কক্সবাজারে বন উজাড় করে উন্নয়ন চান না পরিবেশবাদীরা
২০ জুলাই ২০২২ ২০:৫৩
ঢাকা: দেশের বৃহত্তম সামুদ্রিক মৎস্য বন্দর ও পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজারে বিপুল পরিমাণ বনভূমি অবৈধভাবে দখল করা হয়েছে। অপরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে কক্সবাজারে বায়ুদূষণ, তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়াসহ নানা পরিবেশগত সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এর মধ্যেও জেলার রামু উপজেলায় ২০ একর সংরক্ষিত বনভূমি অবমুক্ত করে টেকনিক্যাল সেন্টার নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকে (বাফুফে)।
বন উজাড় করে এরকম উন্নয়ন দেখতে রাজি নন পরিবেশবাদীরা। পরিবেশ নিয়ে কর্মরত সংগঠনগুলো বলছে, কেবল কক্সবাজার নয়, দেশের সামগ্রিক পরিবেশের সুরক্ষার কথা বিবেচনায় এনে বন উজাড় করে অবকাঠামো উন্নয়নের প্রবণতা বন্ধ করতে হবে।
বুধবার (২০ জুলাই) রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে ১২টি স্থানীয় ও জাতীয় পরিবেশবাদী সংগঠনের আয়োজনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলা হয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) ২০২১ সালের এক যৌথ গবেষণার তথ্য তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে কক্সবাজারে মোট বনভূমি ও উজাড় হয়ে যাওয়া বনভূমির তুলনামূলক পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, কক্সবাজার জেলায় মোট বনভূমির পরিমাণ ২ লাখ ৬০ হাজার ৪৬ একর। এর মধ্যে অবৈধ দখলে যাওয়া বনভূমির পরিমাণ ৪৫ হাজার ৯৯০ একর, যা মোট বনভূমির ১৭ শতাংশেরও বেশি। এর বাইরেও রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে উজাড় হয়েছে ৬ হাজার ১৬৪ একর বনভূমি। এছাড়াও সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বরাবর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে আরও ১৪ হাজার ৩৭২ একর বনভূমি। এ পর্যন্ত বন বিভাগ থেকে ভূমি মন্ত্রণালয়কে ১০ হাজার ৪৬০ একর বনভূমি হস্তান্তর করা হয়েছে। সব মিলিয়ে কক্সবাজারের ৭৬ হাজার ৯৮৬ একর বা প্রায় ৩০ শতাংশ বনভূমিই কারও না কারও দখলে রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সম্প্রতি রামু উপজেলার জঙ্গল খুনিয়াপালং মৌজার বিএস ২ নম্বর খতিয়ানের ৪২, ৪৩ ও ৩১ বিএস দাগ নম্বরের ২০ একর সংরক্ষিত বনভূমি অবমুক্ত করে টেকনিক্যাল সেন্টার নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বাফুফেকে। ১৯০৭ সালের এক প্রজ্ঞাপনে এই বনভূমি সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছিল। সংরক্ষিত বনটি এশীয় বন্য হাতি, বানর, বন্য শূকর, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ ও পাখির আবাসস্থল ও বিচরণক্ষেত্র। জঙ্গল খুনিয়াপালং মৌজা ‘প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা’র অংশ হওয়ায় এ এলাকায় প্রাকৃতিক বন ও গাছপালা কাটা এবং ভূমির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন বা নষ্ট করতে পারে, এমন সব কাজ নিষিদ্ধ। কিন্তু বাফুফের টেকনিক্যাল সেন্টার নির্মাণ করতে হলে এখানকার প্রায় ৩০ হাজার গাছ টাকা পড়বে। অথচ বরাদ্দ দেওয়ার আগে এখানকার কোনো পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ করা হয়নি।
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, টেকনিক্যাল সেন্টারটি নির্মাণের জন্য যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় আবেদন করলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় ভূমি বরাদ্দের বিষয়ে সরেজমিন তদন্ত করে মতামত দিতে অনুরোধ করে বন বিভাগকে। পরে বন বিভাগ সরজমিনে তদন্ত করে টেকনিক্যাল সেন্টার নির্মাণের জন্য প্রস্তাবিত স্থান বরাদ্দ দেওয়া সমীচীন হবে না বলে অবহিত করে। বন বিভাগের এই আপত্তি সত্ত্বেও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় গত ৭ জুন বনভূমিটি বন আইনের ২৭ ধারা অনুযায়ী ডি-রিজার্ভ ঘোষণা করে বাফুফের টেকনিক্যাল সেন্টার নির্মাণের লক্ষ্যে সাংঘর্ষিক শর্তে বরাদ্দ দেয়।
বন আইনের ২৭ ধারায় সংরক্ষিত বনাঞ্চল সংরক্ষণ থেকে অবমুক্ত (de-reserve) করার ক্ষমতা সরকারকে দেওয়া হলেও বন বিরুদ্ধ (deforest) ব্যবহারে বরাদ্দ দেওয়া ক্ষমতা দেওয়া হয়নি বলে জানান বক্তারা। তারা বলেন, দেশের বনভূমি সংবিধান, আইন, নীতি, আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে চলছে বন উজাড়ের ধ্বংসযজ্ঞ। বাফুফের টেকনিক্যাল সেন্টার নির্মাণের জন্য সংরক্ষিত বন বরাদ্দেও আইন মানা হয়নি।
পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বাফুফের টেকনিক্যাল সেন্টার নির্মাণে সংরক্ষিত বনের পরিবর্তে দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্দোবস্তযোগ্য পতিত জমি ও অকৃষি খাস জমি ব্যবহারের পরামর্শ দেয়। সংগঠনগুলো বলছে, কেবল চট্টগ্রাম জেলাতেই বন্দোবস্তযোগ্য অকৃষি খাস জমির পরিমাণ ১০ লাখ ৮ হাজার ৭৬৮ একর। আবার কক্সবাজারে মোট খাস জমির পরিমাণ ৬৮ হাজার একর। অবশ্য এর মধ্যে অবৈধ দখলে রয়েছে ১২ হাজার একর। অবৈধ দখলে থাকা এসব খাস জমি উদ্ধার না করে সংরক্ষিত বনভূমি অবমুক্ত করে তা বরাদ্দ দেওয়া অসংবেদনশীল, স্বেচ্ছাচারিতামূলক ও অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করছে সংগঠনগুলো।
বনভূমি রক্ষার বিষয়টি ফুটবলের বৈশ্বিক সংগঠন ফিফার কাছে তুলে ধরা হবে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে বেলা’র প্রধান নির্বাহী পরিবেশ আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, তারা দেশের কর্তৃপক্ষের কাছেই বিষয়টি তুলে ধরছেন। দেশে সমাধান না হলে ভবিষ্যতে ফিফায় যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
বক্তারা বলেন, রাষ্ট্রের বিভিন্ন আইন ও নীতিতে বন সংরক্ষণকে গুরুত্ব দেওয়া হলেও দেশে বন উজাড়ের গড় হার ২ দশমিক ৬০ শতাংশ, যা বৈশ্বিক বন উজাড়ের গড় হারের (১ দশমিক ৩০ শতাংশ) দ্বিগুণ। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে প্রায় ১ লাখ ৬ হাজার একরের বেশি বনভূমি ভিন্ন উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেওয়া হয়েছে। স্বার্থান্বেষীদের আগ্রাসন থেকে কোনো আইন ও প্রতিশ্রুতিই দেশের সীমিত বন ও বনভূমিকে রক্ষা করতে পারছে না।
অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি), ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), নিজেরা করি, গ্রিন কক্সবাজার, ইয়ুথ এনভায়রমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস), কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলন ও সেইভ দ্য কক্সবাজারের উদ্যোগে সংবাদ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। এসব সংগঠনের প্রতিনিধি ছাড়াও এসময় উপস্থিত ছিলেন স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনসহ অন্য পরিবেশ অধিকারকর্মীরা।
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর