‘শিক্ষার্থীদের ভালো পরিবেশ দিতে পারি না’
১ জুলাই ২০২২ ০৯:৩১
‘শিক্ষার্থীদের ভালো পরিবেশ দিতে পারি না। এটি আমাদের সীমাবদ্ধতা। ঘুমানোর জন্য একজন শিক্ষার্থীকে ভালো একটি বেড দিতে পারলে, মিনিমাম ক্যালরির খাবারের ব্যবস্থা করতে পারলে দেখতে পেতেন এরা কীভাবে ভূমিকা রাখে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ঘাটতিগুলো প্রকট।’
আজ ১ জুলাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। শতবর্ষ পেরোনো দেশের মহীরূহ এই বিদ্যাপীঠের বর্তমান বেহাল দশা নিয়ে সমালোচনার শেষ নেই। মৌলিক গবেষণায় ঘাটতি, আন্তর্জাতিক র্যাংকিংগুলোতে স্থান না পাওয়া— এসব সব ঘাটতি তো রয়েছেই। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে এমন প্রশ্নও— বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে একটি প্রতিষ্ঠানের যেসব সুযোগ-সুবিধা শিক্ষার্থীদের দেওয়া প্রয়োজন, সেখানেই রয়েছে বড় ধরনের ঘাটতি।
দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রাক্কালে এমন বিভিন্ন ধরনের ঘাটতির কথাগুলোই স্বীকার করে নিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। সারাবাংলার সঙ্গে আলাপকালে তিনিই বললেন প্রতিবেদনের শুরুতেই উল্লেখ করা কথাগুলো।
বৃহস্পতিবার (৩০ জুন) দুপুরে নিজ কার্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার গুণগত মানসহ সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কিছু সীমাবদ্ধতার কথা অকপট স্বীকার করে নেন অধ্যাপক আখতারুজ্জামান। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘একজন শিক্ষার্থীকে উপযুক্ত আবাসন সুবিধা দেওয়া গেলে তার জীবন পরিবর্তন হয়ে যেত। গবেষণা ও উদ্ভাবনে আমরা পিছিয়ে রয়েছি। আরও অনেক সীমাবদ্ধতা আছে।’
তবে এসব সীমাবদ্ধতা দূর করার জন্যই ‘মাস্টারপ্ল্যান’ প্রণয়ন করা হয়েছে বলে জানালেন ঢাবি উপাচর্য। বললেন, ‘মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন হলে তখন সেগুলো মিট করা (সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করা) সহজ হবে।’
১৯২১ সালের এই দিনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। সেই থেকে এই দিনটিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। এবারের এই ১০২তম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উপলক্ষে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে— ‘গবেষণা ও উদ্ভাবন: ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সহযোগিতা’।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান বলেন, এর (প্রতিপাদ্য) মানে আমরা গুরুত্বারোপ করব গবেষণা ও উদ্ভাবন ক্ষেত্রে। এই দু’টো বিষয় এখন আমাদের গুরুত্বারোপের ক্ষেত্র। ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে আমাদের সংযুক্ততার মধ্য দিয়ে ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা কাজ করবে। তারা চাহিদা দেবে, বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করবে। এটাই জাতীয় উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। উন্নত বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ কাজ করে থাকে। আমরা সেদিকে ধাবিত হব।
উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেক পিছিয়ে— বিভিন্ন সূচকেই উঠে আসা এমন তথ্যও অকপটে স্বীকার করে নেন উপাচার্য। বলেন, ‘আমি উন্নত বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছি। দেখেছি, তাদের তুলনায় আমাদের শিক্ষার্থীরা জীবনমানে অনেক পিছিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এই সুযোগ-সুবিধাগুলো দিতে না পারলে পরবর্তী সময়ে (একজন শিক্ষার্থীকে) ঠিকঠাক প্রস্ফূটিত করা যায় না।’
এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও উদ্ভাবনের সঙ্গে মানুষকে, বিশেষত শিল্প খাতের শীর্ষ নেতৃত্বকে পরিচিত করিয়ে দিতে আগামী ২২ ও ২৩ অক্টোবর গবেষণা মেলার আয়োজন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, ‘অক্টোবরের ১ তারিখে এটা করার পরিকল্পনা ছিল। আমাদের প্রস্তুতিতে কিছু ঘাটতি ছিল বলে সময় কিছুটা পেছানো হয়েছে। সেখানে আমাদের মৌলিক কাজ, গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা, উদ্ভাবন ও ফলাফল তুলে ধরা হবে। ইন্ডাস্ট্রি-একাডিমেয়া সহযোগিতার সংস্কৃতির অভাব আমাদের দেশে আছে। সে উদ্দেশ্যেই আমরা এবার গবেষণা মেলা আয়োজন করছি। বিশ্ববিদ্যালয় কী কী করে, গবেষণালব্ধ কী কী অর্জন আছে— এগুলোর সঙ্গে মানুষকে পরিচয় করানো এই মেলার উদ্দেশ্য। বিশেষ করে ইন্ডাস্ট্রির লোকজনদের পরিচয় করানো এর উদ্দেশ্য, যেন তারা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলতে পারে যে নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে বা ক্ষেত্রে আমাদের জন্য অধ্যয়ন/গবেষণা করে দেন।’
ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সহযোগিতার প্রসঙ্গে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির উদাহরণ তুলে ধরেন ঢাবি উপাচার্য। বলেন, ‘মনে করুন, কোভিড। কোনো প্রতিষ্ঠানের তো বলা উচিত যে কোভিডের অর্থনৈতিক প্রভাব কিংবা শিক্ষার্থীদের মানসিকতার ওপর প্রভাব কেমন বা লার্নিং প্রসেসের ওপর কোভিডের প্রভাব কী— এ বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা বা অধ্যয়ন করে দিন। গবেষণায় এই বিষয়গুলো উঠে এলে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব। কিন্তু আমাদের দেশে এই সংস্কৃতির অভাব রয়েছে।’
ভ্যাকসিনের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার ভ্যাকসিনের বিষয়টি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। অক্সফোর্ডের মাইক্রোবায়োলজিস্ট, বায়োকেমিস্টদের বলা হলো যে তোমরা ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করো। তারা সেটা করলো। নামও আসলো যৌথভাবে। ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়ার যুথবদ্ধতার কিন্তু এটি একটি ফসল।’
তবে অধ্যাপক আখতারুজ্জামান মনে করেন, অনেক সীমাবদ্ধতার সত্ত্বেও ঢাবি শিক্ষার্থীদের মাঝে ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ করছেন তিনি। এ কারণে তিনি আশাবাদীও।
উপাচার্য বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে উন্নয়ন কিন্তু ঘটেছে। আমি খুব আনন্দের সঙ্গে বিষয়টি লক্ষ করি। অনেক অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পারফরম্যান্স দেখে বুঝি, তাদের আচরণবিধি, কোড অব কন্ডাক্ট-জ্ঞান প্রভৃতি বিষয় রিফাইন্ড টেস্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য আমি আশাবাদী। মানুষ অনেক হতাশার কথা বলে। আমি এসব হতাশার কথা বলি না, শুনি না। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে। এখন শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা পেছানো চায় না, ছুটি চায় না, লাইব্রেরি খোলা রাখতে চায়। এগুলো ইতিবাচকতার নির্দেশক।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক মান উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার কথাও জানাচ্ছেন উপাচার্য। অন্তত ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে ট্রাস্ট ফান্ড স্কলারশিপের আওতায় আনা, খণ্ডকালীন কাজের সুযোগ দেওয়ার মতো বিষয়গুলোও রয়েছে এসব উদ্যোগের মধ্যে।
ড. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘একটি কাজের উদ্যোগ নিচ্ছি আমি— পার্ট-টাইম জব অর্থাৎ কিছু কর্মঘণ্টা কাজ করার সুযোগ শিক্ষার্থীদের করে দেওয়া। এর মধ্য দিয়ে কামাই (উপার্জন) করাটাই মূল উদ্দেশ্য নয়। শিক্ষার্থীরা কাজের মধ্যে থাকল, শিখল। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমি এমন দেখেছি। এ ব্যাপারে আমি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনকে বলেছি, ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে বলেছি।’
ট্রাস্ট ফান্ড প্রসঙ্গে অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, ‘এছাড়া অনেকগুলো ট্রাস্ট ফান্ড করেছি আমরা। আমাদের টার্গেট হলো— ট্রাস্ট ফান্ডগুলোর অধীনে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী যেন অন্তত একটি স্কলারশিপ সুবিধা ভোগ করতে পারে।’
এসব উদ্যোগের সম্মিলিত ফলাফল কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে জানিয়ে অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, ‘এভাবে সবগুলো উদ্যোগ সম্মিলিতভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। মাল্টিসেক্টরাল ইন্টারভেনশন প্রয়োজন। একটি উদ্যোগেই সবকিছু হবে না। আমরা বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছি। তাৎক্ষণিকভাবে এগুলোর ফলাফল পাওয়া যাবে না। অন্তত পাঁচ বছর সময় লাগবে। আমাদের মাস্টারপ্ল্যানটি বাস্তবায়ন হয়ে গেলে এর বিশাল একটা প্রভাব পড়বে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের কর্মসূচি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আজ শুক্রবার (১ জুলাই) সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মাঠে বিভিন্ন কর্মসূচি ও গবেষণা-প্রকাশনা মেলার উদ্বোধন হবে। ১ থেকে ৩ জুলাই অনুষ্ঠেয় তিন দিনব্যাপী এ মেলায় অনুষদগুলোর জন্য ১০টি এবং ইনস্টিটিউটগুলোর জন্য একটি প্যাভিলিয়ন থাকবে। মেলায় গবেষণা প্রকাশনা সংক্রান্ত পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন ও স্লাইডলাইন ইভেন্ট থাকবে।
এদিকে, সকাল সাড়ে ১১টায় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে গবেষণা ও উদ্ভাবন ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সহযোগিতা শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অনুষদ, বিভাগ, ইনস্টিটিউট ও হল দিনব্যাপী নিজ নিজ কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি উদযাপন করবে।
সারাবাংলা/আরআইআর/টিআর
অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস ঢাবি ঢাবি উপাচার্য