলা মাঠে। কৃষি কিংবা অকৃষি খোলা জমিতে। বজ্রপাত ভূপৃষ্ঠের যে স্থানে আঘাত করে সেখান থেকে বিদ্যুৎ ভূমির সব দিকে চলাচল করতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খোলা মাঠে বজ্রপাত হলে প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে বিদ্যুতায়িত হতে পারে। কেউ যদি বজ্রপাতের লক্ষ্যের কাছাকাছি থাকে তবে ভূমির বৈদ্যুতিক প্রভাবে তার মৃত্যু হতে পারে। তবে গাছের নিচে থাকলে বজ্রপাত ওই গাছের ওপর দিয়েই চলে যায়। মানুষের প্রাণ বেঁচে যায়। সে জন্য বিশেষজ্ঞরা মানুষকে সচেতন করার ওপরে জোর দিয়েছেন।
এদিকে বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকাতে ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮ জেলায় বজ্রপাতের গতি প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ যন্ত্র স্থাপন করেছে আবহাওয়া অধিদফতর। যন্ত্রটি সাইরেন বাজিয়ে লাল হলুদ ও নীল রঙের মাধ্যমে বজ্রপাতের সর্তক সংকেত দেয়। এর মাধ্যমে বজ্রপাত ও বজ্র ঝড় কোন অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হবে তা এক ঘন্টা আগেই জানিয়ে দিতে পারে আবহাওয়া অফিস।
এ প্রসঙ্গে আবহাওয়াবিদ কাওসার পারভীন বলেন, ‘আমরা এখন আগাম জানতে পারছি ঝড় কোন দিক থেকে আসছে, বাতাসের গতিবেগ কেমন হতে পারে, আরও জানতে পারছি কতগুলো বজ্রপাত হবে।’
বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে কাজ করছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। বজ্রপাত হলেও মৃত্যু হবে না এমন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ শুরু করেছে। হাওরাঞ্চলসহ দেশের বজ্রপাতপ্রবণ ২৩ জেলায় বসবে এ প্রযুক্তি। প্রাথমিক পর্যায়ে হাওর এলাকার ১৫ টি স্থানে বসানো হচ্ছে বজ্র নিরোধক যন্ত্র। আরো লাইটেনিং শেল্টার।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে একটি পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে হাওর এলাকায়। কারণ হাওরে বজ্রপাত সবচেয়ে বেশি হতে দেখা যায়। প্রথমে ১৫টি স্থানে বজ্র নিরোধক বা অ্যারেস্টর বসানো হবে। এই উদ্যোগ সফল হলে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কমে আসবে।
জানা গেছে, দশ মিটার উচ্চতার এই অ্যারেস্টর কৃষি জমি বা খোলা মাঠে ১ কিলোমিটার দূরত্বে বসানো হবে। বজ্রটি ভূমিতে আসতে বাধা দেবে। এতে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা শূন্যে নেমে আসবে। এগুলো একশো মিটার এরিয়া পর্যন্ত নিরাপত্তা দেবে। প্রায় ৯০০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি এখন একনেক বৈঠকে অনুমোদনের অপেক্ষায়।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. তৌহিদা রশীদ বলেন, ‘সরকার বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে অনেক প্রকল্প নিয়েছে। কিন্তু তার সুফল পেতে অনেক সময় লাগবে। হাওর এলাকার মানুষ হয়ত কিছু উপকৃত হবে। কিন্তু বড় কথা হলো এগুলো কোথায় লাগানো হচ্ছে তা মানুষ জানে না। মানুষকে আগে সচেতন করতে হবে।’
৮০ শতাংশের বেশি বজ্রপাত খোলা মাঠে হয়ে থাকে উল্লেখ করে বলেন, ‘এ সব উদ্যোগের পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করতে হবে। খোলা মাঠের চারপাশে প্রচুর উঁচু গাছ লাগাতে হবে। সরকার চাইলে আমাদের গবেষণা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে। আমরা বজ্রপাতের ৪০ মিনিট আগে পূর্বাভাস দিতে পারব।’
সারাবাংলা/জেআর/একে