বৈমানিকের ভুলে ৫০০ যাত্রীর প্রাণসংশয়, সতর্ক নোটিশে দায়সারা সাজা!
২৭ জুলাই ২০২২ ২২:০৫
ঢাকা: ভ্রমণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে নিরাপদ বাহন হিসেবে ধরা হয় বিমানকে। কিন্তু সেই বিমানের বৈমানিকদের এক সেকেন্ডের ভুলে নিভে যেতে পারে জীবন প্রদীপ। আর এমনই ঘটনা ঘটতে চলেছিল কাতারে। ঘটনাটি ঘটলে প্রাণ যেতে পারতো প্রায় পাঁচ শতাধিক যাত্রীর। বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট এবং কাতার এয়ারওয়েজের একটি বিমানের মধ্যে উড্ডয়নরত অবস্থায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল। কিন্তু ট্রাফিক কলিশন এভোয়েডেন্স সিস্টেমের কারণে দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পায় বিমান দুটি।
সারাবাংলার অনুসন্ধান বলছে, ঘটনাটি চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি। কাতারের হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে স্থানীয় সময় রাত ২টার পর ঢাকার উদ্দেশে রওনা করে বাংলাদেশ বিমানের বিজি১২৬ (বোয়িং ৭৩৭) ফ্লাইটটি। বিমানটি উড্ডয়নের আগে বিজি ফ্লাইটটি হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এ৭ পার্কিং এরিয়াতে পার্ক করা ছিল। বিমানটিতে বৈমানিক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন নেওয়াজ এবং ফাস্ট অফিসার হিসেবে ছিলেন তাহসিন। বিমানের নেভিগেশন যন্ত্র এফএমসি (ফ্লাইট ম্যানেজমেন্ট কম্পিউটার) সেটাপ করার জন্য উড্ডয়নের যে নির্দেশমালা এটিসি (এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল) থেকে দেওয়া হয় সেটি ছিল রানওয়ে ১৬এল (লেফট)। কিন্তু বৈমানিকরা ভুল উড্ডয়নের নির্দেশনা সেটাপ করে বিমানে। তারা যে উড্ডয়ন নির্দেশনাটি সেটাপ করে সেটি ছিল রানওয়ে ১৬আর(রাইট) এর জন্য প্রয়োজ্য। এক পর্যায়ে বৈমানিকরা নিজেদের সেটাপ করা নির্দেশনায় যাত্রা শুরু করে। তবে তারা যে ভুল কমান্ড ব্যবহার করে ফ্লাইটটি উড্ডয়নের জন্য ভুল পথে যাচ্ছে সেটি কোনোভাবেই বুঝতে পারেননি।
এদিকে, বিমানের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে কীভাবে বৈমানিকরা ভুল করেছেন। আর পাঁচ শতাধিক যাত্রীর জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছেন। জানা যায়, বিজি বিমানটি রানওয়ে ১৬এল থেকে উড্ডয়ন শুরু করে। এক পর্যায়ে আকাশে ওঠার পর মুহূর্তে পাশের রানওয়ে থেকে উড্ডয়নরত কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটের সঙ্গে ধাক্কার লাগার উপক্রম হয়। তখন বাংলাদেশ বিমান এবং কাতার এয়ারওয়েজের ওই ফ্লাইটটির মধ্যে দূরত্ব ছিল ২০০ ফিটেরও কম। যেখানে বিমান দু’টির মধ্যে সংঘর্ষ ঘটতে সময় লাগতো এক সেকেন্ডেরও কম। কারণ, দুটি বিমানই উড্ডয়নরত অবস্থায় ছিল। এমনকি দুটি বিমানেরই উড্ডয়ন গতি ছিল তখন প্রতি মিনিটে ২৫০০ ফিটেরও বেশি। পরবর্তী সময়ে ‘ট্রাফিক কলিশন এভোয়েডেন্স সিস্টেম’-এ সংকেত আসার কারণে বাংলাদেশ বিমানের বৈমানিকরা তাদের ভুল বুঝতে পারে। এবং সঙ্গে সঙ্গে বিমানটি অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেলে। ফলে দুটি বিমান সংঘর্ষ থেকে রক্ষা পায়। যেখানে দুটি বিমানে থাকা প্রায় পাঁচ শতাধিক যাত্রীর জীবনও বেঁচে যায়।
তবে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটটি ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণের পর ক্যাপ্টেন নেওয়াজ ভুল উড্ডয়নের বিষয়টি রিপোর্ট না করে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন এবং এড়িয়ে যান। শুধু তাই নয়, এই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিজস্ব বিমান সংস্থা এবং সেই দেশের সিভিল এভিয়েশনকে অবহিত করার বিধান রয়েছে। কিন্তু দুই বৈমানিকই বিষয়টি এড়িয়ে যান, যা বিমানের অপারেশনাল ম্যানুয়াল এবং সেফটি ম্যানুয়াল নিয়মের পরিপন্থী। পরবর্তী সময়ে এই ঘটনাটি কাতার সিভিল এভিয়েশন থেকে বাংলাদেশ বিমানকে অবহিত করে। এরপর বিষয়টি সবার নজরে আসে এবং বাংলাদেশ বিমান কর্তৃপক্ষ প্রায় পাঁচ মাস পর তদন্ত শুরু করে। সেই তদন্তে বৈমানিকদের ত্রুটি, অযোগ্যতা এবং দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি স্পষ্টভাবে উঠে আসে।
বিমানের সেই তদন্তে আরও উঠে আসে- বৈমানিকরা বিমানের ম্যানুয়ালে ভুল তথ্য দিয়েছে, নিয়মের তোয়াক্কা না করে স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে বিপদজনকভাবে বিমান পরিচালনা করেছে। এমনকি বিমান অবতরণের পর ক্যাপ্টেন নেওয়াজ বিমানের রক্ষণাবেক্ষণ লগ বুকে (এফএমসি-ফ্লাইট ম্যানেজমেন্ট কম্পিউটার) একটি ভুল এন্ট্রি দিয়ে বিমানের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগকে দ্বিধাদ্বন্ধে ফেলে দেয়। এছাড়া বিমানটিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত ফাস্ট অফিসারের নিম্নমানের প্রশিক্ষণ এবং প্রয়োজনের তুলনায় কম অভিজ্ঞতার বিষয়টিও উঠে আসে।
জানা যায়, ক্যাপ্টেন নেওয়াজের বড় ভাই জ্যেষ্ঠ বৈমানিক ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ আল মারুফ। সম্প্রতি বিমানের ১৪ বৈমানিক নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা এক বৈমানিকের ভিতরে তিনিও একজন। অপরদিকে, সারাবাংলার অনুসন্ধানে জানা যায়, ফাস্ট অফিসার তাহসিন বিমানের শিডিউল বিভাগের এক ক্যাপ্টেন এবং বোয়িং৭৩৭-এর একজন ক্যাপ্টেনের ছত্রছায়ায় বাংলাদেশ বিমানে আধিপত্য বিস্তার করে থাকেন। এর আগে ফ্লাইট পরিচালনায় কয়েকবার ভুল করলেও কোনো শাস্তি হয়নি এই বৈমানিকের। এমনকি এই ফাস্ট অফিসারের সঙ্গে অনেক বৈমানিক ফ্লাইট পরিচালনায় অপারগতা প্রকাশ করার মতোও ঘটনা ঘটেছে বিমানে।
সারাবাংলার অনুসন্ধানে আরও বের হয়ে এসেছে, যে সময় এই ঘটনা ঘটে তখন রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থাটির চিফ অব সেফটি পদে কেউ দায়িত্বে ছিলেন না। এক কথায় পদটি ফাঁকা ছিল। যা সিভিল এভিয়েশন আইন পরিপন্থী। এমনকি সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ একাধিকবার অডিট করলেও বিমানের চিফ অব সেফটি পদে ওই সময়ে কেউ দায়িত্বে না থাকার বিষয়টি ধরতে পারেনি।
অনুসন্ধান বলছে, কাতারে বাংলাদেশ বিমানের বৈমানিকরা এমন মারাত্মক ভুল করলেও তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শুধু সতর্ক করে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে এই ধরনের ঘটনায় বিশ্বের অনেক এয়ারলাইন্সে বৈমানিকের চাকরি যাওয়ার নজির রয়েছে।
এদিকে, ঘটনার বিষয়ে জানতে ক্যাপ্টেন নেওয়াজ এবং ফাস্ট অফিসার তাহসিনের ব্যক্তিগত ফোন নম্বরে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। অপরদিকে, বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও যাহিদ হোসেনের নম্বরে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। পরে এ বিষয়ে জানতে বিমানের জনসংযোগ কর্মকর্তা তাহেরা খন্দকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি জেনে পরে জানাতে পারব।’
তবে বিমানের সার্বিক ঘটনা নিয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ঘটনাটি শুনে মনে হলো খুবই স্পর্শকাতর। আমি ঘটনাটি জানি না। কী ঘটেছিল আর বৈমানিকদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে- সেটি আমি বিমানের কাছে জানতে চাইব। যাত্রীদের জীবন নিয়ে খেলা করতে দেওয়া হবে না। যদি বৈমানিকের ভুল হয়ে থাকে তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সারাবাংলা/এসজে/পিটিএম
উড্ডয়ন কাতার এয়ারওয়েজ দায়সারা বাংলাদেশ বিমান বৈমানিক ভুল সতর্ক