ফেসবুকে কিডনি কেনাবেচা, গ্রেফতার ৫
২০ জুলাই ২০২২ ১৭:০৯
ঢাকা: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অবৈধভাবে কিডনি কেনা বেচার সংঘবদ্ধ চক্রের অন্যতম হোতা মো. শহিদুল ইসলাম মিঠুসহ চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-১)। এ সময় তাদের কাছ থেকে বিপুল সংখ্যক পাসপোর্ট, ভারতীয় রুপি, টাকা, অসংখ্য সিলমোহর, স্ট্যাম্প এবং বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই ও এটিএম কার্ড জব্দ করা হয়।
গ্রেফতারদের মধ্যে রয়েছেন: মো. শহিদুল ইসলাম মিঠু (৪৯), মো. মিজানুর রহমান (৪৪), মো. আল মামুন ওরফে মেহেদী (২৭), মো. সাইমন (২৮) ও মো. রাসেল হোসেন (২৪)।
বুধবার (২০ জুলাই) দুপুরে কারওয়ান বাজার মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন এসব তথ্য জানান।
তিনি বলেন, র্যাবের সাইবার ক্রাইম মনিটরিং টিম জানতে পারে প্রতারণার মাধ্যমে কিডনিসহ নানাবিধ অঙ্গের অবৈধ ট্রান্সপ্লান্টেশনের সঙ্গে সক্রিয় রয়েছে কয়েকটি চক্র। এসব চক্রের ফাঁদে পড়ে অসহায় নিম্নআয়ের মানুষ ক্ষেত্র বিশেষে গ্রাহকরাও প্রতারিত হচ্ছে। আইন বহির্ভূত, স্পর্শকাতর ও অবৈধ ট্রান্সপ্লান্টেশনের এহেন কার্যক্রমে চক্রের সদস্যরা অর্থের লোভে অমানবিক কার্যক্রমে যুক্ত রয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) রাজধানীর ভাটারা, বনশ্রী, মিরপুর থেকে কিডনি কেনাবেচা চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
গ্রেফতারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিডনি কেনাবেচা চক্রের মোট সদস্য সংখ্যা ১৫-২০ জন। তারা মূলত তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে কিডনি কেনাবেচার এই অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। এই চক্রের সদস্যরা ভারতে অবস্থানরত কিডনি কেনা বেচা সদস্যদের চক্রের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রায় শতাধিক মানুষকে পাচার করেছে বলে জানা যায়। চক্রের প্রথম গ্রুপ ঢাকায় অবস্থান করে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রয়োজন এমন বিত্তশালী রোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
চক্রের দ্বিতীয় দলটি প্রথম দলের চাহিদা মোতাবেক দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরিব ও অভাবী মানুষদের চিহ্নিত করে এবং তাদের অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অর্থের বিনিময়ে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের জন্য ডোনার হতে প্রলুব্ধ করে ঢাকায় নিয়ে আসে।
পরবর্তীতে তৃতীয় অন্য একটি গ্রুপ প্রলোভনের শিকার ভুক্তভোগী কিডনি ডোনারদের ঢাকায় বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রত্যাশী রোগীর সঙ্গে ব্লাড ম্যাচিং এবং অন্যান্য পরীক্ষা নিরীক্ষা সম্পন্ন করে। ব্লাড ম্যাচিং এবং অন্যান্য ডায়াগনস্টিক টেস্টে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন এর উপযুক্ততা নিশ্চিত হলে, তার পাসপোর্ট, ভিসা প্রসেসিং এবং ভুয়া কাগজপত্র তৈরির মাধ্যমে ভূক্তভোগী ডোনারকে ভারতে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করে। এই চক্রের সঙ্গে ভারতে অবস্থানকারী আরেকটি চক্র পারস্পরিক যোগসাজশে ভুক্তভোগী কিডনি ডোনারকে বিদেশের এয়ারপোর্ট অথবা স্থলবন্দরে রিসিভ করা থেকে শুরু করে হাসপাতালের ডকুমেন্টেশন, অস্ত্রপচারসহ যাবতীয় কার্যক্রম শেষে ভিকটিমদের বৈধ ও অবৈধ উপায়ে বিমান বা উত্তর পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত এলাকার মাধ্যমে দেশে ফেরত পাঠায়।
গ্রেফতাররা এই চক্রের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ অবৈধ উপায়ে হাতিয়ে নিয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছে। প্রতিটি কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য তারা রোগী প্রতি ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা নিতো। বিপরীতে তারা কিডনি ডোনারকে মাত্র চার থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা দেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করে এবং অগ্রীম দুই লাখ টাকা দিত। কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের পর প্রলোভনের শিকার কিডনি দাতাদের প্রতিশ্রুত অর্থ না দিয়ে নানাবিধ ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হতো।
বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, চক্রের মূলহোতা ও অন্যতম অভিযুক্ত মো. শহিদুল ইসলাম মিঠু (৪৯) ২০১৬ সালে নিজের চিকিৎসার জন্য ভারতে যায়। সেখানে অবস্থানকালীন সে কিডনি প্রতিস্থাপনের রোগীদের ব্যাপক চাহিদা দেখতে পায় এবং সে নিজেই কিডনি প্রতিস্থাপনের অবৈধ ব্যবসা চালানো শুরু করে। ভারতে অবস্থানরত কিডনি কেনাবেচা চক্রের সঙ্গে যোগসাজশে সে এখানে কিডনি চক্রের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতায় একটি দালাল চক্র প্রতিষ্ঠা করে। তারা অনলাইনের মাধ্যমে আগ্রহী বিত্তশালী কিডনি রোগী এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে কিডনি ডোনার সংগ্রহসহ যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করতেন। অদ্যবধি তার মাধ্যমে ৫০ এর অধিক কিডনি কেনাবেচা হয়েছে বলে সে প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছে।
গ্রেফতার মো. মিজানুর রহমান (৪৪) কিডনি ডোনারদের ভারতে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পাসপোর্ট, ব্যাংক এনডোর্সমেন্ট, মেডিকেল ডকুমেন্টস, ভিসা এবং অন্যান্য কাগজপত্র তৈরি করে থাকে।
প্রসঙ্গত, যে সব ব্যক্তিদের কাগজপত্র সঠিক থাকে না কিংবা প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টের ঘাটতি থাকে, তাদের কাগজপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে প্রস্তুত করে থাকে এবং সে ১০ বছরের অধিক সময় ধরে এ কাজ করে আসছে।
গ্রেফতার মো. সাইমন কয়েক বছর আগে এবং মো. আল মামুন ওরফে মেহেদী ছয় মাস আগে চক্রটির মাধ্যমে জনপ্রতি চার লাখ টাকায় কিডনি বিক্রি করে। পরবর্তীতে দ্রুততম সময়ে অধিক পয়সা উপার্জনের লোভে তারা এ চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এবং কিডনি ডোনার ও ক্রেতা সংগ্রহে লিপ্ত হয়। তারা নিজেদের সুস্থতার প্রমাণ দেখিয়ে অন্যান্য ডোনারদের কিডনি বিক্রয়ে আগ্রহী করত। তারা অদ্যবধি ১০ জনের কিডনি কেনাবেচা করেছে বলে জানা যায়। এছাড়াও গ্রেফতার মো. রাসেল হোসেন (২৪) দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে টাকার প্রলোভন দেখিয়ে সম্ভাব্য ডোনারদের সংগ্রহ করত।
গ্রেফতার এই চক্রটি কিডনি রোগে আক্রান্ত রোগীদের পার্শ্ববর্তী দেশে কিডনি চিকিৎসায় সহায়তার নাম করে, অর্থ আয়ের উদ্দেশ্যে, কিডনি প্রতিস্থাপনে উৎসাহিত করত। কিডনি রোগে আক্রান্ত রোগীদের সেবা প্রদানের আড়ালে তারা এই ভয়ংকর কিডনি কেনাবেচার সিন্ডিকেট পরিচালনা করে আসছিল বলে র্যাবের প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
সারাবাংলা/ইউজে/একেএম