৬২ বছর বয়সে স্নাতকোত্তর পাস করলেন আরেফা
২৪ জুলাই ২০২২ ১৯:১২
ঠাকুরগাঁও: জেলার পৌরশহরে সবার মুখে মুখে আলোচনায় আরেফা হোসেন। ৬২ বছর বয়সে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে এলাকাবাসীকে তাক লাগিয় দিয়েছেন এই নারী। তার এই অর্জনে সন্তান, আত্মীয়-স্বজনসহ খুশি এলাকাবাসীও। কিন্তু জীবনের এই পথ এতো মসৃণ ছিলনা তার। এজন্য অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে অনাথ আশ্রমে বড় হওয়া আরেফাকে।
মাত্র চার বছর বয়সে মাকে হারান আরেফা। আর আট বছর বয়সে হারান বাবাকে। পাঁচ বোনের মধ্যে আরেফা ছিল তৃতীয়। অভিভাবক হিসেবে ছিলেন একমাত্র বড় বোন। তিনিও হন যুক্ত হয় বিয়োগের খাতায়। অল্প বয়সে বড় বোনের বিয়ে হয়ে যায়। পরে তিন বোনসহ তার আশ্রয় হয় একটি অনাথ আশ্রমে। সেখান থেকে ভর্তি হন মিশনারি স্কুলে। মাধ্যমিকে পড়াশোনা করার সময় বাংলা একটি সিনেমা দেখেন তিনি। ওই সিনেমায় এক এতিম মেয়েকে স্বেচ্ছায় মানুষকে সেবা দিতে দেখেন তিনি। সেই থেকে স্বপ্ন দেখেন সেবিকা হবেন।
ওই কারণে ১৯৭৬ সালে মাধ্যমিক পাস করে রাজশাহীর খ্রিস্টিয়ান মিশন হাসপাতালে ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারিতে ভর্তি হোন আরেফা। সেখান থেকে ১৯৮১ সালে পড়াশুনা শেষ করে ১৯৮২ সালের ৬ জুন ঠাকুরগাঁও মহকুমা হাসপাতালে (বর্তমানে ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল) নার্স হিসেবে যোগদান করেন তিনি।
চাকরির দুই বছর পরেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হোন আরেফা। বছর না যেতেই কোলজুড়ে আসে সন্তান। ফলে দায়িত্ব বাড়ায় কমে গেল সময়। একদিকে সংসারের ব্যস্ততা অন্যদিকে চাকরি। এগুলো বাদ দিয়ে আলাদা কোনো বিষয়ে মনোনিবেশ হওয়ার সুযোগ ছিল না তার। তবে মনে তার সুপ্ত বাসনা তাড়া করত উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার। সন্তানরা বড় হওয়ার পর সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে আবার শুরু করেন পড়াশুনা।
বিএসসি করার জন্য ভর্তি হোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত মহাখালী সেবা মহাবিদ্যালয়ে। সেখান থেকে স্নাতক শেষ করে ক্ষান্ত হননি তিনি, বরং চাহিদা বেড়েছে আরও উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার। চলতি বছরের ১৭ জুন অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন তিনি। ৬২ বছর বয়সে উচ্চ শিক্ষার সনদ অর্জন করলেন তিনি। আরেফার এই অর্জনে সাড়া পড়েছে ঠাকুরগাঁও জেলার শিক্ষার্থীদের মাঝে।
তিন বছর আগে জীবনসঙ্গী (স্বামী) হারন আরেফা। স্বামী দীর্ঘদিন বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, পরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। বর্তমানে দুই ছেলে সন্তান নিয়ে তার পরিবার।
ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালে ৩৮ বছরের চাকরিজীবন শেষ করে বর্তমানে ঠাকুরগাঁও নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত আছেন আরেফা হোসেন। একদিকে বয়সের ভার, অন্যদিকে পরিবার ও কর্মস্থলের ব্যস্তময় জীবন। এই বয়সে পড়াশোনা যেন আকাশকুসুম কল্পনার বিষয়। তবুও সব বাধা ডিঙিয়ে উচ্চ শিক্ষার সনদ পেয়ে আত্মতৃপ্তি পেয়েছেন এই নারী।
এ বিষয়ে আরেফা হোসেন বলেন, ‘আমার জন্ম নওগাঁ জেলায়। সেখানেই আমাদের বাড়ি ছিল। আমরা পাচঁ বোন ছিলাম। ছোট বেলায় মা-বাবা মারা যায়। বড় বোন আমাদের দেখাশুনা করতেন। কিছুদিন পরে বড় বোনের বিয়ে হয়ে যায়। তখন আমাদের দেখাশোনা করার মতো কেউ ছিল না। আমিসহ আমার আরও তিন বোন সেখানকার এক অনাথ আশ্রমে থাকা শুরু করি। সেই অনাথ আশ্রমেই সময়টা কেটেছে।’
তিনি বলেন, ‘এতিম হওয়ায় এর বাইরে আলাদাভাবে জীবন কাটানোর কোনো সুযোগ হয়ে ওঠেনি। ছোটবেলা থেকে সবার মনে বড় হয়ে কিছু হওয়ার ইচ্ছে থাকে। তবে আমার স্বপ্ন বা ইচ্ছেটা ছিল একটু অন্যরকম। যেহেতু মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করেছি, সেখানেই থেকেছি। আমি একটি বাংলা সিনেমা দেখেছিলাম। সিনেমায় এক বাবা-মা হারানো মেয়ে মানুষকে সেবা দিচ্ছেন। সেই চরিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমিও মনে মনে ভেবেছিলাম- আমিও মানুষের সেবা করব। সেবিকা হিসেবে আমিও মানুষের পাশে থাকব। তারপরে নার্সিং কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শেষ করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার। কিন্তু চাকরির পরে বিয়ে তারপর সন্তান হয়ে যায়। মনে হয়েছিল হয়তো আর উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারব না। তবে আমার জীবনসঙ্গী সব সময় আমার শক্তির জোগান দিয়েছেন। তার অনুপ্রেরণায় আমি উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। তিনি আমাকে বলেছিলেন উচ্চ শিক্ষার যেহেতু সুযোগ আছে তুমি ভর্তি হয়ে যাও।’
‘আমি এ বয়সে মাস্টার্স করেছি আমার স্বামীর অনুপ্রেরণায়। যদিও তিনি জানেন আমি মাস্টার্স করছি, কিন্তু আমার সফলতা তিনি দেখে যেতে পারেননি। ২০১৯ সালে মারা গেছেন তিনি। আর আমি এ বছরে মাস্টার্স শেষ করে সনদ পেলাম। আসলে জীবন মানে সংগ্রাম। কথায় আছে যে রাধে, সে চুলও বাঁধে। আমার বড় ছেলে বলে- আম্মু তুমি আর আমি একসঙ্গে পিএইচডি করব। তারা অনেক খুশি হয়েছে’- বলেন আরেফা হোসেন।
নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থী সানিয়া আক্তার বলেন, ‘আমাদের কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে ম্যাম চাকরি করছেন। অনেক সুন্দর করে তিনি আমাদের ক্লাসে পাঠদান করান। ওনার ক্লাসে মনোযোগ থাকলে আলাদাভাবে বাড়তি পড়াশোনার প্রয়োজন হয় না। আর উনি আমাদের অনুপ্রেরণা। এত বছর বয়সে যদি ম্যাম উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। তাহলে আমরাও পারব। আমরা সকলে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি ম্যামের সফলতা দেখে।’
আরেফা হোসেনের ছোট ছেলে আদিব হোসেন বলেন, ‘আম্মুর সফলতায় আমরা অনেক খুশি। আমরা সন্তান হিসেবে আম্মুকে নিয়ে গর্ব বোধ করেছি। আমরা মা-ছেলে একসঙ্গে পিএইচডি করব।’
আরেফা হোসেনের নিকট আত্মীয় আব্দুস সামাদ বলেন, ‘উনি খুবই পরিশ্রমী এবং সংগ্রামী একজন নারী। তিনি পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থায় নারী হয়ে প্রমাণ করেছেন, নারীরাও মানুষ, নারীরাও পারে।’
ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘তিনি (আরেফা) প্রমাণ করে দিয়েছেন বয়স একটি সংখ্যা মাত্র। যদি স্বপ্ন দেখা যায় আর পরিশ্রম করা হয় তবে সফল হওয়া সম্ভব। আমি তার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি। তিনি যেন তার অর্জিত শিক্ষা নতুন প্রজন্মের কাছে বিলিয়ে দিতে পারেন।’
সারাবাংলা/এনএস