ঢাকা: অনির্দিষ্টকালের অবরোধ ঘোষণা দিয়ে টানা ৯২ দিন গুলশানে নিজ কার্যালয়ে অবস্থানের পর ২০১৫ সালের ৪ এপ্রিল বাসায় ফিরে দল পুনর্গঠন এবং সংগঠন মজবুত করার কাজে হাত দেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এরপর সাত বছর পেরিয়ে গেলেও দল গোছানোর কাজ শেষ করতে পারেনি বিএনপি। এই মুহূর্তে বিএনপির ৮২টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে মাত্র ২৮টিতে রয়েছে পূর্ণাঙ্গ কমিটি। বাকি ৫৪টি সাংগঠনিক জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেনি দলটি।
বিএনপির কেন্দ্রীয় দফতরের দায়িত্বশীল এক নেতা এবং জেলা পর্যায়ের কয়েকজন সিনিয়র নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। ০১ জুলাই, ২০২২ পর্যন্ত হালনাগাদ তথ্য রয়েছে তাদের কাছে। এর একটা কপি সারাবাংলার হাতেও রয়েছে।
দলীয় সূত্রমতে, রংপুর বিভাগে ১০টি, রাজশাহী বিভাগে ৯টি, খুলনা বিভাগে ১১টি, বরিশাল বিভাগে ৮টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ৭টি, ঢাকা বিভাগে ১১টি, ফরিদপুর বিভাগে ৬টি, সিলেট বিভাগে ৫টি, কুমিল্লা বিভাগে ৫টি এবং চট্টগ্রামে বিভাগে ১০টিসহ মোট ৮২টি সাংগঠনিক জেলা রয়েছে বিএনপির।
এগুলোর মধ্যে সর্বাধিক পূর্ণাঙ্গ কমিটি আছে রংপুর বিভাগে। এ বিভাগে পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটির সংখ্যা ছয়। আর কোনো বিভাগে এতোগুলো পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটি নেই বিএনপির।
রংপুর বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপির সভাপতি মো. তৈমুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আমিন, দিনাজপুর জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. মোফাজ্জল হোসেন দুলাল, সাধারণ সম্পাদক বখতিয়ার আহমেদ কচি, নীলফামারী জেলা বিএনপির সভাপতি মো. আলমগীর সরকার, সাধারণ সম্পাদক মো. জহুরুল আলম, লালমনিরহাট জেলা বিএনপির সভাপতি অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু, সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান বাবলা, কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সভাপতি তাসভীরুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানা, গাইবান্ধা জেলা বিএনপির সভাপতি ডা. মঈনুল হাসান সাদিক, সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুন নবী টিটুল।
এ বিভাগের বাকি চারটি সাংগঠনিক জেলা- পঞ্চগড়, সৈয়দপুর, রংপুর ও রংপুর মহানগরে রয়েছে বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি। নানা কারণে এসব জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারছে না বিএনপি।
রাজশাহী বিভাগের ৯টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে মাত্র একটিতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি রয়েছে বিএনপির। সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির ওই পূর্ণাঙ্গ কমিটির সভাপতি রুমানা মাহমুদ, সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাচ্চু। এ বিভাগের বাকি আট সাংগঠনিক জেলা- বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, রাজশাহী, রাজশাহী মহানগর, নাটোর, পাবনা এবং জয়পুরহাটে বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। দীর্ঘ দিন ধরে এসব জেলা চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে।
পূর্ণাঙ্গ কমিটির দিক থেকে তৃতীয় স্থানে আছে খুলনা বিভাগ। এখানে ১১টি সাংগঠনি জেলার মধ্যে চারটিতে রয়েছে পূর্ণাঙ্গ কমিটি। এ বিভাগের আওতাধীন মেহেরপুর জেলা বিএনপির সভাপতি মাসুদ অরুণ, সাধারণ সম্পাদক আমজাদ হোসেন, কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির সভাপতি মেহেদী আহমেদ রুমী, সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন, ঝিনাইদহ জেলা বিএনপর সভাপতি অ্যাডভোকেট এম এ মজিদ, সাধারণ সম্পাদক জাহদিুজ্জামান মনা এবং নড়াইল জেলা বিএনপির সভাপতি বিশ্বাস জাহাঙ্গীর আলম, সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম।
খুলনা বিভাগের বাকি সাত সাংগঠনিক জেলা- চুয়াডাঙ্গা, যশোর, মাগুরা, বাগেরহাট, খুলনা, খুলনা মহানগর এবং সাতক্ষীরায় বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। আহ্বায়ক কমিটিই এ জেলাগুলোর ভরসা।
পূর্ণাঙ্গ কমিটির দিক থেকে পিছিয়ে থাকা আরেকটি বিভাগ বরিশাল। এ বিভাগে আটটি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে মাত্র একটিতে রয়েছে বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি। গোলাম নবী আলমগীর এবং হারুন অর রশিদ (ট্রুম্যান) নেতৃত্বাধীন ভোলা জেলা কমিটিই বরিশাল বিভাগে বিএনপির একমাত্র পূর্ণাঙ্গ কমিটি।
বাকি সাতটি সাংগঠনিক জেলা- বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল মহানগর, বরিশাল দক্ষিণ, বরিশাল উত্তর, ঝালকাঠি ও পিরোজপুরে বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। এ জেলাগুলোও চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে।
ময়মনসিংহ বিভাগের সাতটি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে তিনটিতে রয়েছে পূর্ণাঙ্গ কমিটি। এ বিভাগের অন্তর্ভুক্ত জামালপুর জেলা বিএনপির সভাপতি ফরিদুল কবির তালুকদার শামীম, সাধারণ সম্পাদক ওয়ারেছ আলী মামুন, শেরপুর জেলা বিএনপির সভাপতি মাহমুদুল হক রুবেল, সাধারণ সম্পাদক মো. হযরত আলী এবং কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি শরিফুল আলম, সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম।
বাকি চারটি সাংগঠনিক জেলা- ময়মনসিংহ, ময়মনসিংহ উত্তর, ময়মনসিংহ দক্ষিণ এবং নেত্রকোনা বিএনপি যথারীতি আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে চলছে দীর্ঘদিন ধরে।
ঢাকা বিভাগের ১১টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি আছে মাত্র তিনটিতে। এ বিভাগের আওতাধীন মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খান রিতা, সাধারণ সম্পাদক এস এ জিন্নাহ কবির, ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি ডা. দেওয়ান মো. সালাউদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক খন্দকার আবু আশফাক, নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট আবুল কালাম, সাধারণ সম্পাদক আবদুস সবুর খান সেন্টু।
বাকি আটটি সাংগঠনিক জেলা- টাঙ্গাইল, মুন্সিগঞ্জ, ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ), ঢাকা মহানগর (উত্তর), গাজীপুর, গাজীপুর মহানগর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ বিএনপি চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে।
ফরিদপুর বিভাগের ৬টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে মাত্র একটিতে আছে পূর্ণাঙ্গ কমিটি। শফিকুর রহমান কিরণ ও এ কে এম নাসির উদ্দীন কালু নেতৃত্বাধীন শরিয়তপুর জেলা বিএনপির কমিটিটাই ফরিদপুর বিভাগের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ কমিটি। এ বিভাগের বাকি পাঁচটি সাংগঠনিক জেলা- রাজবাড়ী, ফরিদপুর, ফরিদপুর মহানগর, গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই।
সিলেট বিভাগের পাঁচটি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি আছে তিনটিতে। এ বিভাগের অন্তর্ভুক্ত সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি কলিম উদ্দিন আহমেদ মিলন, সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নুরুল, সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ইমরান আহমেদ চৌধুরী, মৌলভী বাজার জেলা বিএনপির সভাপতি এম নাছের রহমান, সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজান। বাকি দুইটা জেলা- সিলেট মহানগর এবং হবিগঞ্জে বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই।
কুমিল্লা বিভাগে পাঁচটি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে মাত্র একটিতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি রয়েছে বিএনপির। এ বিভাগের অন্তর্ভুক চাঁদপুর জেলা বিএনপির সভাপতি শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সলিমুল্লাহ সেলিম। বাকি চারটি সাংগঠনিক জেলা- ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা মহানগর, কুমিল্লাহ উত্তর ও কুমিল্লা দক্ষিণ চলছে যথারীতি আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে।
পূর্ণাঙ্গ কমিটির দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে আছে চট্টগ্রাম বিভাগ। এখানে ১০টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে পাঁচটিতে আছে পূর্ণাঙ্গ কমিটি। চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তভুক্ত নোয়াখালী জেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম হায়দার, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুল রহমান, কক্সবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি শাহজাহান চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক শামীম আরা স্বপ্না, খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সভাপতি ওয়াদুদ ভূঁইয়া, সাধারণ সম্পাদক এম এন আবছার, রাঙ্গামাটি জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক দীপন তালুকদার, বান্দরবান জেলা বিএনপির সভাপতি মা ম্যা চিং, সাধারণ সম্পাদক জাবেদ রেজা।
এ বিভাগের বাকি পাঁচটি সাংগঠনিক জেলা- ফেনি, লক্ষীপুর, চট্টগ্রাম দক্ষিণ, চট্টগ্রাম উত্তর এবং চট্টগ্রাম মহানগরে পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। এসব জেলা চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে।
অর্থাৎ সারা দেশে মাত্র ২৩ শতাংশ জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি রয়েছে বিএনপির। বাকি ৬৭ শতাংশ জেলা চলছে আংশিক বা আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। এ রকম ‘দুর্বল’ সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে আগামী দিনের আন্দোলন-সংগ্রাম কতটা সফল হবে, তা নিয়ে খোদ বিএনপিতেই আছে নানা আলোচনা। অধিকন্তু কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ শেষে হয়েছে তিন বছর আগে। নানাবিধ কারণে জাতীয় কাউন্সিলও করতে পারছে না বিএনপি। তবে দলটির নেতাদের বিশ্বাস- আন্দোলন-সংগ্রামের ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ কমিটি থাকা না থাকার বিষয়টি খুব একটা গুরুত্ব পাবে না। পদ-পদবীর ব্যাপারে আগ্রহ থাকলেও বৃহত্তর স্বার্থে সব কিছু ভুলে গিয়ে দলের হাইকমান্ডের নির্দেশ পালন করবে সবাই।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকারের সীমাহীন দমন-পীড়ন, দলীয় প্রধানের কারাভোগ এবং মহামারির কারণে দল পুনর্গঠন কাজ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় এগোয়নি। প্রতিকুল পরিস্থিতির মধ্যেও ৩০টির মতো সাংগঠনিক জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি আর বাকি সাংগঠনিক জেলায় আহ্বায়ক কমিটি দেওয়া হয়েছে। খুব শিগগিরই আহ্বায়ক কমিটিগুলো পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে রূপান্তরিত হবে।’
সাত মাস আগে গঠিত মুন্সীগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব কামরুজ্জামান রতন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এরইমধ্যে আমাদের আটটি ইউনিটের কাজ সম্পন্ন করে ফেলেছি। আমাদের আহ্বায়ক আব্দুল হাই বিদেশে চিকিৎসাধীন আছেন। উনি ফিরলেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিয়ে দেবো।’