Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে আইন সংশোধন অপরিহার্য

সুশোভন সরকার, নিউজরুম এডিটর
২৯ জুলাই ২০২২ ২৩:১৪

ঢাকা: জনস্বাস্থ্যের জন্য ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার ক্ষতিকর হলেও দেশে এসব পণ্যের ব্যবহার কমছে না। আবার প্রতি বছর বাজেটে সিগারেটের দাম নামমাত্র বাড়লেও কমেনি ব্যবহারকারীর সংখ্যা। বরং দেশের ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সীদের মধ্যেও ৬ দশমিক ৯ শতাংশ কোনো না কোনো তামাক ব্যবহার করে থাকে। অন্যদিকে, এই খাতে অর্থও আগের চেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে। যে ব্যক্তি ১৫ টাকা দিয়ে একটি সিগারেট কিনতেন, তিনি ১৬ টাকা খরচ করেও সেই সিগারেট সেবন করছেন।

বিজ্ঞাপন

চলমান এই পরিস্থিতিতে সরকারের ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা নিয়ে সংশয় জানাচ্ছে তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো। তারা বলছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারি দক্ষিণ এশিয়া স্পিকার্স সম্মেলনের সমাপনী ভাষণে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাক ব্যবহার নির্মূল করার ঘোষণা দেন। কিন্তু তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে বিদ্যমান আইন সংশোধনের কোনো বিকল্প নেই।

বাংলাদেশের তামাক ব্যবহার ভয়াবহতা

গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে বাংলাদেশ ২০১৭, গ্লোবাল ইয়ুথ টোব্যাকো সার্ভে বাংলাদেশ ২০১৩, টোব্যাকো অ্যাটলাস ২০২০ এবং বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি ও আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি রিসার্চের প্রতিবেদনগুলোতে দেশে তামাক ব্যবহারে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনগুলোর তথ্য বলছে— দেশে ১৫ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সী ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ তামাক ব্যবহার করেন। এই বয়সী পুরুষদের মধ্যে তামাক সেবনের হার ৪৬ শতাংশ, নারীদের মধ্যে ২৫ দশমিক ২ শতাংশ। অন্যদিকে ১৮ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ধূমপান (সিগারেট, বিড়ি) করেন এবং ২০ দশমিক ৬ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ধোঁয়াবিহিন তামাক (জর্দা, গুল, সাদাপাতা ইত্যাদি) ব্যবহার করেন।

এদিকে, ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সী অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ কোনো না কোনো ধরনের তামাক ব্যবহার করেন। এই বয়সী ছেলেদের মধ্যে তামাক সেবনের হার ৯ দশমিক ২ শতাংশ, মেয়েদের মধ্যে ২ দশমিক ৮ শতাংশ। অন্যদিকে, এই বয়সী ৪ শতাংশ ছেলে ও ১ দশমিক ১ শতাংশ মেয়ে ধূমপান করে। আর ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারী এই বয়সীদের সংখ্যা ছেলেদের মধ্যে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ ও মেয়েদের মধ্যে ২ শতাংশ।

বিজ্ঞাপন

প্রতিবেদনগুলোতে আরও বলা হয়— প্রায় ৩ কোটি ৮৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। প্রাপ্তবয়স্কদের ৪২ দশমিক ৭ শতাংশ আচ্ছাদিত কর্মক্ষেত্রে, ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশ রেস্তোরাঁয় এবং ৪৪ শতাংশ গণপরিবহনে এমন পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। অপ্রাপ্তবয়স্কদের (১৩-১৫ বছর) মধ্যে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার ৫৯ শতাংশ।

তামাকের স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়— তামাকের কারণে ২০২০ সালে বাংলাদেশে প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত এবং ৬১ হাজারেরও বেশি শিশু (১৫ বছরের নিচে) পরোক্ষ ধূমপানের কারণে সৃষ্ট রোগে ভুগছে।

তামাকের অর্থনৈতিক ক্ষতিও তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনগুলোতে। বলা হয়েছে— ২০১৮ সালে বাংলাদেশে তামাকজনিত মৃত্যু ও অসুস্থতার কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, যা ওই বছরের জিডিপির ১ দশমিক ৪ শতাংশ। তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা বাবদ প্রত্যক্ষ ব্যয় আট হাজার চারশ কোটি টাকা এবং তামাক ব্যবহারের ফলে অকালমৃত্যু ও পঙ্গুত্বের কারণে উৎপাদনশীলতা হারানোর ক্ষতি ২২ হাজার ১৭০ কোটি টাকা।

কুমুদিনী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রঞ্জন কুমার মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘যেসব বস্তুর ব্যবহার বাদ দিলে অকালমৃত্যুর ঝুঁকি কমানো যায়, তার মধ্যে তামাকের অবস্থান শীর্ষে। যত মানুষ তামাক ব্যবহার করে, তার প্রায় অর্ধেকই এর ক্ষতিকর প্রভাবে মৃত্যুবরণ করে।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব বলছে, প্রতিবছর সারাবিশ্বে প্রায় ৬০ লাখ লোক তামাকের ক্ষতিকারক প্রভাবে মারা যায়, যারা পরোক্ষভাবে ধূমপানের শিকার। এই সংখ্যা মোট মৃত্যুর প্রায় ১০ শতাংশ। আজ আমাদের এই একবিংশ শতাব্দীতে তামাক প্রায় ১০ কোটি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) সেন্টারও এটাকে সারাবিশ্বের অকালমৃত্যুর প্রধান কারণ হিসাবে বর্ণনা করেছে।

তামাকের শারীরিক ক্ষতির দিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তামাক মূলত হৃদপিণ্ড, লিভার ও ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। ধূমপানের ফলে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি), এমফাইসিমা, ক্রনিক ব্রংকাইটিসসহ ক্যানাসারের ঝুঁকি বাড়ায় বহুগুণ। তামাক উচ্চ রক্তচাপ ও প্রান্তীয় নালীর রোগেরও কারণ হতে পারে। গর্ভবতী নারীদের ওপর তামাকের ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। ধূমপায়ী নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভপাত ঘটার হার বেশি।’

ডা. রঞ্জন কুমার মজুমদার আরও বলেন, ‘প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কারণে প্রকৃতি দূষিত হচ্ছে। বিশুদ্ধ বাতাস পাওয়া যায় না বললেই হয়। এর মধ্যে ধূমপান হচ্ছে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। মানুষের জীবন বাঁচাতে এবং সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের জন্য তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ খুব জরুরি।’

ধূমপান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন এর দুর্বলতা

দেশকে তামাকমুক্ত করতে ২০০৫ সালে প্রথম ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন প্রণয়ন করা হয়। পরে ২০১৩ সালে আইনটি সংশোধন করা হয়। এই আইনে ধূমপান ও তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে নানা ধরনের বিধান থাকলেও সেগুলো যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমনকি বিদ্যমান আইনের প্রয়োগ না থাকাকেও তারা দেশের তামাক সেবন পরিস্থিতির করুণ দশার কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন।

বর্তমানে এই আইনের ৪ নম্বর ধারায় উল্লেখ করা আছে, ধারা ৭-এর বিধানসাপেক্ষে কোনো ব্যক্তি কোনো পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপান করতে পারবেন না। ধারা ৭-এ বলা হয়েছে কোনো পাবলিক প্লেসের মালিক, তত্ত্বাবধায়ক, নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি বা ব্যবস্থাপক সেই জায়গায় এবং পাবলিক পরিবহনের মালিক, তত্ত্বাবধায়ক, নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি বা ব্যবস্থাপক সেই জায়গায় ধূমপানের জন্য স্থান চিহ্নিত বা নির্দিষ্ট করে দিতে পারবেন।

কয়েক দশকের গবেষণায় দেখা গেছে— পাবলিক প্লেস নির্ধারিত ধূমপান এলাকা জনসাধারণ ও সেখানকার কর্মীদের পরোক্ষ ধূমপান থেকে সুরক্ষা দেয় না। ‘ধূমপান এলাকা’ বা ডিএসএ’তে যত আধুনিক ভেন্টিলেশন পদ্ধতিই ব্যবহার হোক না কেন, তা সেখানকার অধূমপায়ীদের পরোক্ষ ধূমপান থেকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়। কারণ সেখান থেকে ধূমপানের ধোঁয়া কোনো না কোনোভাবে ছড়িয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে রেস্তোরাঁগুলো ডিএসএ’র ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা বদ্ধকক্ষ থেকে ধূমপানের ধোঁয়া অপসারণ করে না এবং সেবা দেওয়ার জন্য কর্মীদের ওই এলাকা/রুমে প্রবেশ করতে হয়।

একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে— যেসব দেশের আইনে পাবলিক প্লেসে ধূমপানের আংশিক সুযোগ রাখা আছে বা ছিল, অর্থাৎ যেসব দেশ ডিএসএ’র জন্য অনুমতি দেয়, সেসব দেশের জনগণের পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হওয়ার হার অনেক বেশি।

একই আইনের ৫ (১) (ছ) ধারায় বলা হয়েছে— তামাকজাত দ্রব্য বিক্রির স্থানে কোনো উপায়েই তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না। এই আইনের ধারার বিষয়ে এফসিটিসির ধারা ১৩-তে বলা হয়েছে— তামাকজাত দ্রব্যের সব ধরনের বিজ্ঞাপনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে তা সবচেয়ে কার্যকর হয়। কিন্তু যদি কয়েক ধরনের সরাসরি বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করা হয়, তখন তামাক কোম্পানিগুলো বিজ্ঞাপনের জন্য বরাদ্দ করা অর্থ তাদের পণ্যের প্রচার ও প্রসারের জন্য, বিশেষ করে তরুণদের আকৃষ্ট করতে বিকল্প উপায়ে ব্যয় করে। সেজন্যই আংশিক নিষেধাজ্ঞার প্রভাব সীমিত হয়ে যায়। বাংলাদেশও একই ধরনের পরিস্থিতির শিকার।

আইনের ৫ (৩) ধারায় বলা হয়েছে— কোনো ব্যক্তি সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির (সিএসআর) অংশ হিসেবে সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করলে বা ওই কর্মকাণ্ড বাবদ ব্যয় করা অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো তামাক বা তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম, সাইন, ট্রেডমার্ক, প্রতীক ব্যবহার করবে না বা করাবে না অথবা সেটি ব্যবহারে অন্য কোনো ব্যক্তিকে উৎসাহ দেবে না। তবে বিভিন্ন খাতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো তামাকপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও সিএসআর কর্মসূচি পরিচালনা করে থাকে। তাদের সিএসআর প্রোগ্রামগুলোর উদ্দেশ্য হলো নিজেদের মৃত্যুব্যবসাকে আড়াল করে সুনাম তৈরি করা, নিজেদেরকে উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে পরিচিতি করানো এবং লবিংয়ের উদ্দেশ্যে সরকারের আরও কাছাকাছি যাওয়া।

বাংলাদেশের পরিস্থিতি বলছে, তামাক কোম্পানিগুলো সিএসআরের নামে নানা প্রতিযোগিতা আয়োজন করে লাখ লাখ তরুণের মধ্যে তামাকপণ্যের প্রচার করে থাকে। এছাড়াও ভিন্ন নামে নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে (যেমন, প্রেরণা ফাউন্ডেশন) বনায়ন, পানি-সরবরাহ, সৌর-বিদ্যুৎ প্রদানের মতো কাজ করে। এমনকি করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে তারা স্বাস্থ্যসুরক্ষা সরঞ্জামও বিতরণ করেছে। এর মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠান নিজেদের ভালো ভাবমূর্তি গড়ে তুলছে, পরোক্ষভাবে বিজ্ঞাপনও প্রচার করে তরুণদের তামাক ব্যবহারে প্ররোচনা দিচ্ছে।

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে আরও বেশি শক্তিশালী করতে অবশ্য এবারের ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে খসড়া সংশোধনী প্রস্তুত করেছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ও জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল। খসড়া সংশোধনীতে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি কয়েকটি ধারা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এসব সংশোধনীর মধ্যে রয়েছে— পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপান এলাকা রাখার বিধান বিলুপ্ত করা; বিক্রয়স্থলে তামাকপণ্য বা প্যাকেট বা মোড়ক দৃষ্টির আড়ালে রাখা; তামাক কোম্পানির নিজে বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সিএসআর কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ বন্ধ করা; ই-সিগারেট, ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম এবং হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টসহ সব ধরনের নতুন তামাকপণ্যের উৎপাদন, আমদানি ও বিক্রি নিষিদ্ধ করা; প্যাকেট, মোড়ক বা কৌটা ছাড়া খুচরা বা খোলা তামাকপণ্য বিক্রি নিষিদ্ধ করা; এবং সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা প্যাকেট, মোড়ক ও কৌটার ন্যূনতম ৯০ শতাংশ পরিমাণ জায়গাজুড়ে মুদ্রণ করা।

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন নিয়ে কাজ করছেন ব্যরিস্টার জুয়েল। তিনি বলেন, ‘দেশের বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি ২০১৩ সালের। এফসিটিসি নামে সারাবিশ্বে একটি কনভেনশন আছে, সেটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার করা। এফসিটিসি কনভেনশন অনুযায়ী ২০১৩ সালে আইনটি হয়। আমরা যারা অ্যান্টি-টোব্যাকো কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত, তারা পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপানের জন্য কোনো এলাকা রাখার বিধান তুলে দিতে কাজ করছি।’

ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানিতে সরকারের ১০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে— এ তথ্য তুলে ধরে ব্যারিস্টার জুয়েল বলেন, ‘তামাকবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত আমরা চাচ্ছি, সরকার যেন সেখানে কোনো শেয়ার না রাখে। এখানে শেয়ার থাকার অর্থই হলো ধূমপান ও তামাকের ব্যবহারকে সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা। অথচ ধূমপান ও তামাক ব্যবহারের কারণে প্রতিবছর শুধু বাংলাদেশে ১ লাখ ৮৩ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। সেই হিসাবে এটি করোনার চেয়েও ভয়াবহ মহামারি। সরকারের পক্ষে এখানে পৃষ্ঠপোষকতা করার সুযোগ থাকা উচিত নয়। তামাকবিরোধী আইনের আরও যেসব ফাঁক-ফোঁকড় রয়েছে, তার সুযোগ নিয়েই তামাক কোম্পানিগুলো ব্যবসা করছে। আমরা সেই সুযোগগুলো বন্ধ করতে চাই।’

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি সংশোধন করার দাবি তামাকবিরোধীদের দীর্ঘ দিনের। এ ক্ষেত্রে দেরি হচ্ছে কেন— এমন প্রশ্নের জবাবে এই আইনজীবী বলেন, ‘তামাক কোম্পানিগুলো আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাবান। তামাক নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, এই কোম্পানিগুলো সরকারের চেয়েও বেশি ক্ষমতাশালী কি না! ফলে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা অনেক কঠিন। বিভিন্ন স্থানে তাদের লবিস্ট নিযুক্ত রয়েছে। ফলে রাতারাতি এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব না। তবে এতটুকু বলতে পারি, বাংলাদেশের সংসদ সদস্যরাও আগে তামাক কোম্পানিগুলোর পক্ষে কথা বলেছেন। তারা বলতেন, এসব কোম্পানি থেকে অনেক রাজস্ব আসে এবং অর্থনীতিতে এসব কোম্পানির অবদান রয়েছে। কিন্তু এই প্রথম বাংলাদেশের ১২০ জন এমপি তামাকের বিরুদ্ধে সই করে চিঠি দিয়েছেন যেন তামাকবিরোধী আইন শক্তিশালী করা হয়। সেজন্য কাজ হচ্ছে না সেটা বলা যাবে না, তবে সময়ের প্রয়োজন।’

তামাক প্রতিরোধে সচেতনতার জায়গাটা পর্যাপ্ত কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আইনে তো সরাসরি বলাই আছে চাইলেও তামাকের বিজ্ঞাপন করতে পারবে না। কিন্তু বিজ্ঞাপনগুলা এমনভাবে করা হয় যেটি কার্যকর নয়। ধরুন, লেখা থাকবে তামাক খেলে বা ধূমপান করলে মৃত্যু হবে। কিন্তু দোকানে গিয়ে দেখা যায়, একটি দোকানের পুরো অংশজুড়েই এই তামাক কোম্পানির নানা বার্তা। আমরা এই জায়গাগুলো পরিবর্তন করতে চাই। সেগুলো যখন কিছু কিছু বাস্তবায়ন হচ্ছে, তখন তামাক কোম্পানিগুলোও এক ধরনের হতাশাবোধ করছে।’

তিনি বলেন, ‘এখন আরেকটি ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে ই-সিগারেট। তামাক কোম্পানিগুলোর টার্গেট তরুণরা। তাদের যারা সচেতন হয়ে তামাকটা নিচ্ছে না, তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে ই-সিগারেট। বলা হচ্ছে, এটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। অথচ বাস্তবতা একেবারেই বিপরীত। ই-সিগারেটের ক্ষতিকারক দিকগুলো নিয়েও আমরা কথা বলছি।’

আইন সংশোধন অপরিহার্য

তামাক নিয়ন্ত্রণে বর্তমান সরকারের নানা ধরনের পদক্ষেপের কারণে বর্তমানে বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার আগের তুলনায় কিছুটা হলেও কমেছে। ২০০৯ সালের গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ছিল ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ, যা ২০১৭ সালে পরিচালিত জরিপে ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে আরও শক্তিশালী ও যুগোপযোগী করতে পারলে তামাকের ব্যবহার আরও অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্সের (আত্মা) যুগ্ম আহ্বায়ক নাদিরা কিরণ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা বহু বছর ধরেই এই তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের জন্য কাজ করছি। সম্প্রতি আমরা যে বিষয়টি নিয়ে তৎপর হয়েছি, সেটি কেবল সচেতনতা নয়, বরং সরকার ও সাধারণ মানুষকে একত্রিত করে তামাক কোম্পানিগুলোর জন্য হুমকি তৈরি করা।’

তামাক কোম্পানিগুলো থেকে পাওয়া রাজস্বের বিষয়টি তামাক নিয়ন্ত্রণের অন্যতম অন্তরায় ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারের একটি মূল কথা ছিল— তামাক কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে অনেক রাজস্ব আসে। কিন্তু নীতিগতভাবে এটি ভুল ছিল। যেমন— তামাক চাষকে কৃষিপণ্য হিসেবে ধরা হতো। এই বিষয়গুলো নিয়ে সচেতনতাও ছিল না। আমরা আমাদের সফলতা হিসেবে বলতে চাই, এখন সরকারও ভাবছে যে এই নীতির পরিবর্তন প্রয়োজন। তামাকবিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের প্রস্তাব সরকার আমলে নিয়েছে— এটিও একটি বড় অর্জন।

নাদিরা কিরণ আরও বলেন, ‘সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। আমরা মনে করি, আগের বছরগুলোর চেয়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল এখন আরও বেশি তৎপর। আমি একটা কথা বলতে চাই— প্রধানমন্ত্রী যে তামাক নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন এবং ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত করার যে ঘোষণা দিয়েছেন, এটিই তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় অর্জন। তারপরও আমাদের যুদ্ধ চলছে। আমরা এই বিষয় নিয়ে আশাবাদী।’

সারাবাংলা/এসএসএ/টিআর

তামাক কোম্পানি তামাক ব্যবহার তামাক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ তামাকবিরোধী আন্দোলন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর