সাংবাদিক তুলির মরদেহ উদ্ধার: মোটরসাইকেলে আসা যুবককে খুঁজছে পুলিশ
১৪ জুলাই ২০২২ ১৯:৩১
ঢাকা: অনলাইন পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের সাবেক সাংবাদিক সোহানা পারভীন তুলির ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। ওই ঘটনায় ‘আত্মহত্যা’র সুস্পষ্ট নমুনা মিললেও এর পেছনের কারণ খুঁজছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। সন্দেহের তালিকায় রয়েছেন মোটরসাইকেলে তুলির বাসায় যাতায়াতকারী এক যুবক। ওই মোটরসাইকেলের নম্বরও হাতে পেয়েছেন তদন্তকারীরা।
পুলিশের ধারণা, তুলি আত্মহত্যা করতে পারে। তবে মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মর্গে (ফরেনসিক বিভাগ) পাঠানো হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে প্রকৃত ঘটনা কী ঘটেছিল তা জানা যাবে।
ডিএমপির ধানমন্ডি জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) আব্দুল্লাহ আল মাসুম সারাবাংলাকে বলেন, ‘একটি আত্মহত্যার যতগুলো লক্ষণ দেখা যায় তার সবই ছিল তুলির ঘটনায়। রশির গিট মাথার পেছন দিকে লাগানো ছিল, রশির দাগ থুতনি বরাবর ছিল। জিহ্বা বের হয়ে দাঁতের সঙ্গে লেগে ছিল। জর্জেটের ওড়না দিয়ে ফাঁস নেওয়ায় ওড়নাটি বেড়ে যাওয়া ছিল। ফলে তুলির শরীর নিচের দিকে ঝুলে পড়েছিল। বিছানায় পাশেই একটি টুল পড়েছিল। বিছানায় হাঁটু গেড়ে ঝুলেছিল তুলির শরীর।’
এসি মাসুম বলেন, ‘তুলির বান্ধবী নন্দিতার ভাষ্য অনুযায়ী— কেয়ারটেকার আজিমুদ্দিনকে নিয়ে সিঁড়ির পাশে দুই তলার দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেছেন নন্দিতা। এরপর ভেতরের কক্ষের দরজা খোলা ছিল। লাইট জ্বালানো ছিল। আর সেখানেই ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছিল তুলি। এরপর নন্দিতা আর ভেতরে প্রবেশ না করে বিষয়টি পুলিশকে ফোন করে জানান।’
সহকারী কমিশনার বলেন, ‘ওই বাসার কেয়ারটেকার একটি মোটরসাইকেলের নম্বর দিয়েছেন। ওই নম্বরের মোটরসাইকেলে এক যুবক আসতেন এই বাসায়। ওই নম্বরটি আমরা বিআরটিএতে পাঠিয়েছি। কেয়ারটেকারের দেওয়া মোটরসাইকেলের নম্বরের আগে ঢাকা মেট্টো ‘হ’ বা ‘ল’ না থাকার কারণে প্রকৃত ব্যক্তিকে বের করতে একটু জটিলতা রয়েছে। এর বাইরে তুলির ফোন নম্বরের সূত্র ধরেও ওই যুবককে শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।’
পুলিশের সহকারী কমিশনার আব্দুল্লাহ আল মাসুম বলেন, ‘আত্মহত্যার প্ররোচনায় ওই যুবকের কোনো হাত আছে কি না তা বেরিয়ে আসবে। এ ছাড়া ওই যুবক কে, কী কারণে আসতেন, তার সঙ্গে তুলির কী সম্পর্ক ছিল এ সব নিয়েও কাজ চলছে। তবে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের আগে কিছুই বলা যাচ্ছে না।’
কেয়ারটেকার আজিমুদ্দিন সারাবাংলাকে জানান, তিনি প্রায় আড়াই মাস ধরে এই বাসায় কেয়ারটেকারের কাজ নিয়েছেন। গত দুইমাস ধরে মোটরসাইকেলে এক যুবক আসেন এ বাসায়। প্রথম দিন তিনি এসে বাসার গ্যারেজে মোটরসাইকেল পার্কিং করতে চাইলে কেয়ারটেকার তাতে বাধা দেন। এরপর তুলি নিচে নেমে এসে কেয়ারটেকারকে ধমক দিয়ে বলেন, ‘কেন গেস্টের গাড়ি ভেতরে ঢুকতে দেবেন না?’
তখন কেয়ারটেকার মালিকের সঙ্গে কথা বলতে বলেন তুলিকে। কারণ বাইরের গাড়ি গ্যারেজে পার্কিং করার বিষয়ে মালিকের মানা ছিল। এ বিষয়ে তুলি ওই বাসার মালিকের সঙ্গে কথাও বলেন।
পরে কেয়ারটেকারকে ফোন করে বাসার মালিক বলেন, ‘ওই গাড়ির নম্বরটা লিখে রেখে প্রবেশ করতে দিও। এর বাইরে অন্য কোনো গাড়ি এলে ঢুকতে দিও না। এরপর থেকে ওই গাড়িসহ যুবককে প্রবেশ করতে দেন।’
কেয়ারটেকার জানান, সপ্তাহে দুই তিনদিন ওই যুবক আসতেন। কোনোদিন তুলি নিজেই নিচে নেমে আসতেন। আবার কখনও ওই যুবকের সঙ্গে মোটরসাইকেলে চলে যেতেন। আবার কখনও মোটরসাইকেল গ্যারেজে রেখে ওপরে উঠতেন। এক বা দুই ঘণ্টা পর নেমে ওই যুবক চলে যেতেন।
কেয়ারটেকার কোনোদিন ওই যুবকের নাম জিজ্ঞেস করেননি। এমনকি তার ফোন নম্বরও রাখেননি। শুধু মোটরসাইকেলের মূল নম্বরটি টুকে রেখেছিলেন।
মোটরসাইকেলের নম্বরের সামনে ঢাকা মেট্টো ‘হ’ কিংবা ‘ল’ লেখা ছিল কি না জানতে চাইলে আজিমুদ্দিন বলেন, ‘সেটি আমি লিখে রাখিনি। ঠিকমতো পড়তে পারি না। শুধু মোটরসাইকেলের নম্বরটি লিখে রেখেছিলাম।’
মোটরসাইকেলটি দেখতে কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জলপাই কালারের ছিল মোটরসাইকেলটি। তেলের ট্যাঙ্কিটি ছিল অনেক মোটা। তবে গাড়ির নাম তিনি বলতে পারেননি।’
মোটরসাইকেলটি হাঙ্ক বা সুজুকি কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পড়তে পারি না।’
আলামত জব্দ করতে আসা সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের পুলিশ পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সব ধরনের আলামত সংগ্রহ করেছি। এসব আলামত ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হবে। এরপর প্রতিবেদন দেওয়া হবে। প্রতিবেদন পাওয়ার আগে কিছুই বলা যাচ্ছে না।’
সোহানা তুলির ছোটভাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোহাইমিনুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০১০ সালে আপুর বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের ৮ মাসের মাথায় ডিভোর্স হয়ে যায়। এরপর থেকে আপু একাই থাকতেন। অনলাইন পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউন প্রকাশ হলে তিনি শুরুর দিকের কর্মী ছিলেন। গত দুই বছর হলো তিনি চাকরি ছাড়েন। এরপর থেকে তিনি ফ্রিল্যান্সিং করতেন এবং অনলাইনে একটি পেজ (মনোহরি) খুলে ব্যবসা করতেন।’
তুলির ভাই বলেন, ‘হাজারীবাগের মিতালী রোডের ২৯৯/৫ এই বাসার দ্বিতীয় তলার এই বাসায় ২০১৮ সালের ডিসেম্বর থেকে একাই থাকতেন। আমি নিজেও মাঝেমধ্যে এসে থাকতাম এই বাসায়। ইদে আমি গ্রামের বাড়ি যশোরে গিয়েছিলাম। গতকাল (১২ জুলাই) দুপুরে ঢাকায় আসি। এরপর মোহাম্মদপুরে বন্ধুর বাসায় উঠি। আপুর মৃত্যুর খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসি।’
ঘটনার দিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত বাংলা ট্রিবিউনের সিনিয়র রিপোর্টার (ক্রাইম চীফ) নুরুজ্জামান লাবু। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘সোহানা তুলি আত্মহত্যা করবে তা ভাবতেই পারছি না। তিনি সদা হাস্যোজ্জ্বল ও প্রাণোচ্ছ্বল ছিলেন। অনেক শক্ত ছিলেন। কোনো কিছু তাকে দুর্বল করতে পারত না। চাকরি ছেড়ে তিনি ব্যবসা করছিলেন। এনজিওতেও কাজ করছিলেন। এরপরও তিনি কেন আত্মহত্যা করতে গেলেন সেটিই বুঝতে পারছি না। আত্মহত্যার পেছনে নিশ্চয়ই বড় কোনো প্ররোচনা রয়েছে। সেটি এখন পুলিশের খুঁজে বের করা উচিত।’
বৃহস্পতিবার (১৪ জুলাই) রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে সাংবাদিক সোহানা তুলির মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়েছে। এরপর তুলির মরদেহ যশোরে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় আপাতত হাজারীবাগ থানায় একটি ইউডি মামলা করেছে পরিবার।
ময়নাতদন্তের পর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সেলিম রেজা চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘সুরতহাল রিপোর্টের তথ্যের সঙ্গে তুলির মরদেহের ময়নাতদন্তেও একই নমুনা পাওয়া গেছে। আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যু হয়েছে কি না নিশ্চিত হতে ফরেনসিক প্রতিবেদন পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’
আরও পড়ুন
সাংবাদিক সোহানা তুলির ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
সাংবাদিক সোহানা তুলির মৃত্যুতে ডিএসইসি’র উদ্বেগ
সারাবাংলা/ইউজে/একে