করোনায় বেড়েছে শিশু-কিশোরদের ডিভাইস আসক্তি-মানসিক সমস্যা
২৮ জুন ২০২২ ১০:২৮
ঢাকা: দেশে দীর্ঘ সময়ে কোভিড-১৯ সংক্রমণ পরোক্ষভাবে নানারকম প্রভাব ফেলেছে শিশু-কিশোরদের জীবনে। একদিকে মোবাইল ও ডিভাইসের প্রতি আসক্তি যেমন বেড়েছে, অন্যদিকে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যেও পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। এতে আচরণগত বিভিন্ন সমস্যা ও অতিমাত্রায় চঞ্চলতার পাশাপাশি পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতিও ঘটছে শিশু-কিশোরদের।
অভিভাবক ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু হলেও শিশু-কিশোরদের বড় অংশ এখনো মানসিকভাবে পুরোপুরি আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারেননি। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু থেকে শুরু করে কিশোরদের মধ্যে ডিভাইসের আসক্তি কমানো যাচ্ছে না, নিয়ন্ত্রণে আসছে না মানসিক অস্থিরতাও। একইভাবে মা-বাবার মধ্যে বিষণ্নতার প্রভাব এবং একইসঙ্গে অভিভাবকদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সময় না পাওয়ার কারণেও শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশু-কিশোরদের মানসিক সমস্যা সমাধানের জন্য বাসায় অভিভাবক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের দায়িত্ব নিতে হবে। সন্তানদের দিতে হবে পর্যাপ্ত সময়। তাদের মধ্যে কী ধরনের পরিবর্তন আসছে, বুঝতে হবে সেগুলোকে। মা-বাবা নিজেরাই বিভিন্ন ডিভাইসে ব্যস্ত হয়ে পড়লে সন্তানদের ওপরও তার প্রভাব পড়বেই।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, দীর্ঘদিন শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে থাকায় শিশু-কিশোরদের এখন শ্রেণিকক্ষে পাঠদান বা পরীক্ষা নিয়ে খুব বেশি চাপ দেওয়া যাবে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভালো ফলাফলের জন্য বাড়তি চাপ দিলে বরং তাদের মানসিক অস্থিরতা আরও বেড়ে যেতে পারে। তাছাড়া শিক্ষার্থীরা যতটুকু মানসিক সমস্যায় ভুগছে, তার জন্য প্রয়োজনে মনোবিদদের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
কী বলছে গবেষণা?
দেশে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকেই দেশের সব স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর প্রায় দেড় বছর টানা বন্ধ ছিল সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই সময়ে শিশু-কিশোরদের মধ্যে মানসিক ও আচরণগত সমস্যা আগের তুলনায় বেশি হওয়ার তথ্য উঠে এসেছে একটি গবেষণার ফলাফলে।
গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিড-১৯ সংক্রমণের আগে ৪ থেকে ১০ বছর বয়সের শিশুদের মধ্যে মানসিক ও আচরণগত সমস্যা ছিল ১৫ শতাংশের এবং ১১ থেকে ১৭ বয়সীদের একই সমস্যা ছিল ১৮ শতাংশের। তবে কোভিড-১৯ সংক্রমণের জন্য কঠোর বিধি-নিষেধ চলাকালীন সময়ে গড়ে ২১.৫ শতাংশ শিশু-কিশোরের মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা বেড়েছে। অর্থাৎ করোনা প্রাদুর্ভাবের আগের সময়ের তুলনায় প্রায় ৫ শতাংশ বেশি। তবে বিধিনিষেধ না থাকলেও পরবর্তী পরিস্থিতিতে শিশু-কিশোরদের মধ্যে মানসিক রোগ ৩৯.৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় গবেষণায়।
২০২২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয় এই গবেষণা। ‘কোভিড-১৯ মহামারির সময় শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মানসিক ও আচরণগত পরিবর্তন এবং তাদের পিতা-মাতার হতাশার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক’ শিরোনামে গবেষণাটি করেছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দীন আহম্মেদ, একই প্রতিষ্ঠানের আরেক সহযোগী অধ্যাপক ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ খান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ডা. সিফাত ই সাঈদ।
গবেষণায় অনলাইনমাধ্যম ব্যবহার করে ৫১২ জন মা-বাবার ওপর সমীক্ষা চালানো হয়। এ সময় ২৯৩ জন মা (৫৭.২%) এবং ২১৯ জন বাবা (৪২.৮%)তাঁদের সন্তানদের পর্যবেক্ষণমূলক তথ্য জানান গবেষক দলকে।
গবেষণায় দেখা গেছে, চার থেকে ১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে গড়ে ২১.৫ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের মানসিক ও আচরণগত সমস্যায় ভুগেছে। মানসিক সমস্যায় ভোগে ১০.২ শতাংশ এবং আচরণগত সমস্যা হয়েছে ২৬.৮ শতাংশের। অতিচাঞ্চল্য (হাইপার অ্যাক্টিভিটি) ছিল ১৯.৯ শতাংশের মধ্যে। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে ৩৬.৫ শতাংশের।
গবেষক দলের অন্যতম সদস্য জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দীন আহম্মেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের মানসিক বিকাশের বিষয়গুলোর কোভিডের আগের ইতিহাস বিবেচনায় নিয়েছি। তথ্য সংগ্রহের সময় পরিবারে কোভিড রোগী থাকার কারণে অনেক পরিবার লকডাউনের আওতায় ছিল। এই জরিপের ৩৪.২ শতাংশ উত্তরদাতা লকডাউনের আওতায় বাড়িতে ছিলেন। এ ক্ষেত্রে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের সমস্যাগুলো বেশি পাওয়া গেছে। অতি আবেগের লক্ষণ, আচরণগত সমস্যা, অস্থিরতা-অসাবধানতা, সামাজিক নয় এমন আচরণ বিবেচনায় নেওয়া হয়।’
শিশু-কিশোরদের মানসিক অবস্থা এখন কেমন?
রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের সমণ্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা শিক্ষক লিরা ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, প্রাথমিকভাবে নতুন ভর্তি হওয়া শিশুদের মাঝে খুব একটা বেশি সমস্যা দেখা যায় না। কারণ এই বাচ্চাদের অনেকেই আসলে কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়েই ভর্তি হওয়া। তবে তুলনামূলকভাবে বড় বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে পঞ্চম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মাঝে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে যা আসলেই ভয়ানক।
তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে মোবাইল ও অন্যান্য ডিভাইসের প্রতি আসক্তির বেশি প্রভাব দেখা যায় উঠতি বয়সের কিশোর-কিশোরীদের মাঝে। স্কুল টাইমে পড়াশোনার চাইতে তারা বেশিরভাগ সময় দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন গেইমস নিয়ে আলোচনা করছে। লেজার টাইমে দেখা যায় খেলার মাঠে যায় না অনেকেই। অতিরিক্ত ডিভাইসের আসক্তির কারণে অনেকেরই চোখে এখন দূরদৃষ্টির ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা দেখা যাচ্ছে। ডিভাইসে অনেকক্ষণ দেখে থাকার কারণে তারা দূরের জিনিস কম দেখতে পাচ্ছে। কোনো কোনো বাচ্চার দেখা যায় ব্লিংকিং আইস আসছে আবার কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে কোনো কারণ ছাড়াই এলার্জেটিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। গার্জিয়ানরা এসে আমাদের জানায়, বাচ্চাদের এখন সেই ডিভাইস থেকে সরাতে বেগ পেতে হচ্ছে। স্কুলেই যতটুকু পড়াশোনা হয় ততটুকুই, তারা বাসায় গিয়ে কিছু করছে না। প্রতিদিনই এ ধরণের অভিযোগ আসে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কোভিড-১৯ সংক্রমণ যখন বেশি ছিল তখন বাচ্চারা কিন্তু বাইরে খেলাধূলা করতে যেতে পারে নি। এ জন্য তাদের অনেকেই শারীরিকভাবে একটু মোটা হয়েছে। একইসঙ্গে তাদের মাঝে অস্থিরতা ভাবটাও তৈরি হয়েছে। প্রায় সব বয়সী বাচ্চাদের মাঝেই এই সময়ে ডিভাইসের প্রতি একটা আলাদা আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এখন ডিভাইসে অ্যাডিক্টেড বাচ্চারা স্কুল থেকে বাসায় ফিরে যাওয়ার পরেই সেটা চাইতে থাকে। যদি না দেওয়া হয় তখনই সে উত্তেজিত হয়ে মিসবিহেভ করা শুরু করে। বড় বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটা হয়ে থাকে বেশি। আরেকটা ক্ষতিকর প্রভাব দেখতে পাচ্ছি বিশেষ করে ছেলেদের মাঝে। এদের মাঝে কিছু বাচ্চা নেগেটিভভাবে ডিভাইস ব্যবহার করেছে। সংখ্যায় খুবই অল্প হলেও এই ধরণের পরিবর্তনও কিন্তু আমরা খেয়াল করেছি। অভিভাবকরাও এসব বিষয়ে আমাদের জানাচ্ছেন।’
এম আর খান শিশু হাসপাতালের ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগের প্রধান ও শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ফরহাদ মনজুর সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাচ্চাদের বর্তমানে যেসব সমস্যা দেখা দিচ্ছে সেগুলো পোস্ট কোভিড এফেক্ট-এমনটা বলা যাবে না। এটা কোভিড-১৯ পিরিয়ডের একটা প্রভাব বলা যেতে পারে। অর্থাৎ বর্তমানে শিশুরা যেসব সমস্যায় ভুগছে সেগুলোর জন্য কোনো রোগকে দায়ী করা যাবে না কিন্তু রোগের জন্য যে পরিবেশ সৃষ্ঠি হয়েছে তাকে দায়ী করতে হবে। কোভিড-১৯ সংক্রমণ যখন বেড়েছে তখন সবাই বাসায় ছিল।’
তিনি বলেন, ‘চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে আমরা সবাইকে অনুরোধ করে বলতাম বাচ্চাদের হাতে যেনো ডিভাইস দেওয়া না হয়। লকডাউন বলি বা কঠোর বিধিনিষেধ সেই সময়ে কিন্তু এই অনুরোধটা মানা হয় নাই। ফলে বাচ্চাদের হাতে ডিভাইসের ব্যবহার বেড়েছে। ওরা গেইমস খেলতো বা চ্যাট করতো ডিভাইসে। দেখা গেলো সামনাসামনি বসে ত্থেকে দুইজন বাচ্চা ডিভাইসে কিছু একটা করছে। সেই সময়ে তারা একজন আরেকজনের সঙ্গে আর কথা বলছে না। অর্থাৎ তারা ডিভাইস নির্ভর হয়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘চ্যাট করার সময়ে দেখা যাচ্ছে নানা বিষয়ে নিয়ে ভাবা হচ্ছে। আবার গেমস খেলার সময়ে দেখা যায় তারা নানা রকমের বিষয়ে সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে যা আসলে সেই বয়সে হওয়ার কথা না। দেখা গেলো ১০ সেকেন্ডে সেখানে কেউ ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বা আমেরিকা চলে যাচ্ছে। বাচ্চা যখন সেই গেইমস খেলে তখন তার মাইন্ড সেট হয় এক ধরণের কিন্তু সেই দ্রুতগতির ধারা কিন্তু বাস্তব জীবনে সে পায় না। আর তখন সে আবার গেইমের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে রাখে। এসময় যদি তাকে ডিভাইস দেওয়া না হয় তখনই সে খিটখিটে মেজাজের হয়ে যায়।’
ডা. ফরহাদ মনজুর বলেন, ‘উঠতি বয়সী কিশোরদের মাঝে বেশি মাত্রায় ডিভাইসের ব্যবহারও ক্ষতি ডেকে আনছে। অভিভাবক হয়তো ভাবছে সে পড়াশোনা বা গেইমস খেলছে কিন্তু আসলে সে পর্ণ সাইটে ব্রাউজ করছে। কারণ নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি সবারই আকর্ষণ থাকে সেই বয়সে। ফ্রি ওয়াইফাইয়ের যুগে এটা আপনি ঠেকাবেন কিভাবে? নিষিদ্ধ করা হলেও কিভাবে সেগুলোতে ঢুকতে হয় বাচ্চারা তাও জানে। আর এগুলো নানা ধরণের মানসিক অসুস্থতা সৃষ্টি করে শিশুদের মাঝে। এর প্রভাব তখন পরিবারে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও দেখা যায়।’
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ডা. সিফাত ই সাঈদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাসপাতাল ও চেম্বারে আমরা এখন অনেক শিশুকেই পাচ্ছি যারা কোভিড-১৯ সংক্রমণ পরিস্থিতিতে নানাভাবে মানসিক সমস্যায় ভুগছে। বিশেষ করে উঠতি বয়সের কিশোর-কিশোরীদের যারা তারা অনেক বেশি মাত্রায় ডিভাইস অ্যাডিক্টেড হয়ে গেছে। অনেকেই আবার দেখা গেছে এখন আর অফলাইনে অর্থাৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে ক্লাস করতে চায় না। তারা চায় যে অনলাইনেই যেনো ক্লাস হয়। কারণ তারা এটাতে অভ্যস্থ হয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘কোভিড-১৯ সংক্রমণ তো প্রায় তিন বছর হয়ে যাচ্ছে। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আস্তে আস্তে যে ডিভাইস ব্যবহার শুরু হয় সেটাতেই শিশু-কিশোররা তার উপরে নির্ভরশীল হয়ে গেছে। এটা তো চাইলেই তাদের ভোলানো যাবে না। ডিভাইসের উপর নির্ভরশীলতা থেকে স্বাভাবিক জীবনে তাদের আনাটা কিন্তু সময়সাপেক্ষ বিষয়। এটাকে আমরা ইন্টারনেট অ্যাডিকশন বলি। কোভিড-১৯ পিরিয়ডের আগে যা ছিল তার চাইতে অনেক বেশি মাত্রায় বর্তমানে এই অ্যাডিকশন আছে শিশু-কিশোরদের মাঝে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে ভার্চুয়াল অনেক গেমস কিন্তু একা খেলা যায় না। দেখা যায় স্কুল বা কলেজের একটা বন্ধু সার্কেল মিলে একই গেইম খেলছে। পাবজি, ফ্রি-ফায়ার এগুলো কিন্তু একা খেলা যায় না। এই গেমসগুলোতে তাদের সঙ্গী লাগবে। তখন তারা দেখা যায় একটা চ্যাট গ্রুপ বা স্কুল চলাকালীন সময়ে আলাদা একটা জগতে নিজেরাই কথা বলে ও খেলে। সেখানে সবাই গেইম নিয়েই কথা বলছে, কি করতে হবে তা নিয়ে আলোচনা করছে আর এগুলো করতে গিয়ে অটোমেটিকভাবে নিজে থেকেই সেই গেইমের প্রতি আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। তাকে যদি এই আসক্তি থেকে সরাতে হয় তবে সেই গ্রুপ থেকেও বিচ্ছিন্ন করতে হবে আগে।’
ডা. সিফাত বলেন, ‘অনেক গেমের ক্ষেত্রে দেখা যায় সেখানে বয়স বিবেচনায় কিছু অপ্রাসঙ্গিক ও আপত্তিকর কনটেন্ট থাকে। আবার কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় পর্ন সাইট বা এমন কিছু কন্টেন্ট থাকে যা হয়তো সেই বয়সে তার জানারই কথা না। এগুলোর বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যান করা প্রয়োজন। কিন্তু দেখা যায় সেই ব্যান করা গেইমগুলোও তারা খেলছে ভিন্ন কোনো পদ্ধতি ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে আমাদের প্রশাসনের তৎপরতাও বাড়ানো প্রয়োজন।’
সমাধান কী?
রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা শিক্ষক লিরা ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্কুলে যতটুকু সময় বাচ্চারা থাকছে তখন আমরা নানাভাবে তাদের মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করি, কাউন্সেলিংও করা হয়। তবে অভিভাবকদের আরেকটু বেশি সচেতন হয়ে বাচ্চাদের সময় দেওয়া প্রয়োজন বলেও মনে করি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের স্কুল শাখায় প্লে গ্রুপ থেকে বাচ্চাদের ভর্তি করানো হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে আমরা যেটা করি তা হলো বাচ্চাদের শিক্ষার পাশাপাশি কোনো না কোনো ধরণের মানসিক রিফ্রেশমেন্টের ব্যবস্থা। স্পেশালি ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ডান্স ক্লাস, আবৃত্তি, গান ও ফিজিক্যাল ইন্সট্রাকটরের মাধ্যমে পিটি প্যারেড করানো হয়। একইসঙ্গে ফান ক্লাসের মাধ্যমে আমরা চেষ্টা করছি তাদের মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখার জন্য। একদম ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে সব বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য আমরা এটা করে থাকি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মাধ্যমিক পর্যায়ে থাকা শিক্ষার্থীদেরও কিন্তু ফান ক্লাস করানোর চেষ্টা করছি। অ্যাসেম্বলির পাশাপাশি মানসিকভাবে তাদের যতটুকু চাঙ্গা করা যায় সেটুকু করা। একইসঙ্গে সিলেবাস কাভার করা আমাদের জন্যে টাফ হয়ে যাচ্ছে অনেকটা। কারণ আসলে অনলাইন ক্লাসে দেখা গেছে গত দুই বছরে শিক্ষার্থীদের কিছুটা গ্যাপ তো হয়েছেই। অনেকে হয়তো আসলে ততটা গুরুত্ব দেয় নাই। যে কারণে এখন তাদের উপরে কিছুটা চাপ পড়ছে পড়াশোনার। কিন্তু তাও আমরা তাদের যতটুকু সম্ভব কম প্রেশার দিয়ে ভালো ফলাফল বের করা যায় সেটার চেষ্টা করি।’
এ সমস্যা সমাধানের জন্য আসলে বাচ্চাদের সঙ্গে অভিভাবকদের সান্নিধ্যটা বেশি বাড়াতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ফরহাদ মনজুর সারাবাংলাকে বলেন, ‘শিশু-কিশোরদের মানসিক সমস্যা সমাধানে মূল ভূমিকা রাখতে পারে সাইকোলজিস্ট বা সাইকিয়াট্রিকরা। স্কুল বেইজড তারা কাউন্সেলিং করতে পারে। কিন্তু আলাদা আলাদা ভাবে চেষ্টা করে খুব একটা বেশি ভালো ফল আসার সম্ভাবনা দেখি না। দেখা গেলো আমি আমার বাচ্চাকে কাউন্সেলিং করলাম। কিন্তু সে যখন আবার স্কুলে যাবে তখন সঙ্গীদের সঙ্গে মিশে আবার পুরনো অবস্থায় ফিরে যাবে। এজন্যেই স্কুলে যদি পরিকল্পনা নিয়ে কাউন্সেলিং করা যায় সেটাতে ভালো ফলাফল পাওয়া যেতে পারে।’
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সিফাত বলেন, ‘শিশু-কিশোরদের যে মানসিক অস্থিরতা বা অসুস্থতা তা কিন্তু সরাসরি করোনার প্রভাব না। বরং বলা যেতে পারে করোনার কারণে হওয়া ভার্চুয়াল স্কুলিংয়ের প্রভাব। তখন ওদের স্কুলে বা কোচিংয়ে যেতে হতো না। কোনো ধরণের আউটডোর অ্যাক্টিভিটি বা খেলাধূলার সঙ্গেও যুক্ত ছিল না তারা। সারাদিন মোবাইলে বা কম্পিউটারে ক্লাস করতো। সেখান থেকে যদি তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হয় তবে শিক্ষক ও অভিভাবকদের বাস্তবতা বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, একটু সময় লাগলেও তাদের বোঝাতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘অনেক বাবা-মা অভিযোগ করে বলেন সন্তান খালি মোবাইল টিপে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য কিন্তু বাবা-মায়ের হাত থেকেও মোবাইলটা রাখতে হবে। বাবা-মার ক্ষেত্রেও কিন্তু দেখা যায় তাদের হাতে মোবাইল কিন্তু তারা বাচ্চাকে বলছে, তুমি মোবাইল রেখে পড়তে বসো। সেটা কিন্তু হবে না। কারণ বাচ্চারা কিন্তু বাবা-মাকে অবজার্ভ করে। এক্ষেত্রে বাবা-মাকে মোবাইলটা রাখতে হবে আগে। এর পরে বাচ্চা মোবাইল বা ডিভাইস রেখে সেই সময়ে বিকল্প কি করবে সেটা নিয়েও ভাবতে হবে। অর্থাৎ বাচ্চাকে আরেকটা সোর্স অফ এন্টারটেইনমেন্ট দিতে হবে। এই জায়গাতে শিক্ষক ও অভিভাবকদের বড় দায়িত্ব আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাচ্চাদের মজার কোনো কার্যক্রমে যুক্ত করা বা পরিবারের সঙ্গে পর্যাপ্ত সময় কাটানোর সুযোগ করে দেওয়াটা খুবই প্রয়োজন মোবাইল আসক্তি কাটানোর জন্য। ঘরে বসেই অনেক ধরণের ইনডোর গেইম খেলা যায়। এগুলো একটু ধীরে কাজ করলেও আস্তে আস্তে সন্তানের ডিভাইস আসক্তি কাটানো সম্ভব। আশা করছি আমরা সবাই মিলে যদি চেষ্টা করি এই সমস্যা সমাধান করতে পারবো।’
ডা. সিফাত বলেন, ‘ভার্চুয়াল জগতে কিছু অ্যাডিক্টিভ ইন্টারনেট গেইম আছে যেগুলো বাচ্চারা খেলে থাকে। একবার সেগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা অনেক কষ্টের বিষয়। বাচ্চাকে মারধর করে, দরজা আটকে রেখে বা মোবাইল দূরে সরিয়ে এটা সমাধান করা যাবে না। এতে বরং উলটো ক্ষতি হতে পারে। এতা সমাধানের জন্য বাচ্চার সঙ্গে বসতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে ভার্চুয়াল জগতের ক্ষতিকর দিকগুলো। তাকে একটা নির্দিষ্ট গন্ডিতে এনে বোঝাতে হবে যে ইন্টারনেট ব্যবহার বা মোবাইলে গেইমস খেলা যাই করুক না কেনো তা শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হবে। শুধুমাত্র সেই টাইমটাতেই তাকে ডিভাইস দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সারাদিন যখন তখন তাকে সেটা দেওয়া যাবে না।’
ডা. সিফাত বলেন, ‘স্কুলে ক্লাস চলাকালীন সময়ে বাচ্চারা যেনো মোবাইল ব্যবহার করতে না পারে সেটা খেয়াল রাখা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ঝুঁকি বেড়ে যায় অনেক। উঠতি বয়সের কিশোর-কিশোরীদের মাঝে আরেকটা প্রবণতা দেখা যায় রাত জেগে গেইমস খেলা। সকালে দিকে ঘুমাতে যায় তারা ও দুপুরের দিকে উঠে স্কুল, কোচিং সবই মিস করে।’
তিনি বলেন, ‘অভিভাবকদের অবশ্যই সন্তানদের সঙ্গে পর্যাপ্ত সময় কাটানো প্রয়োজন। তাদের মোবাইলে কত টাকা দেওয়া হবে বা কত এমবি তারা ব্যবহার করতে হবে এ বিষয়েও কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। বাসার ওয়াইফাইয়ের পাসওয়ার্ড সন্তানদের কাছে একবারে দিয়ে রাখাটা ঠিক না। এক্ষেত্রে দেখা যায় বাবা-মায়ের চাইতে কারিগরি বুদ্ধিতে সন্তানরা অনেক বেশি জানে। সেক্ষেত্রে আসলে তাদের কঠোরভাবে না বুঝিয়ে ধীরে ধীরে প্রয়োজন হলে একটু সময় বেশি নিয়ে হলেও কনফিডেন্সে আনতে হবে।’
সারাবাংলা/এসবি/এমও