‘ভোক্তা অধিকার-ম্যাজিস্ট্রেট নামে আছে, কাজে দেখি না’
১০ জুলাই ২০২২ ০০:০৬
ঢাকা: টিকাটুলি হানিফ ফ্লাইওভারের সামনে স্ত্রী এবং দুই বাচ্চাকে নিয়ে কুমিল্লায় যাওয়ার গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন ইদ্রিস আলী। ঘড়ির কাঁটার হিসেবে সময় তখন ৩ টা ৪২ মিনিট। সামনেই ছিল কুমিল্লাগামী এশিয়া ট্রান্সপোর্ট নামে একটি নন-এসি বাস। তবে তাতে উঠছিলেন না ইদ্রিস আলী।
কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি যাব মূলত মাধাইয়া। গার্মেন্টস ছুটি হয়েছে গতকাল আর তাই আজকে টঙ্গী থেকে সকালে রওয়ানা দিয়ে এখানে এসে পৌঁছাই। সাধারণত এশিয়া ট্রান্সপোর্টে দরদাম করে উঠলে তারা ১৫০ টাকা দিয়েও মাধাইয়া নিয়ে যেত আগে। কুমিল্লা পর্যন্ত এই গাড়ির ভাড়া ২২০ টাকা। কিন্তু আজকে ৫০০ টাকা চাইছে আবার বলছে। বলল এটিই নাকি গত দুইদিন থেকে ইদ উপলক্ষে নেওয়া টিকেটের ভাড়া। কিন্তু টিকেটে আবার লেখা ২২০ টাকা। এইটা তো ডাকাতি বলা যায়। এ জন্য অপেক্ষা করছি।’
অতিরিক্ত ভাড়ার বিষয়ে অভিযোগ দিতে চাইলেও কাউকে পাননি বলে জানান ইদ্রিস আলী।
তিনি বলেন, ‘শুনছি সরকারি নাকি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট বসাইছে বিভিন্ন জায়গায়। কিন্তু সেটি শোনা পর্যন্তই। আজকে কোথাও দেখলাম না। এমনকি টঙ্গী থেকে আজকে বলাকা পরিবহনে সায়েদাবাদ পর্যন্ত আসতেই দিতে হয়েছে জনপ্রতি ৩০০ টাকা। কোথাও কোনো মোবাইল কোর্টও দেখলাম না আবার সার্জেন্টের (ট্রাফিক কর্মকর্তা) কাছে অভিযোগ জানিয়েও লাভ হলো না।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের ফ্যাক্টরির ম্যানেজার স্যারকে ফোন দিয়ে জানানোর পরে তিনি বললেন ১৬১২১ নম্বরে অভিযোগ জানানোর জন্য। এইডা নাকি ভোক্তা অধিকার নিয়ে অভিযোগ জানানোর নম্বর। তাদের বিষয়ে আমিও শুনছি কারণ প্রতিবার রোজার ইদের (ইদুল ফিতর) আগে বাজারে তারা অভিযান চালায়। গত ইদে নাকি তারা বাস কোম্পানিগুলোকেও জরিমানা করছে। সবই আসলে শুনছি আর আপনাদের মিডিয়ার খবরে দেখছি। জিন্দেগিতে চোখে দেখিনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আজকে ওই নম্বরে ফোন দেওয়ার পরে আমারে ১ আর ২ টাইপ কিছু চাপতে বলছিল। কিন্তু মোবাইল তো কানে কথা বলার জন্য। হাতে চাপব কেমনে?’
কিছুটা আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘আসলে ভোক্তা অধিকার-ম্যাজিস্ট্রেট এইগুলো নামে আছে, কাজে দেখি না। আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে কথা বলছেন। কিন্তু এখানে কোনো ম্যাজিস্ট্রেট টিম দেখতে পাইছেন? অথচ সবাই কিন্তু জানে বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। সবার সামনেই নিচ্ছে। যদি এসব ভোক্তা অধিকার বা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট থাকতো তবে টঙ্গী থেকে কিছুই চোখে দেখলাম না কেন? থানায়ও তো বেশি ভাড়ার বিরুদ্ধে মামলা নেবে না। তাহলে আমরা যাব কোথায়? এই দেশে কি আমাদের কথা কাউকে জানাতে পারব না?’
ইদ্রিস আলীর সঙ্গে কথা বলার সময়ে আশেপাশে আরও কিছু যাত্রী চলে আসে।
তারাও প্রায় একই অভিযোগ জানিয়ে বলে, এশিয়া ট্রান্সপোর্ট, এশিয়া লাইন এগুলো তো তাও চেয়ারকোচ যারা ভাড়া বাড়াইছে কিন্তু শহরের যে গাড়িগুলো টাউন সার্ভিস হিসেবে চলে সেগুলাও জনপ্রতি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা করে কুমিল্লা যাচ্ছে। যার থেকে যেমনে পারছে তেমনে নিচ্ছে কিন্তু দেখার কেউ নেই। বাধ্য হয়েই তাই আমাদের চড়তে হয় এগুলোতে।
এশিয়া ট্রান্সপোর্ট নামের কুমিল্লাগামী বাসটির চালকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দেননি। গাড়ির সুপারভাইজারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি একজন ব্যক্তিকে দেখিয়ে দিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তবে সেই ব্যক্তিও কোনো কথা না বলে দ্রুত সরে যান।
শুধুমাত্র টিকাটুলী বা সায়েদাবাদেই না, রাজধানীর অন্যান্য বাস টার্মিনালেও দেখা যায় প্রায় একই চিত্র। যাত্রীদের অভিযোগ বেশি ভাড়া নেওয়ার কিন্তু তা অস্বীকার করছেন পরিবহন শ্রমিক ও কাউন্টারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
একদিকে অতিরিক্ত ভাড়া, তার ওপর পরিবহন সংকট—এমন পরিস্থিতিতেই ইদযাত্রায় অনেকেই তাই ট্রাক-পিকআপে চড়েই যাচ্ছেন গন্তব্যস্থলে।
সরেজমিনে পোস্তগোলা এলাকায় দেখা যায় ট্রাক ও পিকআপের কর্মচারীরা যাত্রীদের ডাকছে। কথা বলে জানা গেল— শরীয়তপুরের জাজিরা ও ফরিদপুরে ভাঙ্গা পর্যন্ত যাবে তারা। ভাড়া হিসেবে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত দাবি করছে তবে দূরত্ব অনুযায়ী সেটি ঠিক করা হয়।
আসাদুল ইসলাম নামে একজন যাত্রী বলেন, ‘সকাল থেকে গোপালগঞ্জ যাওয়ার কোনো বাসই পাইনি। আর তাই পিকআপে করে ৪৮০ টাকা ভাড়া দিয়ে যাচ্ছি। কারণ অপেক্ষা করে যদি বাস পেয়েও যাই সেখানেও বেশি ভাড়াই নেবে। যেটি আগে ১০০ টাকার ভাড়া সেটা এখন ৩০০ টাকা দিতে হবে বলে জানিয়েছে বাস কাউন্টারের লোকরা। ২০০ টাকার ভাড়া ৪০০ আর ৩০০ টাকারটা ৫০০ টাকা নিচ্ছে তারা।’
তিনি বলেন, ‘এই দামে টিকেট দিলেও গাড়ি কিন্তু ছাড়বে ঘণ্টাখানেক পরে। মানে গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকা এসে পৌঁছানোর পরে সেটি আবার ঘুরে যাবে। তাহলে আর অপেক্ষা করে লাভ কী?’
বাস টার্মিনাল, পোস্তগোলা এলাকাতেও কোনো ম্যাজিস্ট্রেট টিমের ভ্রাম্যমান আদালতের কার্যক্রম দেখতে পায়নি বলে জানান একাধিক যাত্রী।
৭ জুলাই থেকে ৯ জুলাই বিকেল পর্যন্ত রাজধানীর প্রায় সব বাস টার্মিনালেই যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ জানা গেছে।
মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে ময়মনসিংহগামী বাসের ভাড়া বছরের অন্যান্য সময় থাকে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। কিন্তু ইদকে সামনে রেখে এ ভাড়া এক হাজার টাকা নেওয়া হয় বলেও অভিযোগ যাত্রীদের। শুধুমাত্র ময়মনসিংহতেই নয়, শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ টাঙ্গাইলের দিকে যাওয়া বাসের ভাড়াও বাড়ানোর অভিযোগ যাত্রীদের।
এ সময় সৌখিন এক্সপ্রেস নামে একটি পরিবহনের হেল্পার আলতাব হোসেন যাত্রীদের ডাকছিলেন, জলদি গেলে টিকেট লন, এক দাম ১ হাজার। যেখানেই যান ভাড়া মাত্র ১ হাজার।
গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি জানান, সবাই তো ৭০০ থেকে ১ হাজার করে যাত্রীদের টিকেট দিচ্ছে। তাও তো গাড়ি নেই। পুরা টার্মিনাল দেখেন কোনো বাসই নাই আর যাত্রীরা রোদে কষ্ট করছে। এইজন্য আমরা তাদের কষ্ট কমাতে ১ হাজার টাকা দিয়ে টিকেট দিচ্ছি। কিছু কিছু লোকাল বাস নাকি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা দিয়েও যাত্রী উঠাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘কার কাছে গিয়ে বিচার দিবেন দেন গিয়ে। ঢাকার তুরাগ পরিবহনও তো ৮০০ করে ভাড়া নিচ্ছে।’
গাড়ির চালক রিয়াজুল বলেন, ‘আমরা ঢাকায় আসছি অনেকক্ষণ রাস্তায় জ্যামে বসে থেকে। এই কারণে চার-পাঁচ সিঙ্গেলের পরিবর্তে মাত্র ২-৩ সিঙ্গেল ট্রিপ মারতাছি। এই কারণে যাত্রী বাড়ছে কিন্তু গাড়ি কমছে। সবাই যেহেতু বাড়িতেই যাবে তাই ভাড়া বেশি দিলেও কেউ অভিযোগ করে না। আর বখশিস হিসেবেও তারা আমাদের বেশি ভাড়া দেয়।’
নাগরিকদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া নিলে যদি ভোক্তা অধিকারে বিচায় দেয় বা ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাছে অভিযোগ জানায় তবে জরিমানা করবে না? — এমন প্রশ্নের জবাবে রিয়াজ বলেন, ‘কেন জরিমানা করবে। দুইটা ইদে আমরা কি বখশিস পেতে পারি না? আর যারা জরিমানা করবে তাদের বাড়িতে যেতে হবে না? আর রাস্তায় আমাদের কেউ আটকাবে না এমন সিস্টেম করা আছে।’
পরিবার, স্বজনদের সঙ্গে ইদ আনন্দ কাটাতে বিভিন্ন টার্মিনালে অপেক্ষায় থাকা যাত্রীদের প্রায় সবার কাছ থেকেই প্রায় একই অভিযোগ পাওয়া যায়।
তবে এমন অভিযোগকে ভুল বলে দাবি করেন একাধিক ম্যাজিস্ট্রেট।
ঢাকা মেট্রোসার্কেল-২ এলাকার ১০ নং ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জুবের আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা রাস্তায় বিভিন্ন ভাবে আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে গেছি। গত দুইদিন ও আজকে একাধিক স্থানে আমরা অনেক গাড়ির কাছ থেকেই জরিমানা আদায় করেছি।’
তিনি বলেন, ‘ট্রাক-পিকআপ ভ্যানে করে যারা যাত্রীদের নিয়ে যাচ্ছেন তাদেরও আমরা জরিমানা করেছি। একাধিক স্থানে যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে বাস্তবতাও স্বীকার করতে হবে আমাদের। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় বাসে থাকা যাত্রীরাই অভিযোগ জানায় না। বেশি ভাড়া দিলেও তারা স্বীকার করে না। এমন অবস্থায় আসলে কিছু করারও থাকে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘যাত্রীরা আমাদের কাছে যখনই অভিযোগ জানিয়েছে তখনই আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। তবে এক্ষেত্রে আসলে আরেকটা বাস্তবতাও বোঝার চেষ্টা করতে হবে। ইদযাত্রায় যেখানে লাখে লাখে মানুষ বিভিন্ন জায়গা থেকে গাড়িতে উঠছেন তখন আমাদের জনবল কিন্তু সীমিত। আর তাই চাইলেও সব স্থানে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। কিন্তু কোথাও দেখা যায় নি ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম— এমন অভিযোগ সঠিক না।’
উল্লেখ্য, রাত পোহালেই ১০ জুলাই উদযাপিত হবে মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ইদুল আজহা। স্বজনদের সঙ্গে ইদের আনন্দ ভাগ করে নিতে ইতোমধ্যেই যানজটে হওয়া পথের কষ্ট, দুর্ভোগ মাড়িয়ে গ্রামে পৌঁছে গেছেন অনেকেই। চাঁনরাত বলে পরিচিত ইদের আগের রাতেও অনেকেই ইদযাত্রায় চেষ্টা করছেন বাড়ি ফিরে যেতে।
সারাবাংলা/এসবি/একে