এবার আবাসিকেও গ্যাস সংকট
২২ জুলাই ২০২২ ১৪:৩৯
ঢাকা: বিদ্যুতের পর এবার গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে আবাসিক পর্যায়ে গ্যাস সংকটের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, কোনো কোনো এলাকায় দিনে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা গ্যাস থাকছে না। আবার কোনো কোনো এলাকায় রাতে গ্যাস চলে যাচ্ছে। আবার অনেকে জানিয়েছেন, গ্যাসের চাপ কমের কথা।
এদিকে গ্যাস সংকটের কারণে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কবে নাগাদ ওই কারখানা চালু করা যাবে এ নিয়ে এখনো কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। জ্বালানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সূত্রে জানা গেছে, জ্বালানির মজুতও কমের দিকে। ফলে তেল, গ্যাস উভয় দিকেই ঘাটতি বাড়ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এই সংকট কাটাতে পরিত্যাক্ত গ্যাসফিল্ডে ফের অনুসন্ধানের পাশাপাশি আবিষ্কৃত হয়ে থাকা গ্যাসফিল্ড থেকে দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্যাস উত্তোলন শুরুর পরামর্শ দিয়েছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
দেশে দুটি রাষ্ট্রায়াত্ত প্রতিষ্ঠান জ্বালানি সরবরাহ করে থাকে। এরমধ্যে তেল সরবরাহ করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন-বিপিসি। আর গ্যাস সরবরাহের দায়িত্ব খনিজ, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধান, উত্তোলন, পরিশোধন এবং বাজারজাত করা প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলার। পেট্রোবাংলার উৎপাদন, বণ্টন ও সরবরাহ তথ্য বলছে, দেশে দৈনিক চাহিদা ৩৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। চাহিদার বিপরীতে দেশে দৈনিক ২৭৫৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে। এরমধ্যে দেশীয় উৎপাদন ১৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট। বাকি গ্যাস আসে আমদানি থেকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে ঘাটতি ৫০০ থেকে সাড়ে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। এ প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান নাজমুল আহসানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, গ্যাসের ঘাটতি প্রতিদিনই ওঠানামা করছে। কারণ গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে আমরা খোলাবাজার থেকে যে লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস বা এলএনজি আমদানি করে থাকি, তা এখন বন্ধ রয়েছে। যে কারণে গ্যাস সরবরাহে টান পড়েছে।
তিতাস সূত্রে জানা গেছে, তাদের দৈনিক চাহিদা ১৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট। সেখানে মিলছে ১৬২৬ মিলিয়ন ঘনফুট। এ প্রসঙ্গে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশীদ মোল্লাহ জানান, চাহিদার তুলনায় গ্যাস কিছুটা কম পাওয়ার কারণে আবাসিকে খানিকটা সংকট দেখা দিয়েছে।
তিনি বলেন, বিদ্যুতের লোডশেডিং আবার সিএনজিতে রেশনিং হচ্ছে। তারপরেও কিছু ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
এদিকে গত সোমবার থেকে রাজধানীর মধ্যবাড্ডা, উত্তর বাড্ডা, বাসাবো, নন্দীপাড়া, বৌদ্ধমন্দির, মান্ডা, মুগধা, যাত্রাবাড়ি, মানিকনগর ওদিকে রামপুরা, বনশ্রীর কিছু এলাকা মগবাজার, কাজিপাড়া, মিরপুরের কিছু অংশ থেকে গ্যাসের সংকটের খবর পাওয়া যাচ্ছে। মিরপুর ১৪ নম্বরের বাসিন্দা ফখরুল ইসলাম সারাবাংলাকে জানিয়েছেন প্রথমে লোডশেডিং এখন গ্যাসও থাকছে না। কারেন্ট গিয়ে অন্তত দুই ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসে। কিন্তু গ্যাস পাঁচ ঘণ্টায়ও আসে না। বাসাবো এলাকার বাসিন্দা দীপক দাস জানান, গত কয়েকদিন ধরে দুই দিন ধরে দিনের বেলা গ্যাস থাকে না। রাতে গ্যাস আসলেও মধ্যরাত পর্যন্ত চাপ কম থাকে।
এদিকে কমেছে তেলভিত্তিক জ্বালানির আমদানিও। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন-বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, এখন যে পরিমান জ্বালানি তেল মজুত আছে তা দিয়ে ৩৫ থেকে ৪০ দিনের মতো চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধিতে ডিজেল আমদানি অনেক আগে থেকেই বন্ধ রয়েছে। আবার ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় জ্বালানি আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না। যে কারণে আমদানিতে কিছুটা দীর্ঘসূত্রতা দেখা দিয়েছে।
বিপিসি সূত্র বলছে, মূলত ৩০ থেকে ৪০ দিনের চিন্তা করেই জ্বালানি আমদানি করা হয়। কারণ এর বেশি মজুত রাখার সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। তবে সংকট কেটে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বিপিসির তথ্যানুযায়ী, জ্বালানি তেল ব্যবহারে বিশ্বের বাংলাদেশের অবস্থান ৭৪তম। সবশেষ গেল বছর জ্বালানি ব্যবহারের হিসাব অনুযায়ী, বার্ষিক চাহিদা ছিল ৬৫ লাখ ৯৫ হাজার টন। সেই হিসেবে দৈনিক জ্বালানি চাহিদা ১৮ হাজার ৬৮ টন। এই সার্বিক চাহিদার মধ্যে দেশীয় উৎস থেকে পাওয়া যোগান দিয়ে চলে এক মাসেরও কম।
এই পরিস্থিতিতে সরকারকে স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম সারাবাংলাকে বলেন, জ্বালানির এই যে সংকট পরিস্থিতি দেখা দেবে তা সরকার বা পেট্রোবাংলা জানতো। আমরা বারবার বলেছি নিজস্ব উৎসে অনুসন্ধানের জন্য। কিন্তু তাতে কান না দিয়ে সরকার গেল চড়া দামে এলএনজি আমদানিতে। এতে সমস্যা হলো আপনার বাজারতো সবসময় এক রকম থাকবে না। এখন যেমন অনেক বেশি ঊর্ধ্বগতি, যে কারণে আমাদের কেনার সামর্থ্য নেই। সেজন্যই নিজস্ব উৎসে জোর দিতে বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, সরকার এখন বলছে সেপ্টেম্বরে এই সংকট কেটে যাবে। আমি মনে করি এই সংকট দূর হতে এ বছর চলে যাবে। কারণ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পুরোপুরি চালু না হলে এই সংকট দূর হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাতে হয়তো ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে তাৎক্ষণিক উদ্যোগ হিসেবে যেসকল গ্যাসফিল্ড পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে সেগুলোতে আবার অনুসন্ধান চালানো যায়। কারণ অনেক সময় পুরনো কূপ থেকেও গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অন্যদিকে যেসকল গ্যাসফিল্ড আবিষ্কৃত হয়ে আছে, সেগুলোতে দ্রুত উত্তোলনে যাওয়া। কারণ নতুন করে গ্যাসফিল্ড অনুসন্ধান সময় সাপেক্ষ বিষয়।
উল্লেখ্য, বিশ্বজুড়ে মোট দুই ধরনের জ্বালানির ব্যবহার হয়ে থাকে। তেলভিত্তিক ও গ্যাসভিত্তিক। তেলভিত্তিক জ্বালানির মধ্যে রয়েছে ডিজেল, অকটেন, ফার্নেস অয়েল, পেট্রোল, কেরোসিন ও জেট ফুয়েল। আর গ্যাসভিত্তিক জ্বালানিতে রয়েছে প্রাকৃতিক ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক-এলএনজি। বাংলাদেশ এর কোনোটিতেই স্বয়ংসম্পূর্ণ না। বাংলাদেশে যে পরিমান জ্বালানি ব্যবহৃত হয় তার ৯৩ শতাংশই আমদানি করতে হয়। আর আমদানি করা জ্বালানির ১০ ভাগ ব্যবহার করা হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। বাকি ৯০ ভাগ যানবাহনে। জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে দিনে এক ঘণ্টা করে রেশনিং করছে সরকার।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সেক্ষেত্রে জ্বালানির মূল্য সমন্বয়েরও আভাস দিয়েছেন তিনি।
সারাবাংলা/জেআর/এএম