বৈমানিকের ভুলে আকাশতরী’র ইঞ্জিন নষ্ট, গুরুপাপে লঘুদণ্ড দিয়ে মাফ
২ জুলাই ২০২২ ১৪:৩৩
ঢাকা: ফ্লাইট চলাকালে ওভার পাওয়ার ব্যবহারের কারণে বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিমান আকাশতরী’র দুটি ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বিধি অনুযায়ী তাদের চাকরি চলে যাওয়ার কথা থাকলেও তারা বিমানে বহাল তবিয়তে আছেন।
বিমানের ইঞ্জিন নষ্ট হওয়ায় গচ্চা গেছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। এ ঘটনায় বাংলাদেশ বিমানের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বৈমানিকদের গাফিলতি ও প্রশিক্ষণ দুর্বলতার কথা উঠে আসে। এতকিছুর পরও ওই বিমানের ক্যাপ্টেন রুবাইয়েত এবং ফাস্ট অফিসার হিসেবে রাফিউর জামানকে কশন নোটিশ ছাড়া আর কোনো শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি।
সারাবাংলার অনুসন্ধানে জানা যায়-গত ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়ার পথে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ড্যাস-৮ কিউ ৪০০ উড়োজাহাজ ‘আকাশতরী’র বিজি-৬০১ ফ্লাইটের ইঞ্জিনে ওভার পাওয়ার ব্যবহার করেন বৈমানিক। বিমানটিতে ক্যাপ্টেন হিসেবে ছিলেন রুবাইয়েত এবং ফাস্ট অফিসার হিসেবে ছিলেন রাফি। ওভার পাওয়ার ব্যবহার করায় আকাশতরী’র দুটি ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সাধারণত এয়ারক্রাফটের সামনে যদি হঠাৎ কোনো পাহাড় চোখে পড়ে, তখন পাইলট দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফ্লাইটটি উপরে তোলার জন্য এই ওভার পাওয়ার ব্যবহার করেন। কিংবা আকাশে একটি ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেলে অন্য ইঞ্জিনের সক্ষমতা বাড়াতেও বৈমানিক ওভার পাওয়ার ব্যবহার করতে পারেন।
বিমানের প্রকৌশল ও ফ্লাইট অপারেশন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মাত্র ১৩ সেকেন্ডের অবহেলায় ‘আকাশতরী’র বিজি-৬০১ ফ্লাইটের দুটি ইঞ্জিনের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্টস জ্বলে যায়।
বিমান কর্মকর্তারা বলছেন, উড়োজাহাজটি আকাশে ওঠার পর পাইলট কোনো কারণ ছাড়া পাওয়ার লিভারটিতে ১০০ ভাগের বেশি ইমারজেন্সি পাওয়ার (ওয়াল টু ওয়াল) ব্যবহার করেন। পরবর্তী সময়ে তড়িঘড়ি করে পাওয়ার লিভারটি আবার শতভাগের জায়গায় ডিটেন্টে নিয়ে এলেও দেখা গেছে ১৩ সেকেন্ড ব্যবহৃত হয়েছে।
গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ বিমানের বহরে যুক্ত হয় ড্যাস-৮ কিউ ৪০০ মডেলের এ উড়োজাহাজটি। কানাডার ডি হ্যাভিলেন্ড অ্যারোস্পেস থেকে এটি বাংলাদেশে আসে। কানাডা ও বাংলাদেশ সরকারের জি টু জি চুক্তিতে উড়োজাহাজটি ক্রয় করা হয়। বিমানটির দাম ছিল ২৫ মিলিয়ন ডলার।
৭৪ আসনবিশিষ্ট উড়োজাহাজটির নাম ‘আকাশতরী’ রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সারাবাংলার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে— বিমানের দুটি ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বৈমানিকরা বিমানের মেইনটেন্স লগ বুকে তা উল্লেখ না করে তথ্য গোপন করেন। ফলে ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তথ্যটি তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। এরপরও ওই বিমান দিয়ে আটটি ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়েছে। এতে ঝুঁকির মুখে ফেলা হয় প্রায় ৫ শতাধিক যাত্রীর জীবন। এমনকি বৈমানিকরা এই তথ্য গোপন করলেও বিমানের প্রকৌশল বিভাগ থেকে কোনো ধরনের তদারকি করা হয়নি।
ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি ১ ফেব্রুয়ারি রাতেই বিমানের প্রকৌশল বিভাগকে ই-মেইল করে অবগত করে বিমান ইঞ্জিন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট হুইটনি। সেই মেইলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি বিমানটিকে জরুরি ভিত্তিতে গ্রাউন্ডেড করতে নিদের্শ দেয়। কিন্তু বিমানের বৈমানিকরা লগ বুকে কোনো এন্ট্রি (ইঞ্জিনের বেশি পাওয়ার ব্যবহারের তথ্য) না করায় বিমানের প্রকৌশল বিভাগ বিষয়টিকে কোনো গুরুত্বই দেয়নি। ফলে বিমানের প্রকৌশল বিভাগ তখন এই বিষয়টি বিমানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও অবহিত করেনি। পরবর্তীতে ২ দিন পর বোম্বাডিয়া (বিমান নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান) থেকে দ্রুতই বিমানটিকে গ্রাউন্ডেড করতে বলা হলে তখনই বিমানের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের টনক নড়ে এবং বিষয়টি জানতে পারে। পরে বিমানের সেফটি বিভাগ ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার ডিকোর্ট (বিশ্লেষণ) করে বৈমানিক বিমানটিতে অধিক পাওয়ার ব্যবহার করেছেন বলে নিশ্চিত হয়। এরপর বিষয়টি বিমানের ফ্লাইট অপারেশন পরিচালক ক্যাপ্টেন ইসমাইলকে অবহিত করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে— বিমানের সেফটি বিভাগ একটি দুর্নীতির আতুড় ঘর। কারণ বৈমানিকদের সবকিছু দেখভাল করার কথা এই বিভাগের। কিন্তু সেটি বরাবরই উপেক্ষিত থাকে। অন্যদিকে বিমানের চিফ অব সেফটি একটি অত্যাবশীয় পদ। সেখানে এই পদে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত অজানা কারণে পদটি শূন্য ছিল। যে কারণে এই সময়ে বিমানের নানা অঘটন ঘটলেও তদন্ত না হওয়ায় সংশ্লিষ্টরা বেঁচে গিয়েছেন। অন্যদিকে সিভিল এভিয়েশনও বিষয়টি জানতেন না বিমানের চিফ অব সেফটি পদটি শূন্য রয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বেবিচক চিফ অব সেফটি নিয়ে বার্ষিক অডিট করলেও এই পদটি সম্পর্কে সিভিল এভিয়েশনকে ভুল তথ্য দেয় বিমান। আবার এ ভুল তথ্যটি ধরতেও ব্যর্থ হয়েছে বেবিচক।
এদিকে ড্যাস ৮ কিউ ৪০০ উড়োজাহাজে ওভার পাওয়ার ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিমান। যেখানে বলা হয়েছে, এই ঘটনাটির পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে বৈমানিকদের ফ্লাইট পরিচালনায় অপারেশন সাইটে গাফিলতি, এসওপি সঠিকভাবে না মানা, প্রশিক্ষণের দুর্বলতা এবং ক্যাপ্টেন হিসেবে ফ্লাইট পরিচালনার দুর্বলতা।
এ ধরনের ঘটনা সিভিল এভিয়েশন ২০১৭ আইন অনুযায়ী বড় ধরনের অপরাধ হিসেবেও বিবেচিত। তবে এই বৈমানিকদের বিমান থেকে নামে মাত্র একটি কশন লেটার (সাবধানতা) দিয়ে মাপ করে দেওয়া হয়েছে।
সারাবাংলার অনুসন্ধানে জানা গেছে— এতকিছুর পরও এখনও এই বৈমানিকদের চাকরি বহাল রয়েছে বিমানে। ক্যাপ্টেন রুবাইয়েত বিমানের ডেপুটি চিফ অব ট্রেনিং হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
এদিকে ড্যাস ৮ কিউ ৪০০ উড়োজাহাজের দুটি ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বিমানটি ৩ সপ্তাহের মতো বসে ছিল। ওই তিন সপ্তাহে অন্তত ১২৬টি ফ্লাইট পরিচালনা করা যেত। এ ছাড়া ইঞ্জিন সার্ভিসিং খরচ মিলে গচ্চা গেছে প্রায় ৫০ কোটি টাকার মতো। আগে থেকেই বিমান অতিরিক্ত দুটি স্পেয়ার ইঞ্জিন কিনে রেখেছিল অন্য বিমানের জন্য। কিনে রাখা সেই ইঞ্জিনগুলো আকাশতরী’তে লাগিয়ে নতুন করে ফ্লাইট পরিচালনা করা হচ্ছে। অপরদিকে ক্ষতিগ্রস্ত ইঞ্জিন দুটি মেরামতের জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে ক্যাপ্টেন রুবাইয়েতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমি তখন প্রতিকূল অবস্থায় ছিলাম। আমার কাছে যেটি সঠিক মনে হয়েছে আমি সেটি করেছি।’
আপনার কাছে বিষয়টি অপরাধ কিনা বা আপনি যা করেছেন সেটি সঠিক ছিল কিনা— জানতে চাইলে বলেন, ‘এ বিষয়ে কিছুই বলব না। বিমানের তদন্ত হয়েছে। বিমানের কাছে জানতে চাইলে অবশ্যই ভালো উত্তর পাবেন।’
এই বিষয়ে জানতে বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার বিমানের সিইও এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামাল ও বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) তাহেরা খন্দকারের ফোনে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও ফোনটি রিসিভ করেননি। ফলে তাদের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঘটনাটি নিয়ে আমাদের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত চলমান রয়েছে। তবে তদন্ত রিপোর্টে কি রয়েছে সেটি আমার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। আমি অফিসে গিয়ে খোঁজ নেব।’
বৈমানিকদের ভুল পাওয়া গেলে কি শাস্তি হবে পারে জানতে চাইলে বলেন, ‘যদি ভুলে করা হয় তাহলে এটি বড় অপরাধ। এই অপরাধে বৈমানিকের চাকরিও চলে যেতে পারে।’
সারাবাংলা/এসজে/একে