বেইল আউট নয়, বাজেট সহায়তা দেবে আইএমএফ: মুখ্য সচিব
২৭ জুলাই ২০২২ ১৯:১৫
ঢাকা: ‘বেইল আউট’ বা দেউলিয়া হওয়া থেকে বাঁচতে নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় যে বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে, সেটি মেটাতেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস।
মুখ্য সচিব বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত হয়েছে বলেই আইএমএফর মতো সংস্থাগুলো এখন প্রকল্প সহায়তার পরিবর্তে বাজেট সহায়তা হিসেবে ঋণ দিচ্ছে। আর বাণিজ্য ঘাটতি মেটাতে ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্ট’ হিসেবে আইএমএফের কাছ থেকে এ ধরনের ঋণ নেওয়ার ঘটনাও নতুন নয়। আইএমএফের সঙ্গে সরকারের বৈঠকও নিয়মিত ঘটনার অংশ। আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার বিষয়টিকে ‘বেইল আউট’ থেকে বাঁচার প্রয়াস হিসেবে দেখানোর বিষয়টিকে সামগ্রিকভাবে জাতিগত অপমানের সামিল বলেও মনে করছেন তিনি।
বুধবার (২৭ জুলাই) বিকেলে সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এক ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমেদ কায়কাউস। এসময় আইএমএফের কাছ থেকে বাংলাদেশের ঋণ নেওয়ার বিষয়টির বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করেন।
ড. কায়কাউস বলেন, সম্প্রতি আইএমএফের একটি মিশন বাংলাদেশে এসেছে। অর্থমন্ত্রী তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কিন্তু এটি নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ। প্রতিবছরই তাদের সঙ্গে এমন বৈঠক হয়। বিশ্বব্যাংক, এডিবি (এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক), জাইকার মতো যেসব সংস্থা রয়েছে, তাদের সঙ্গে প্রতিবছর এরকম বৈঠক হয়। এটি একটি রুটিন।
আরও পড়ুন- ‘এখন ঋণ দরকার, তাই আইএমএফের কাছে আবেদন করেছি’
আইএমএফ বিভিন্ন দেশকে যে চার ধরনের ঋণ সহায়তা দেয়, সেগুলোও তুলে ধরেন মুখ্য সচিব। এর মধ্যে রয়েছে এক্সটেন্ডেট ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ), এক্সটেন্টেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইএফএফ), র্যাপিড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (আরসিএফ) ও আরএফআই এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি এবং রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ)। কোনো দেশে রফতানির চেয়ে আমদানি বেশি হলে যে ঘাটতি বা ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্ট’ তৈরি হয়, সেটি শঙ্কাজনক পর্যায়ে গেলে তার মাত্রা অনুযায়ী একেক ধরনের উইন্ডো থেকে ঋণ সহায়তা দেয় আইইএমএফ। এ ক্ষেত্রে জরুরি সংকট মোকাবিলার জন্য দেওয়া হয় তৃতীয় ধরনের ঋণ। আর উন্নয়ন প্রচেষ্টায় সহায়তার জন্য আরএসএফ উইন্ডো থেকে সহায়তা দেয় আইএমএফ।
মুখ্য সচিব আরও জানান, এসব ঋণ মূলত দুইটি উপায়ে দেওয়া হয়— প্রকল্প অর্থায়ন ও বাজেট সহায়তা। বিভিন্ন ধরনের শর্ত দিয়ে কেবল সুনির্দিষ্ট প্রকল্পের জন্যই দেওয়া হয়। অন্যদিকে বাজেট সহায়তার আওতায় কোনো দেশকে কেবল নির্দিষ্ট পরিমাণ ঋণ সহায়তা দেওয়া হয়, যা দেশটি তার প্রয়োজনমতো খরচ করতে পারে। সাধারণত অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত হলে সেসব দেশকে বাজেট সহায়তা হিসেবে ঋণ দেয় আইএমএফ।
মুখ্য সচিব ড. কায়কাউস বলেন, আগে আমরা প্রকল্প অর্থায়ন হিসেবে ঋণ বেশি নিতাম। কিন্তু টেন্ডারিংসহ অন্যান্য বিষয় মিলিয়ে সেটি ছিল দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। কিন্তু এখন বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি এত বেশি মজবুত হয়েছে এবং আমাদের ঋণ পরিশোধের ধারাবাহিকতা এত ভালো হয়েছে যে এখন ওরা আমাদের বাজেট সহায়তা দিচ্ছে। এর সুবিধা হচ্ছে, ঋণের টাকা আমরা স্বাধীনভাবে আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করতে পারব।
তিনি বলেন, সবচেয়ে ভালো দিক হলো— বাজেট সহায়তা পাচ্ছি, এর অর্থ আমাদের ওপর তাদের আস্থা এসেছে। সে কারণেই কোনো প্রশ্ন ছাড়াই তারা আমাদের (ঋণ) দিচ্ছে। আর এই টাকাটা কিন্তু বাজেট সহায়তা হিসেবে চাওয়া হয়েছে। এটি কোনোভাবেই ‘বেইল আউট’ না।
সারাবিশ্বেই অর্থনৈতিকভাবে অচলাবস্থা চলছে জানিয়ে ড. কায়কাউস বলেন, বড় বড় সংস্থাগুলো মন্দার আশঙ্কা চলছে। বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। তাদের অর্থনীতি হোঁচট খাচ্ছে। তাহলে আমরা কি কোনো প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা নেব না? সেই ব্যবস্থা নিতে গিয়েই আমরা তাদের (আইএমএফ) যে সম্ভাব্য উইন্ডোগুলো রয়েছে, সেখান থেকে কীভাবে ঋণ নিতে পারি, সেই প্রস্তাবনা দিয়েছি। একে যেভাবে ‘বেইল আউট’ বলা হচ্ছে, তা নিয়েই আমাদের আপত্তি। বেইল আউট বলা হচ্ছে কেন? দেশ কি এখন গভীর কোনো সংকটে রয়েছে যে বেইল আউট করতে হচ্ছে? আমি খুব দুঃখিত যে ব্লুমবার্গেও ডেইলি স্টারের বরাত দিয়ে খবর পরিবেশন করা হয়েছে। এটি তো গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। এই ঋণকে ‘বেইল আউট’ বলাটা জাতিকে অপমানিত করার সামিল।
তিনি বলেন, গত মাসে আমরা পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেছি, সেটি আমাদের আত্মবিশ্বাসের জায়গা। সেই আত্মবিশ্বাস সমুন্নত না রেখে আমরা কেন নিচের দিকে ঠেলে দিচ্ছি? আমার মনে হয়, আইএমএফর মিশন এখানে আছে। আপনারা (গণমাধ্যমকর্মী) সেখানে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলে যাচাই করুন। তারা কি বাংলাদেশকে সংকটে পতিত অর্থনীতি মনে করে? তারা কি বলেছে যে পাকিস্তান বা শ্রীলংকার মতো অবস্থা হয়েছে বাংলাদেশের? তারা যদি সেরকম মনে করে থাকে, তাহলে আপনি আমার সঙ্গে এসে আবার বচসা করতে পারেন যে আপনি ঠিক বলেননি।
ব্রিফিংয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের তথ্য তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব। তিনি বলেন, আমাদের এখানে রিজার্ভের পরিমাণ নিয়ে অনেকের মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে। আমাদের রিজার্ভ কিছু কমেছে। সাধারণত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর উপযোগী রিজার্ভ থাকলেই মজবুত অর্থনীতি ধরা হয়। কিন্তু আমাদের পাঁচ মাসের বেশি আমদানি ব্যয় নির্বাহের উপযোগী রিজার্ভ আছে। শুধু খাদ্য নয়, পাঁচ মাসের মোট আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় রিজার্ভই আমাদের রয়েছে। ফলে আমাদের সেই অর্থনৈতিক ঝুঁকি নেই।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, যখন আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০/২১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল, তখন মানুষের ধারণা ছিল, এত টাকা দিয়ে কী হবে? এমনকি ২০১৯ সালেও যখন ৩০/৩১ বিলিয়ন রিজার্ভ ছিল, তখনো কিন্তু কারও কোনো চিন্তা ছিল না। এখন সেই রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন পার হওয়ার পর এসে মনে হচ্ছে, একটু এদিক-ওদিক হলেই আর্থিক ভিত্তিটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে! হ্যাঁ, সারাবিশ্বেই বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে। ফলে আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে। ফলে কিছু ঘাটতি তৈরি হয়েছে। সে কারণেই আইএমএফ থেকে ঋণ নিচ্ছি।
বাংলাদেশ আগেও আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়েছে জানিয়ে মুখ্য সচিব বলেন, ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে ৭৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ নিয়েছিল এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটির আওতায়। ওই সময় কি এমন উৎকণ্ঠা ছিল? এরপর ২০০৩ সালেও ৫০৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যালেন্স অব পেমেন্ট সহায়তা নেওয়া হয়েছিল। একইভাবে ২০১২ সালে ৯৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যালেন্স অব পেমেন্ট সহায়তা নেওয়া হয়েছে আইএমএফ থেকে। এমনকি আমরা বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময় ২০২০ সালে র্যাপিড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি ও র্যাপিড ফাইন্যান্সিং ইনস্ট্রুমেন্টের আওতায় ৭৩২ মিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়া হয়েছিল। আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, এডিবি— এসব সংস্থা থেকে আমরা নিয়মিতই ঋণ নিচ্ছি।
সারাবাংলা/এনআর/টিআর
আইএমএফের ঋণ ড. আহমদ কায়কাউস প্রধানমন্ত্রী মুখ্য সচিব বাজেট সহায়তা বেইল আউট