স্তন ক্যান্সার: ‘সচেতনতার অভাবে শেষ সময়ে চিকিৎসা নেন আক্রান্তরা’
২ জুলাই ২০২২ ২২:০৬
ঢাকা: দেশে প্রতিবছর ১৫ হাজারের বেশি নারী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন, যাদের বড় একটি অংশ কম বয়সী। স্তন ক্যান্সার রোধে স্ক্রিনিং সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি চিকিৎসা সেবার আওতা বেড়েছে। তবে অনেকেই সচেতনতার অভাবে শেষ সময়ে গিয়ে চিকিৎসা নেন। স্তন ক্যান্সার বিষয়ে শুরুতেই সচেতন হলে প্রতিরোধ করা সম্ভব। এছাড়াও সকল স্তরে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রটেকটিভ হেলথের ব্যাপারেও জোর দেওয়া প্রয়োজন। এ জন্য প্রান্তিক পর্যায়ে সচেতন করা প্রয়োজন বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ স্তন ক্যানসার সচেতনতা ফোরাম আয়োজিত ‘স্তন ক্যানসার সচেতনতায় চাই সামাজিক আন্দোলন’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন বিশেষজ্ঞরা। শনিবার (২ জুলাই) রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মিলনায়তনে এ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচক হিসেবে বক্তব্য দেন সোসাইটি ফর হেলথ প্রমোশন লিংকসের সভাপতি ডা. হালিদা হানুম আক্তার। তিনি বলেন, নারীর কোনো একটি অঙ্গ তার মৃত্যুর কারণ হতে পারে। স্তন ক্যানসার এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা। তাই এটি নিয়ে সচেতন ও প্রতিরোধ পরিবার থেকে শুরু করতে হবে। বিশেষ করে নারীকেই সচেতন হতে হবে। মা জানলে মেয়ে সুস্থ থাকবে।
তিনি আরও বলেন, শুধু নারী নয়, পুরুষদেরও এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে যে, এই রোগ শুধু নারীর না, ওই পরিবারের জন্য বড় বোঝা এবং ভোগান্তি। প্রটেকটিভ হেলথের ব্যাপারে আমাদের জোর দিতে হবে। এ জন্য প্রান্তিক পর্যায়ে সচেতন করতে হবে। গণমাধ্যম এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন স্তন ক্যানসার সচেতনতা ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সমন্বয়কারী জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন।
বিগত সময়ে নেওয়া নানা উদ্যোগের কথা তুলে ধরে অধ্যাপক ডা. রাসকিন বলেন, গত বছর ঢাকায় সাড়ে ৫০০ নারীর স্ক্রিনিং হয়েছে। ঢাকার বাইরে অন্তত ৩০টি জেলায় সচেতনতা কার্যক্রম চালানো হয়েছে। এবার ৬৪টি জেলায় করার ইচ্ছা আছে।
তিনি বলেন, সরকারি হিসেবে স্তন ক্যানসার সচেতনতা দিবস ঘোষণা করতে হবে। সবার সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনে জাতীয় কমিটি গঠন করা হবে। ক্যানসার চিকিৎসায় সারাদেশের আরও ৮টি মেডিকেল কলেজে ব্যবস্থা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ চলছে। এই রোগের বেশির ভাগ রোগীই প্রান্তিকের। সচেতনতার অভাবে শেষ সময়ে গিয়ে চিকিৎসা নেন। একইসঙ্গে পাঠ্যক্রমে এটির সচেতনতায় যুক্ত করতে হবে। তাহলে শুরুতেই সচেতন হলে স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে পারবে।
আলোচনা সভায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম হাসিব বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সচেতনতা চললেও এটি কতটা সম্ভব হয়েছে, সেই গবেষণা নেই। দেশে বর্তমানে ধারণার ওপর নির্ভর করে রোগীর সংখ্যা বলা হচ্ছে। অনেক বছর ধরে কোনো পরিসংখ্যান নেই। বর্তমানে একটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও ডায়াগনস্টিকের ব্যবস্থা নেই। বিকেন্দ্রীকরণ না থাকায় কোনোটাই ঠিকমতো হচ্ছে না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. ছয়েফ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশে স্তন ক্যানসারে এক সময়ে ২২ হাজার নারী আক্রান্ত হত, বিনা চিকিৎসায় মারা যেত ৭০ ভাগ। সচেতনতা বাড়াতে বর্তমানে সেটি কমেছে। শুরু থেকে আমরা সব ধরনের রোগেরই চিকিৎসা দিতে চেয়েছি।
তিনি বলেন, ক্যানসার বিশেষ করে স্তন ক্যানসারের রোগী গ্রামে-গঞ্জে খুঁজে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। বিদেশের থেকে আমাদের দেশীয় চিকিৎসা অনেকটা ভালো।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, সারাদেশে যদি একটি প্রাণঘাতী রোগ থাকে তার প্রধান পুরুষদের ফুসফুস ক্যানসার, নারীদের স্তন ক্যানসার। দেশের সব জেলা সদর হাসপাতালে স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা আছে। তবে ছোট বেলা থেকেই যদি ছেলে-মেয়েদের সচেতন করা যায়, তাহলে অনেক বেশি কাজে দেবে।
তিনি বলেন, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সচেতনতায় কাজ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কর্মীরা যদি বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নেয়, তাহলে অনেকটা এগোবে। তাহলে ডাটাটা তুলে আনা সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, নারীদের স্তন, ওরাল ও সার্ভাইক্যালের ক্যানসার হয়ে থাকে। এগুলো নিয়ে বিশেষ করে স্তন ক্যানসার নিয়ে সচেতনতামূলক নাটক তৈরির কাজ চলছে, যাতে দ্রুত সচেতন ও শনাক্ত করা যায়।
ডা. স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, স্তন ক্যান্সারে আক্রান্তরা আগে সচেতন না হওয়ায় শেষ পর্যায়ে এসে চিকিৎসা নিতে আসত। তখন ব্যয় বেড়ে যায়। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ সেটাতে ব্যয় হয়। তবে ১০ অক্টোবরকে দিবস ঘোষণা হোক বা না হোক, বছরের পুরো সময় এটি নিয়ে কাজ করতে হবে।
এদিন আলোচনা সভায় জানানো হয়, দেশে প্রতিবছর ১৫ হাজারের বেশি নারী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন, যাদের বড় একটি অংশ কম বয়সী। এজন্য এটি রোধে পরিবার থেকে সচেতনতার কার্যক্রম চালাতে হবে। একইসঙ্গে স্কুল-কলেজ পর্যায় থেকে শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
আলোচনা সভায় ফোরামের পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়, ২০১৩ সালে স্তন ক্যানসার সচেতনতা ফোরাম গঠন ও এর উদ্যোগে প্রতিবছর ১০ অক্টোবর বাংলাদেশে স্তন ক্যানসার সচেতনতা দিবস পালিত হয়ে আসছে। গোলাপি সড়ক শোভাযাত্রা, সচেতনতা ও ফ্রি স্ক্রিনিংসহ নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই দিবস পালন করা হয়। এ বছর এই দিবস উদ্যাপিত হবে দশমবারের মতো। একযোগে ৬৪ জেলায় ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষদের সম্পৃক্ত করে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে বলেও ফোরামের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচক হিসেবে বক্তব্য দেন সোসাইটি ফর হেলথ প্রমোশন লিংকসের সভাপতি ডা. হালিদা হানুম আক্তার। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম হাসিবসহ অন্যান্যরা।
সারাবাংলা/এসবি/এনএস
