ঢাকা: ইদুল আজহা সামনে রেখে শুরু হয়েছে ইদযাত্রা। ইদের আগে শেষ কর্মদিবসে রাজধানীর ভেতরেই বিভিন্ন স্থানে দুপুর থেকেই রাস্তায় বাড়তে থাকে বাড়ির পথে ফেরার অপেক্ষায় থাকা মানুষের ভিড়। স্বজনদের সঙ্গে ইদ আনন্দে সামিল হওয়ার জন্য বাড়ি যাবেন সবাই। কিন্তু বাড়ি যাওয়ার গাড়ি যেখান থেকে ছাড়বে সেই সায়েদাবাদ, গাবতলী, আবদুল্লাহপুর, কমলাপুর কিংবা সদরঘাটের দিকে যাওয়ার জন্যেই মিলছে না কোনো পরিবহন। নানাভাবে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছানোর পর দেখতে পাচ্ছেন, চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা আগের সময়ের গাড়ির যাত্রীরাই কাউন্টারে বসে প্রহর গুনছেন গাড়ির।
মহাসড়কে যানজটের কারণে গাড়ি ফিরতে না পারায় আগে টিকিট কেটে নির্ধারিত সময়ে কাউন্টারে পৌঁছেও তাদের এই দীর্ঘ প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে হচ্ছে। নতুন করে যারা বাস টার্মিনালে যাচ্ছেন, তারা সেই অপেক্ষমাণ যাত্রীর চাপ শুধু বাড়িয়েই দিচ্ছেন। প্রচণ্ড গরমের দিনটিতে পরিবার-পরিজন নিয়ে ভোগান্তির যেন শেষ নেই যাত্রীদের।
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন— বুধবার থেকে ঢাকায় ঢোকার পথেই যানজট বেড়ে গেছে। তাই সময় অনুযায়ী গাড়ি রাজধানীতে ঢুকতেই পারছে না। কিন্তু টার্মিনালে বাড়ি ফেরা মানুষের চাপ বাড়ছে ঠিকই। পশু পরিবহনের জন্য ট্রাক যেগুলো শহরে আসছে বা বের হচ্ছে, সেগুলোর কারণেও বাড়ছে যানজট। তাই রাজধানীতে প্রবেশের আগেই এবার যানজটের কারণে যাত্রীদের সঠিক সময়ে গাড়িতে ওঠানো সম্ভব হচ্ছে না।
যাত্রীরা অভিযোগ করে বলছেন, সময়মতো গাড়ি না এলেও কাউন্টারগুলো টিকিট বিক্রিতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। গাড়ি কম থাকার কারণে দেখিয়ে নেওয়া হচ্ছে বেশি ভাড়াও। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি বলেই অভিযোগ যাত্রীদের।
বৃহস্পতিবার (৭ জুলাই) সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ও বাস টার্মিনাল সরজমিনে ঘুরে এমন চিত্রেরই দেখা মিলল। সবখানেই বাড়িতে ফিরতে চাওয়া মানুষের ভিড়। কিন্তু পরিবহনের অভাবে সবাই অসহায় বোধ করছেন। ইদযাত্রা করতে যে আনন্দ নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন, সেই আনন্দ অনেকটাই মলিন হয়ে গেছে।
সকাল ১০টায় রাজধানীর উত্তরা-আবদুল্লাহপুর সড়কে বাড়তে থাকে বাড়িফেরা মানুষের ভিড়। এসব এলাকার বাস কাউন্টারগুলোতে দেখা যায় যাত্রীদের অপেক্ষা। অগ্রিম টিকিট কাটা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্ধারিত সময়ে যাত্রীরা গাড়ি পাচ্ছেন না। একাধিক বাস কাউন্টারে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, টাঙ্গাইলের দিকে তীব্র যানজটের কারণে গাড়ি সময়মতো ফিরছে না ঢাকায়। তাই নির্ধারিত সময়ে গাড়ি ছাড়তে পারছেন না।
রাজধানীর খিলক্ষেত বাস স্ট্যান্ড এলাকাতেও রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল অনেককে। কথা বলে জানা গেল, তাদের কেউ সায়েদাবাদ, কেউ গাবতলী যাওয়ার জন্য গণপরিবহনের অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু গাড়ির সংখ্যা খুবই কম। এজন্য যাত্রী ছাউনির সামনে অপেক্ষা বাড়ছে মানুষের।
রাইদা পরিবহনের চালক জসিম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, এবার অনেক গাড়ি রিজার্ভ ট্রিপে যাচ্ছে। পদ্মা সেতু হওয়ার কারণে দক্ষিণবঙ্গের অনেকেই নিজেরা বাস রিজার্ভ করে চলে যাচ্ছেন। আর তাই শহরে গাড়ি চলছে কম।
দুপুর ১২টার দিকে গাবতলী টার্মিনালে যাত্রীদের অপেক্ষার পাশাপাশি দেখা যায় ভিন্ন চিত্রও। এই টার্মিনালের বিভিন্ন পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শহরের ভেতরে চলা নগর পরিবহনের পাশাপাশি বিআরটিসির বাস রিজার্ভ করছেন। এরপর সেগুলোর টিকিট বিক্রি করছেন নিজেদের মতো করে।
বাড়ি ফেরার জন্য টার্মিনালে আসা রাহাত ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, আমার বাড়ি নওগাঁয়। সাধারণ সময়ে এই রুটে গাড়ি ভাড়া ৫৮০ টাকা। গত পরশু শ্যামলী বাস কাউন্টার এসেছিলাম। তারা জানায়, ৯ জুলাই পর্যন্ত কোনো টিকিটই নেই। এখন এসে দেখছি, সেই শ্যামলী কাউন্টার থেকেই ১১০০ টাকা করে টিকিট বিক্রি করছে। অর্থাৎ দ্বিগুণ টাকায় টিকিট বিক্রি করছে। কেউ কি নেই এগুলোর বিচার করার?
জানতে চাইলে শ্যামলীর কাউন্টার মাস্টার শওকত আলী সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের কোনো গাড়ির টিকিটই নেই। তবু আমরা যাত্রীদের সেবা দেওয়ার জন্য বিআরটিসি থেকে কিছু বাস রিজার্ভ নিয়েছি। রিজার্ভ নেওয়ার সময় বিআরটিসিই আমাদের কাছ থেকে বেশি টাকা নিয়েছে। সেই হিসাব করে আমাদেরও বাড়তি ভাড়া নিতে হচ্ছে। কাউকে তো জোর করে আমরা গাড়িতে উঠাচ্ছি না। তাই সমস্যা কী? আর কম ভাড়া নিয়ে কি আমরা লস দিয়ে গাড়ি চালাব?
এই টার্মিনালেই বিআরটিএ আদালত ৮-এর অভিযান পরিচালনা করছিলেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফখরুল ইসলাম। বাড়তি ভাড়া আদায় নিয়ে যাত্রীদের অভিযোগ প্রসঙ্গে দৃষি।ট আকর্ষণ করলে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘যারা এমনটা করছে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। দুপুর পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া আদায়ের দায়ে ১০টি বাসকে জরিমানা করা হয়েছে। ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে এখন পর্যন্ত। অন্যান্য এলাকাতেও এমন অভিযান চালানো হচ্ছে।’ পাশেই শ্যামলী কাউন্টারে এরকম বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ তিনি পাননি বলে জানান।
রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনাল, সায়েদাবাদ টার্মিনালেও প্রায় একই অবস্থা। তবে এখানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কোনো তৎপরতা নেই বলে জানাচ্ছেন যাত্রীরা। কমলাপুর থেকে কুমিল্লা ও নোয়াখালীগামী বাসের কাউন্টারগুলোর সামনেও যাত্রীদের লম্বা লাইনে অপেক্ষা করতে দেখা যায় বিকেলে। তবে এসময় কিছু কাউন্টারে দেখা যায়নি কোনো কর্মকর্তাকে।
এশিয়া এয়ারকন পরিবহনের এক কর্মকর্তা জানালেন, ভোর থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত প্রায় ৩০টি গাড়ি ছেড়ে গেছে। আরও ছয়টি গাড়ির টিকিট বিক্রি শেষ। কিন্তু গাড়ি নেই। এর মধ্যে আবার তিনটি গাড়ি গত দেড় ঘণ্টায় হানিফ ফ্লাইওভার থেকে টিটি পাড়া পর্যন্তই পৌঁছাতে পারেনি!
যাত্রীদের অভিযোগ, প্রায় সব গাড়িতেই বাড়ানো হয়েছে ভাড়া। মিয়ামি এয়ারকন নামে একটি পরিবহন কোম্পানি বাদে বাকি অন্য সবাই ঢাকা-কুমিল্লা রুটে ভাড়া বাড়িয়েছে ৫০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত। অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেছেন পরিবহন কোম্পানিগুলোর কর্মীরাও। তাদের দাবি, পরিবহনের শ্রমিকদের দুইটি ইদে কিছু ‘আবদার’ থাকে। সেই ‘আবদার’ মেটাতে ভাড়া বাড়ানো ছাড়া কিছু করার থাকে না তাদের।
মিয়ামি এয়ারকন কেন ভাড়া বাড়ায়নি? জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক (জিএম) দেলোয়ার সারাবাংলাকে বলেন, এটি আমাদের ব্যবসায়িক নীতি। আমরা যাত্রীদের সেবাটা দিতে চাই। আর তাই কখনোই আমরা ভাড়া বাড়াই না। তবে রাস্তায় যানজটের কারণে সঠিক সময়ে গাড়ি ছাড়তে না পারায় আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। তবু আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।
রাজধানীর টিটি পাড়ায় ঢাকা-ফেনী রুটে চলা স্টারলাইন, ড্রিমলাইন পরিবহনের কাউন্টারের সামনেও প্রায় একই দৃশ্য। আগেভাগে টিকিট কাটলেও যাত্রীরা কাউন্টারে এসে নির্ধারিত সময়ে পাচ্ছেন না গাড়ি। গোলাপবাগ, জনপথ, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী এলাকার চিত্রও ব্যতিক্রম কিছু নয়।
যাত্রাবাড়ীতে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন নাসির আহমেদ। সারাবাংলাকে বললেন, সীতাকুণ্ড যাবেন। কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে চলা কোনো গাড়ির টিকিট পাননি। আবার যারা টিকিট পেয়েছেন, তাদেরও কাউন্টারে বসেই অপেক্ষা করতে দেখছেন। তাদের গাড়ি আসতেই আরও ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করতে হবে। তাই কাউন্টার ছেড়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
নাসির বলেন, ভেঙে ভেঙেও যদি যেতে পারি, তবে আশা করছি অল্প সময়ে বাড়ি পৌঁছাতে পারব। আগের ইদে (ইদুল ফিতর) পথে কোনো দুর্ভোগ হয়নি। এবার তো ঢাকার মধ্যেই ভোগান্তি শেষ হচ্ছে না!
জানতে চাইলে কাঁচপুর হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নবীর হোসেন বলেন, যাত্রীর চাপ বেশি থাকায় যানজট তৈরি হয়েছে। যানজট নিরসনে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আশা করি খুব শিগগিরই যানজট নিরসন হয়ে যাবে।