‘হঠাৎ একদিন খবর পাবেন, ঘর ভেঙে পড়ে আমরা সবাই মরে গেছি’
১৬ জুলাই ২০২২ ০৯:৫৭
সুনামগঞ্জ: একপাশে সুরমা নদীর উত্তাল ঢেউয়ের পানি, অন্য পাশে ছোট একটি ভাঙা ঘরে ভাই-বোনদের নানান রঙের টকবক কথা। দেখে বুঝার উপায় নেই, তারা না খেয়ে আছে। বড় বোন তাদের পেটের খিদার জ্বালা ভুলিয়ে রাখতে শুনাচ্ছে লাল-নীল পরীর গল্প। বন্যার শুরুর পর কোনোদিনই তিনবেলা পেট ভরে খাবারও জোটেনি তাদের ভাগ্যে। আশ্রয়ের ঠিকানা বানের জলে ভেঙেচুরে গেছে। সেই ভাঙা ঘরেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থাকতে হচ্ছে এই অবুঝ শিশুদের।
সরেজমিনে তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাদের মা গেছে জুতা সেলাইয়ের কাজে। কাজ করে যা পাবেন তাই দিয়ে নিয়ে আসবেন চাল। তারপর রান্না হলে খাবার জুটবে সবার।
তাদের বাড়ি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের রাজার গাও গ্রামে। তবে এই গ্রামে কোনো রাজা-বাদশার বসবাস নেই। গ্রামের বাসিন্দারা কেউ দিন মজুর, কেউ কৃষক আবার কেউবা জুতা সিলাইয়ের কাজ করেন। তাদেরই একজন ময়না মতি। পাঁচ বছর আগে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি স্বামীকে হারিয়ে ৪ সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে নিজেই বাজারে বাজারে কিংবা গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষের জুতা সেলাই করেন। এরপরও ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ভালোই কাটছিল ময়নামতির সংসার। কিন্তু উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে তছনছ হয়ে গেছে ময়নামতির ঘর। ভেসে গেছে ঘরের সকল আসবাবপত্র। সেইসঙ্গে ভেসে গেছে তার অর্থ যোগান দেওয়া জুতা সেলাই করার মূল যন্ত্রগুলো। ছেলে-মেয়েদের নিয়ে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিলেও বন্যার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত তিনবেলা খাবার পেটে পড়েনি। এমনকি সরকারি কোন সহায়তাও পাননি।
ময়নামতি পরিবারের ছোট ছোট সদস্যরা বলে, খুব কষ্টে আছি আমরা। আমাদের কেউ দেখে না।
তাদের বড় বোন রাজ মতি বলে, আম্মা জুতা সিলাই করতে সেই সকাল বেলা বাসা থেকে গেছে। এখনো চার ভাই বোনের পেটে কেন খাবার পড়েনি। তারা সবাই (ছোট ছোট ভাই গুলো) বলছে, তাদের খিদা লাগছে। কিন্তু ঘরে খাবার নেই। তাদের খিদা ভুলিয়ে রাখতে লাল, নীল পরীর গল্প শুনাচ্ছি।
ময়নামতি রবি দাস জানান, বন্যায় ঘরটা ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। এখন ভাঙা ঘরে ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকি। হটাৎ একদিন খবর পাবেন ঘর ভেঙে আমাদের পরিবারের সবাই মরে গেছি। শুধু দুঃখ একটাই সরকার থেকে কোন সহযোগিতা পেলাম না। কেউ কি নেই আমার ভাঙা ঘরটা মেরামত করে দিতে পারে।
তিনি বলেন, দুঃখে দুঃখে জীবনটাই গেল আমার। পাঁচ বছর আগে স্বামীকে হারিয়েছি। তারপর ছেলে মেয়ের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য কিছুদিন ভিক্ষা করেছি কিন্তু কেউ ভিক্ষা দেয়নি। বরং বলে কাজ করি না কেন। কিন্তু বড় ধরনের কাজ করার সামর্থ্য আমার নেই। আমার শরীরে বিভিন্ন রোগ (টিবি) বাসা বেঁধেছে। ছেলে মেয়ের জন্য হয়ত উপরওয়ালা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।
গৌরারং ইউনিয়নের দুই নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সালেক মিয়াকে ফোন দিয়ে জানতে চাওয়া হয়, ময়নামতি কেন সরকারি সহয়তা পেল না? যাদের ঘর একবারে পরে গেছে তাদের ১০ হাজার টাকা করেও দেওয়া হয়েছে, তাহলে ময়নামতি বঞ্চিত হল কেন? উত্তরে তিনি বলেন, সরকারের দেওয়া ১০ হাজার টাকা আমার ওয়ার্ডের একজন মানুষও পাইনি। অথচ আমার ওয়ার্ড খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা বলেন আবেদন করতে।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, বন্যা পরবর্তী মানুষ যাতে ঘুরে দাঁড়াতে পারে সেই জন্য আমরা সকল ধরনের চেষ্টা করেছি।
সারাবাংলা/এএম