রমনা পার্কে ‘ক্যানপার্টি’র দৌরাত্ম্য, বাড়ছে ছিনতাইসহ নানা অপরাধ
১৫ জুলাই ২০২২ ১৯:০৪
ঢাকা: রাজধানীর ফুসফুসখ্যাত রমনা পার্কে নানা রকমের অপরাধ বাড়ছে। রাতে চলে অসামাজিক কার্যক্রম, মাদক ব্যবসা। আর দিনে ‘ক্যান পার্টি’র কারণে পার্কে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীদের করতে হয় বাড়তি খরচ। নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে আনসার বাহিনী রমনায় কর্তব্যরত থাকলেও তারা এসব এড়িয়ে চলে বলে অভিযোগ। কারণ তাদের ‘ম্যানেজ’ করে ক্যান পার্টি রমনা পার্কে প্রবেশ করে থাকে। আর ছিনতাইকারীর কবলেও পড়তে হচ্ছে নারীদের। অনুসন্ধান চালিয়ে রমনা পার্কের বর্তমান পরিস্থিতি সর্ম্পকে এক এসব জানা গেছে।
প্রাকৃতিক পরিবেশে একটু স্বস্তিতে সময় কাটাতে রাজধানীর বাসিন্দাদের পছন্দ রমনা পার্ক। আর সেজন্যই বর্তমান সরকার রমনা পার্কের উন্নয়নের জন্য ৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে পার্কের সৌন্দর্যবর্ধন করে। লেকের দু’পাশে ওয়াক ওয়েসহ রাস্তা এবং ৪টি বাথরুম করা হয়। নতুন রূপে রমনা দেখতে অনেকে পরিবার পরিজন, বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরতে আসেন এখানে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, সচিবসহ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ সকাল-বিকাল নিয়ম করে শারীরিক চর্চা করেন রমনায়। এমন স্বস্তির মাঝে প্রয়ই মিলছে অস্বস্তির খবর। দিন-দুপুরে নির্জন এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এছাড়া ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে ঘুরতে গেলে ‘ক্যান পার্টির’ খপ্পরে পরে নাজেহাল হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। যদিও কোনো ধরনের হকারের রমনায় প্রবেশ করারই নিয়ম নেই। এরপরও কতিপয় আনসার সদস্য ও গণপূর্তের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়ম ভেঙে ‘ক্যান পার্টি’র লোকজনকে পার্কে ঢুকতে সহায়তা করছে।
এছাড়াও রাতে ভ্রাম্যমাণ পতিতাদেরও আনাগোনা থাকে পার্কে, বলে অভিযোগ মিলেছে। তবে অনিয়মে জড়িয়ে পড়ায় কিছুদিন পর পর আনসারদের বদলি করে নতুনদের আনা হয়। ইদের আগেও বেশ কয়েকজন আনসারকে রমনা পার্ক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
যদিও রমনা পার্কের আনসার কমান্ডার আবুল কালাম আজাদ ‘ক্যান পার্টি’সহ পার্কের অভ্যন্তরে সব ধরণের অনিয়ম বন্ধে কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছেন৷
গত বুধবারও দুই জন ছিনতাইকারীকে ধরে রমনা থানায় সোপর্দ করা হয়। শুক্রবার (১৫ জুলাই) সকালে ১০টায় গাঁজাসহ দু’জনকে আটক করে আনসারবাহিনী। এছাড়া গত শুক্রবার সকালেও অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে দু’জনকে পুলিশে দেওয়া হয়েছে।
রমনা থানায় ফোন করা হলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (অপারেশন) বলেন, ‘সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার পর পার্কে কাউকে ঢুকতে না দেওয়ার নির্দশনা আছে। এছাড়া রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত এই পার্ক হকার ঢুকবে না এটা সিদ্ধান্ত। কিন্তু দিনভর ক্যানপার্টির লোকজন দর্শনার্থীদের নাজেহাল করে আসছে। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের বেশি হয়রানির শিকার হতে হয়।’
সরেজমিন দেখা গেছে, কয়েকজন যুবক পুরো পার্কের এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দিনভর ঘুরে বেড়ান। বিশেষ করে দুপুরের দিকে ব্যায়াম করতে আসা লোকজন কম থাকায় তখন এদের উৎপাত বেড়ে যায়। এই গ্রুপের লোকজন প্যান্টের সবগুলো পকেটে সফট ড্রিংকসের একাধিক বোতল, শার্টের পকেটে কম দামি চকলেট নিয়ে ঘুরতে থাকেন। হঠাৎ করে লোকজন কম এমন জায়গায় কোনো ছেলে মেয়ে বসে থাকলে গিয়ে বোতলটা খুলে তাদের হাতে ধরিয়ে দেয়।
পরে এই গ্রুপের সদস্যরা রমনার প্যাকেজ ৩০০ টাকা, ৩৯০ টাকা এমন দাম ধরে দর্শনার্থীদের কাছ জোর করে টাকা রেখে দেয়। টাকা না দিলে খারাপ আচরণ করে এই চক্রের সদস্যরা।
এছাড়া রমনার মৎসভবন ও শিশুপার্কের উল্টো দিকের গেটের সামনের ফুচকার দোকান থেকে ভ্যান পার্টির সদস্যরা দর্শনার্থীদের কাছ থেকে দুইগুণ, তিনগুণ দামে খাবার বিক্রি করে থাকে। প্রত্যক গেটে আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করে রমনা পার্কে। হকার ও ক্যান পার্টির একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, আনসারদের টাকা দিলে রমনায় প্রবেশ করা সহজ।
গণপূর্তের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘পার্কের ভেতরে অবকাঠামো, গাছপালা, সৌন্দর্যবর্ধন, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা এসব দেখভাল করে গণপূর্ত। কিন্তু সার্বিক নিরাপত্তার বিষয় আনসার সদস্যরা দেখেন। স্পষ্ট বলা আছে ক্যান পার্টি তো দূরে থাক কোনো হকার ঢুকবে না। কিন্তু তাদের সামনে দিয়ে ঢুকছে বের হচ্ছে। এর দায় কার?’ এমনকি দর্শনর্থীদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা আদায় করারও অভিযোগ আছে আনসারদের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ আছে, রমনা পার্কে ডিউটির সুযোগ পেতে কোনো কোনো আনসার সদস্য লাখ টাকার মতো খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। যদিও এসব বিষয় পুরোপুরি অস্বীকার করে আনসারদের ইনচার্জ আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘কোনো অনিয়মের সুযোগ নেই। সবাইকে কড়া নির্দেশ দেওয়া আছে। যদি কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ওঠে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
আমাদের মহাপরিচালক স্যারও কোনো অনিয়ম সহ্য করেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ক্যান পার্টির লোক সামনে দেখলেই অ্যারেস্ট। রমনা থানা আমাদের সবসময় সাপোর্ট দেয়। কিন্তু পার্কের এলাকা বড় হওয়ায় অনেক সময় রেলিং টপকে কেউ হয়তো ঢুকে পড়ে, কিন্তু সামনে পড়লেই পুলিশে দেই।’
অভিযোগ আছে, ক্যানপার্টি, হকারদের থেকে উৎকোচের টাকার ভাগ গণপূর্তের সংশ্লিষ্টদের পকেটেও যায়। যদিও এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রমনা পার্কে দায়িত্ব পালন করা গণপূর্তের উপসহকারী প্রকৌশলী শামসুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তার বিষয় দেখে আনসার সদস্যরা। কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলে আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানালে তাদের এখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।’
শামসুল ইসলাম আরও বলেন, ‘গণপূর্তের লোকজনও টাকা নেয় এটা যদি কেউ বলে সে মিথ্যা কথা বলেছে। আমাদের টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই।’
তবে এই উপসহকারী প্রকৌশলী শামসুল ইসলামের বিরুদ্ধে রমনা পার্কে কর্তব্যরত কর্মচারীরা নাম গোপন রাখার শর্তে জানান, ‘শামসু সাহেব খুবই চতুর লোক। তিনি চোরকে বলে চুরি করতে, আর গৃহস্থকে বলেন সজাগ থাকতে। নিজের চাকরি রক্ষা এবং সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার জন্য পূর্তসচিব, পূর্ত অধিদফতরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের লেকের মাছসহ পার্কের আম কাঁঠাল তাদের বাসায় দিয়ে আসেন। এছাড়া রমনা পার্কে উন্নয়নের জন্য যেসব ঠিকাদার কাজ করেন তাদের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে থাকেন। তার বিরুদ্ধে শহিদ নামের একজন কর্মচারী একটি টেলিভিশনে মন্তব্য করার কারণে চট্টগ্রামে বদলি হয়েছেন। উপসহকারী প্রকৌশলী শামসু দীর্ঘদিন রমনায় কর্মরত আছেন। সরকারি চাকরির নিয়ম অনুসারে তিন বছরের বেশি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী এক স্থানে কর্মরত থাকতে পারেন না। অথচ তিনি আছেন।’
সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা বলতে গণপূর্ত অধিদফতরের প্রধান প্রকোশলী শামীম জামানের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরে জানা গেছে, তিনি বর্তমানে দেশের বাইরে আছেন।
কথা বলার জন্য চেষ্টা করা হয় অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী নাসিম খানের সঙ্গে। তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
এছাড়া গণপূর্ত মন্ত্রী এবং সচিবকে এ সর্ম্পকে তাদের বক্তব্য জানার জন্য একাধিকবার ফোন করা হলে তারা ফোন রিসিভ করেননি।
সারাবাংলা/এএইচএইচ/এমও