বদলি ঠেকিয়ে এক চেয়ারে ৭ বছর, চান না পদোন্নতিও
২৫ জুলাই ২০২২ ২০:৪৬
ঢাকা: ব্যাচমেটরা অনেক আগেই নির্বাহী প্রকৌশলী থেকে পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হয়েছেন। কিন্তু মো. ইলিয়াস আহমেদ পদোন্নতি পাননি। তিনি নির্বাহী প্রকৌশলী পদে থাকতেই বেশি পছন্দ করেন। ব্যক্তিগতভাবে চান না বলেই মূলত তার পদোন্নতি হয়নি। এমনকি তিনি নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে যে আজিমপুর জোনে রয়েছেন, সেখান থেকেও বদলি হতে চান না অন্য কোথাও।
তিনি গণপূর্ত বিভাগের ঢাকার আজিমপুর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইলিয়াস আহমেদ। গত সাত বছর ধরে তিনি এই পদে চাকরি করছেন। এই জোনে তার অধীনে গত বছর প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার কাজ হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, সেই কাজ করতে গিয়ে ঠিকাদারদের কাছ থেকে ঘোষণা দিয়ে তিনি ১৫ শতাংশ হারে ঘুষ খেয়েছেন। নতুন অর্থবছরে আরও ৭০০ কোটি টাকার কাজ হওয়ার কথা রয়েছে। এসব কাজও ঘুষের বিনিময়ে করাবেন বলেই তিনি আজিমপুর জোন থেকে অন্য কোথাও বদলি হতে চান না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
অভিযোগ রয়েছে, নির্বাহী প্রকৌশলী ইলিয়াস আহমেদ ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম, ঘুষ বাণিজ্য ও ঠিকাদারদের হয়রানি করছেন। পছন্দের ঠিকাদার ছাড়া তিনি কাউকে কাজ দেন না। এ নিয়ে একজন বেশ ঠিকাদার গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী বরাবর অভিযোগও দিয়েছেন। এরকম অভিযোগের কপিসহ বেশকিছু সংশ্লিষ্ট নথি সারাবাংলার হাতে এসেছে।
এদিকে, অভিযোগ দায়েরের পর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইলিয়াস আহমেদ অভিযোগকারী ঠিকাদারদের ‘পেছনে লেগেছেন’ বলে জানা গেছে। একাধিক সূত্র বলছে, অধস্তন কর্মকর্তাদের দিয়ে তিনি একজন ঠিকাদারকে ডেকে পাঠান। তাকে বিভিন্ন ধরনের হুমকি দেন। এমনকি গণপূর্তে তার প্রতিষ্ঠানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করারও হুমকি দেওয়া হয়। পরে ওই ঠিকাদার প্রধান প্রকৌশলী বরাবর ফের অভিযোগ করেন। সেই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি এখনো ওই ঠিকাদারকে ডাকেননি।
অভিযোগকারী ঠিকাদার পল্টু দাস সারাবাংলাকে বলেন, দুর্নীতি করে ‘রাঘব বোয়াল’ হয়েছে ইলিয়াস আহমেদ। নিজ হাতে ঘুষ নিয়েছেন তিনি। এর বাইরে কোনোভাবেই তিনি বিল দিতে রাজি হননি। পরে আরও ঘুষ দাবি করলে আমি রাজি হইনি। এজন্য তিনি বিল কম দিয়েছেন। অথচ পুরো কাজই শেষ করতে হয়েছে আমাকে।
তদন্ত কমিটিতে তাকে ডাকা হয়েছিল কি না— জানতে চাইলে পল্টু দাস বলেন, তদন্ত কমিটি হয়েছে বলে জেনেছি। একটি চিঠিও পেয়েছি। তবে এখনো ডাকেনি আমাকে।
তদন্ত কমিটির বিষয়ে জানতে চাইলে গণপূর্ত বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (সংস্থাপন) নন্দিতা রাণী সাহা সারাবাংলাকে বলেন, ঠিকাদার পল্টু দাসকে নানাভাবে নাজেহাল করার অভিযোগে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অভিযোগে নির্বাহী প্রকৌশলী ইলিয়াস আহমদকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি কাজ করছে।
ঠিকাদারের অভিযোগ, ইলিয়াস আহমেদের হাত অনেক বড়। তিনি প্রকাশ্যেই বলে বেড়ান, অনেক টাকা খরচ করে ওই পদে টিকে আছেন তিনি। সহজেই তাকে সরানো যাবে না। এজন্য তিনি যেভাবে চান, সেভাবেই কাজ করেন। কেবল ঠিকাদাররাই নন, ইলিয়াস আহমেদের বিষয়ে গণপূর্তের একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও অনিয়ম, দুর্নীতি আর ঘুষ বাণিজ্যের তথ্য দিয়েছেন।
জানা গেছে, অভিযোগ দেওয়ার পর ইলিয়াস আহমেদ বেশকিছু প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্তির হুমকি দিয়েছেন। কোনো কোনো ঠিকাদারকে ডেকে সামান্য ঘুষ নিয়ে আবার অনেকের কাছে ঘুষ ছাড়াই বিল পরিশোধ করেছেন। এরপর তিনি বলেন, তার চেয়ারের ছয়টি পা। দুই পা তার এবং চার পা চেয়ারের। তাই ছয় পা যে চেয়ারের রয়েছে, সেই চেয়ারকে সহজে কেউ নাড়াতে পারেন না।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স এমএ আলী এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী পল্টু গত ২৯ মার্চ ইলিয়াস আহমেদের বিরুদ্ধে গণপূর্ত অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী বরাবর ডাকযোগে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগে তিনি বলেন, ই-জিপি টেন্ডারে আজিমপুর বিভাগে একটি কাজ পাই। নির্বাহী প্রকৌশলী ইলিয়াস আহমেদ আমাকে ডেকে দুই লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। দাবি করা টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে কাজ শেষে বিল দাখিলের পর আবারও মোট বিলের ১০ শতাংশ টাকা দাবি করেন ইলিয়াস। বিল পাওয়া নিয়ে ঝামেলা হবে ভেবে বাধ্য হয়ে প্রকৌশলী ইলিয়াসকে ৫৫ হাজার টাকা ঘুষ দেই।
অভিযোগে আরও বলা হয়, চাহিদামতো ঘুষ না দেওয়ায় প্রায় দুই বছর ঘুরিয়ে একাধিক কিস্তিতে আমাকে বিল দেওয়া হয়েছে। এমনকি টেন্ডারে কাজ পাওয়ার সময় জামানত হিসেবে দেওয়া ১ লাখ ১৬ হাজার ৫শ টাকার চেক ইস্যু হওয়ার পরও অনেক ঘুরিয়ে আমাকে চেক দেওয়া হয়। সামান্য ১১ লাখ টাকার কাজের বিলের জন্য প্রকৌশলী ইলিয়াস আমাকে নানাভাবে হয়রানি করেছেন এবং ক্ষতি করেছেন। আমি এমন স্বৈরাচারি এবং সাধারণ ঠিকাদারদের জন্য ক্ষতিকর চরিত্রের প্রকৌশলীর বিচার দাবি করছি।
পল্টু অভিযোগ করে সারাবাংলাকে বলেন, প্রকৌশলী ইলিয়াস ব্যাপক অদৃশ্য ক্ষমতার অধিকারী। গণপূর্তে এমন কোনো ঠিকাদার পাবেন না যিনি একই চেয়ারে ৬/৭ বছর ধরে আছেন।
গণপূর্ত অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ইলিয়াস আহমেদ কীভাবে এত সময় ধরে আজিমপুর জোনের দায়িত্বে আছেন, তা এ দফতরের সবার কাছেই বিশেষ কৌতূহলের বিষয়। গণপূর্তে এমন নজির খুব কমই আছে। অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী পদে থাকা কর্মকর্তাও তার সঙ্গে বা তার বিষয়ে হিসাব করে কথা বলেন।
এর আগে পল্টু বেশ কয়েকবার ইলিয়াস আহমেদের বিষয়ে অভিযোগ করলেও সেই অভিযোগপত্র গায়েব হয়ে যায়। ভুক্তভোগী ঠিকাদাররা আরও বলছেন, অভিযোগ করলে প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করেন নির্বাহী প্রকৌশলী, যেন পরে কেউ আর অভিযোগ করার সাহস না পায়।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইলিয়াস আহমেদের মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে এসএমএস করে অভিযোগ সম্পর্কে বক্তব্য জানতে চাইলেও কোনো উত্তর দেননি তিনি।
ইলিয়াস আহমেদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে গণপূর্ত অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতারের মোবাইল নম্বরে কল করা হলে তিনিও কল রিসিভ করেননি। তার স্টাফ অফিসার মাহফুজ আহমেদের সঙ্গে কথা হলেও তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সারাবাংলা/ইউজে/টিআর